কঠোর অবস্থানে সরকার, হেফাজতের ৭ শীর্ষ নেতা আটক

কঠোর অবস্থানে সরকার, হেফাজতের ৭ শীর্ষ নেতা আটক

সুমন সরদার: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে  বিক্ষোভ ও সহিংসতার পর এবার কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। এখন পর্যন্ত হেফাজতের সাতজন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সর্বশেষ গতকাল ১৭ এপ্রিল শনিবার হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের সভাপতি আল্লামা জুনায়েদ আল হাবিবকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি পুলিশ।

রাজধানীর বারিধারা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। তার বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনায় মামলা ছাড়াও বর্তমানে একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিবির যুগ্ম-কমিশনার মাহবুব আলম। এর আগে গত কয়েক দিনে ২০১৩ সালের মামলায় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন, হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, ঢাকা মহানগরীর সহ-সভাপতি মাওলানা জুবায়ের আহমেদ, সহ-প্রচার সম্পাদক মুফতি শরিফউল্লাহসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সূত্র বলছে, গ্রেপ্তার হওয়া কেন্দ্রীয় নেতাদের সাম্প্রতিক মোদিবিরোধী নাশকতা মামলায় গ্রেপ্তার না দেখিয়ে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ও মাঝারি সারির কিছু নেতাকেও আইনের আওতায় এনে শীর্ষ নেতাদের প্রতি একটা বার্তা দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করে সূত্রটি। তবে মামুনুল হকসহ আরো কয়েকজন শীর্ষ নেতা রয়েছেন ধরা-ছোয়ার বাইরে। 
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জানিয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক নাশকতার অভিযোগ রয়েছে এবং আগেরও একাধিক মামলা রয়েছে তাদের গ্রেপ্তার করছি। গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এজাহারভুক্ত সব আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। 

ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি মোদিবিরোধী সহিংসতার ঘটনায় রাজধানী ঢাকার পল্টন ও মতিঝিল থানায় ১২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় হেফাজতের শীর্ষ নেতাসহ অজ্ঞাতনামাসহ প্রায় দশ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে মোট ৭৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলাতেও হেফাজতের শীর্ষ নেতাসহ স্থানীয় নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের তাণ্ডবের সময় রাজধানীতে মোট ৫৩টি মামলা দায়ের হয়েছিল। এর মধ্যে চারটি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। বাকিগুলো এখনও তদন্তাধীন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রতিক সহিংসতার মামলাগুলোর তদন্তভার এখনও থানা-পুলিশের কাছেই রয়েছে। কিন্তু পুলিশ চলমান লকডাউন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করছে ডিবি। আগের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে হেফাজত নেতাদের। থানায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো ডিবিতে হস্তান্তরের প্রক্রিয়াও চলছে। এ প্রক্রিয়া শেষ হলে গ্রেপ্তারকৃতদের সাম্প্রতিক ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাতেও গ্রেপ্তার দেখানো হবে।

এদিকে হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি মাওলানা মামুনুল হককে গ্রেপ্তারে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক ইউনিট। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মামুনুল হককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিগগিরই তাকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার সৈয়দ নূরুল ইসলাম জানিয়েছেন মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের জন্য গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। অবস্থান শনাক্ত করা গেলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক ইউনিট কাজ করছে।

হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে ১১ এপ্রিল র‌্যাব ও গোয়েন্দা বিভাগের যৌথ অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় কেন্দ্রীয় সংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল ইসলামাবাদীকে। তাকে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের তাণ্ডবে পল্টন থানায় দায়ের করা পুলিশের মামলার ১৫৭ নম্বর আসামি হিসেবে আটক দেখানো হয়। একই মামলায় ১৩ এপ্রিল হেফাজতের কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক মুফতি শরীফ উল্লাহকে ও ১৪ এপ্রিল সহকারী মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দুজনের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর তাণ্ডবে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে মামলা রয়েছে। মুফতি শরীফ উল্লাহকে ২০১৩ সালের ৬ মে যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের হওয়া বিশেষ ক্ষমতা আইনের একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। একইভাবে মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দিকেও গ্রেপ্তার করা হয় শাপলা চত্বরের ঘটনায় করা একটি মামলায়। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-অর্থসম্পাদক ও ঢাকা মহানগরী কমিটির সহসভাপতি মুফতি ইলিয়াসকে ১১ এপ্রিল আটক করে র‌্যাব। নাশকতার পরিকল্পনা, ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়ানো, ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৪ এপ্রিল রাজধানীর লালবাগ থেকে আরেক কেন্দ্রীয় নেতা সাখাওয়াত হোসেনকে আটক করে গোয়েন্দারা। মোদির সফরের বিরোধিতা করে রাজধানীতে সহিংস ঘটনায় পল্টন ও মতিঝিল থানায় হওয়া একাধিক মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। তাকেও ২০১৩ সালের একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ১৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরীর সহ-সভাপতি মাওলানা জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাকেও ২০১৩ সালের একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১৭ এপ্রিল আদালতে সোপর্দ করা হয়। 

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (মতিঝিল বিভাগ) মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, আমাদের কাছে ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে সহিংসতার ঘটনায় বেশ কিছু মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। সেসব মামলার দ্রুত তদন্ত শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছি। পুলিশ জানায়, হেফাজতের সাম্প্রতিক সহিংসতার কারণে সরকার হার্ডলাইনে রয়েছে। এ কারণে যাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা উস্কানির অভিযোগ রয়েছে তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে। মধ্যমসারির নেতাদের গ্রেপ্তারের পর শীর্ষ নেতাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। নারীঘটিত কাণ্ডে মামুনুল হকের জড়িয়ে পড়াও নতুন মোড় দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। এ ঘটনায় হেফাজত নেতা খালেদ সাইফুল্লাহ ওরফে সাইফ কাজি সমির ও কর্মী অহিদ ওরফে অহিদ হুজুরকে গ্রেপ্তার করে নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। মামুনুলকে নারীসহ আটকের জেরে নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি সোহাগ রনিকে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনাকারী হিসেবে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

নারায়ণগঞ্জের রয়েল রিসোর্টে হামলা, ভাঙচুর ও পুলিশি কাজে বাধা এবং নাশকতার মামলার আসামি হিসেবে র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয় সোনারগাঁও উপজেলার হেফাজতের আমির মহিউদ্দিন খান, সহ-সভাপতি মোয়াজ্জেম ও  সেক্রেটারি শাহাজাহান ওরফে শিবলী। হেফাজতের প্রচার সম্পাদক মো. জাকারিয়া নোমান ফয়েজি বলেন, চলতি মাসের ৭ তারিখ থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত তিন শতাধিক হেফাজতকর্মীকেও আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন ৭ জন।

এদিকে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে অভিযোগ করে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও সন্ত্রাসের অপরাধে অবিলম্বে মামুনুল-বাবুনগরীসহ হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার দাবি করা হয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে।  ‘জামায়াত- হেফাজত চক্রের বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা: সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ ওয়েবিনারে এই দাবি জানায় তারা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক। নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে অংশ নেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, কথাশিল্পী অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল প্রমুখ। 

বিআলো/ইলিয়াস