করোনাভাইরাস: সিদ্ধান্ত-পরামর্শ হলেও নেই বাস্তবায়ন

করোনাভাইরাস: সিদ্ধান্ত-পরামর্শ হলেও নেই বাস্তবায়ন
ফাইল ছবি

মেহেদী হাসান: দেশে মহামারী করোনাভাইরাস নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার যেন কোন কমতি নেই। গত ৮মার্চ দেশে সর্ব প্রথম এই বৈশ্বিক মহামারী করোনা শনাক্ত হয়। এরপর থেকেই টানা ৩মাসের বেশি সময় ধরে সংক্রমন চালিয়ে যাচ্ছে এই ছোঁয়াছে ব্যাধি। একের পর এক দেশে মহামারী করোনা প্রতিরোধে নানাবিধ সিদ্ধান্ত, পরামর্শ ও পদক্ষেপ নেয়া হলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। সিদ্ধান্ত হলেও কিছুতেই হচ্ছে না সঠিভাবে বাস্তবায়ন। এতদিন ছিল সিদ্ধান্তহীনতার অভাব আর এখন করোনা নিয়ে দেশে দেখা দিচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের অভাব। দেশে প্রতিদিনই তিন হাজারের উপরে করোনার রোগী শনাক্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই আক্রান্ত ছাড়িয়েছে ১লাখ ৩০হাজার। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এখনই করোনা প্রতিরোধে সু-নির্দিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা করা না হলে দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি সামনে আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

দেশে প্রথমদিকে সংক্রমন প্রতিরোধে সাধারণ ছুটি সাথে বড় ধরনের লকডাউন থাকায় তেমন সংক্রমন হয়নি। তবে স্থবির হয়ে পড়ছিল দেশের জীবন জীবিকা। এই বিষয় বিবেচনা করেই খুলে দেয়া হয়েছিল সব কিছু। তবে এতে আরোপ করা হয়েছিল বেশ কিছু স্বাস্থ্যবিধি। তবে দেশে অধিকাংশ মানুষই স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলায় দিনদিন এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমন বেড়েই চলেছে। বর্তমান অবস্থায় এলাকা ভিত্তিক বড় পরিসরে লকডাউন দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি কমিটি। করোনা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির দফায় দফায় সুপারিশ দিয়েছে নানা বিষয়ে। কিন্তু এসব সুপারিশ কমই আমলে নিয়েছে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ।

সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাড়ছে হতাশা:

করোনা মোকাবেলায় বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় সর্বত্রই বাড়ছে হতাশা ও আশংকা। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লকডাউন শিথিলের ক্ষেত্রে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পরামর্শও আমলে নেয়া হচ্ছে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা হলো রোগ সংক্রমণের হার সুনির্দিষ্টভাবে না কমার আগে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু করলে রোগের হার বাড়ার আশঙ্কা থাকে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযোজ্য বিধি–বিধানগুলো সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ না করে শিথিল করা হলে রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে পারে। 

সূত্রে জানা গেছে, ৭ মে কারিগরি কমিটির তিনটি সুপরিশের প্রথমটিতে বলা হয়, কভিড-১৯ একটি সংক্রামক রোগ, যা হাঁচি-কাশি ও সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। জনসমাগম এ রোগের বিস্তার এর জন্য সহায়ক। সংক্রমণের হার সুনির্দিষ্টভাবে না কমার আগে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু করলে সংক্রমণের হার বাড়ার আশংকা থাকে। সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ না করে শিথিল করা হলে রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে, কভিড-১৯ চিকিৎসায় হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহারের ঝুঁকি সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এ সমস্ত ওষুধ বা ব্যবস্থা চিকিৎসা বা প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহার না করার পরামর্শ দিচ্ছে। আর তৃতীয়টি হলো, কভিড-১৯ ও অন্যান্য রোগীর চিকিৎসা একই হাসপাতালে পৃথক পৃথক ব্যবস্থায় করার নির্দেশনা দিয়েছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনিক, সাংগঠনিক, জনবল ও সরঞ্জামের বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন তারা।

পরামর্শক কমিটির সুপারিশ কি পরিমাণ বাস্তবায়ন হয়েছে-জানতে চাইলে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়ন দেখছি না। হতাশ হয়েছি। সন্তুষ্ট হতে পারছি না। আমাদের দেয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে আরো কিছু সুপারিশ দিতাম। বড় কোন এলাকা লকডাইন দেয়া হচ্ছে না। টেস্টিং কিট সংকট। এ সপ্তাহে কমিটি আবারো মিটিংয়ে বসতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন চালু করতে হবে। মনিটর জোরদার করতে হবে। এসব বিষয়ে আগেই পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

সর্বশেষ ১০ই জুন ৫টি সুপারিশ দেয় এই কমিটি। পরামর্শ কমিটি তাদের সর্বশেষ সুপারিশে বলেছিল, করোনার রোগের বিস্তার বন্ধ করতে সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণ নিশ্চিত করার জন্য পূর্ণলকডাউন দিতে হবে। কমিটি জীবন এবং জীবিকার সামঞ্জস্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সারাদেশে আক্রান্ত ও ঝুঁকির মাত্রার ভিত্তিতে যতটা বড় এলাকায় সম্ভব জরুরিভাবে লকডাউনের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করে পরামর্শক কমিটি। কিন্তু দেশে বড় কোনো এলাকা এখন পর্যন্ত লকডাউন চোখে পড়েনি। এছাড়া পরামর্শক কমিটি অত্যন্ত জরুরিভিত্তিতে সব হাসপাতালে হাই- ফ্লো অক্সিজেন থেরাপির প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে চালু করার কথা বলে। হাই-ফ্লো অক্সিজেনসহ চিকিৎসার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জন্য আলাদা হাসপাতাল চালুর পরামর্শ দেয়া হয়।

হাসপাতালগুলোতে বাড়েনি সেবার মান

দেশে করোনা পরিস্থিতি ক্রমশই ভয়াবহ রুপ ধারণ করলেও বাড়ছেনা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মান। উল্টো অনেক হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগেরও যেন কমতি নেই।

স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা নিয়ে বরাবরই অভিযোগ থাকলেও, করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিস্তার লাভের পর থেকেই দেশটির স্বাস্থ্য অবস্থা যে কতটা নাজুক, সেই চিত্রটি ফুটে উঠেছে। একদিকে যেমন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালগুলো ঠিকভাবে সেবা দিতে পারছে না, অন্যদিকে অন্যান্য জটিলতার রোগীরাও চিকিৎসা পেতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি সেই তালিকায় রয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোও।

জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার অংশ হিসেবে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা পর্যায়ক্রমে শিথিল করার জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করার সুপারিশ করে। কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য যে হাসপাতালগুলো নিয়োজিত আছে, সেখানে বিভিন্ন বিষয়ের যথেষ্ট জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ চিকিৎসক থাকতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার জন্য নিয়োজিত ওয়ার্ড বয় ও পরিচ্ছন্নকর্মীদের সংখ্যা বাড়িয়ে সেবার মান উন্নত করতে হবে। সুপারিশে বলা হয়, স্বাস্থ্যসেবাকর্মী, চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মানসম্মত সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করতে হবে। বিশেষত যারা মুমূর্ষুু রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত ও সংক্রমিত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকেন তাদের জন্য সুরক্ষা সামগ্রীসমূহ যাতে মানসম্পন্ন হয় তা নিশ্চিত করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি থাকা দরকার। কোভিড পরীক্ষা ভর্তির পরও করা যেতে পারে। যে সমস্ত রোগীর উন্নতি হয়েছে এবং ছাড় পাওয়ার যোগ্য তারা পর পর দুইটি কোভিড টেস্ট নেগেটিভ না হওয়া পর্যন্ত ছাড়া পান না। সে কারণে হাসপাতালসমূহের একটা বিরাট অংশের বিছানায় এরা অবস্থান করছেন। যা এইসব হাসপাতালের বিছানার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।

এদিকে দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো মূলত সেবা দেয়ার নামে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে। সেখানে সেবার চেয়ে আর্থিক মুনাফার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। বড় বড় বেসরকারি হাসপাতাল গড়েই ওঠে সেইসব বিশেসায়িত বিভাগ নিয়ে, যে রোগগুলো উপশমে রোগীদের বিপুল অর্থ প্রদান করতে হয়ে। অনেক বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ রোগের চিকিৎসা হয় না। এমনকি দেশে করোনা আসার পর থেকে বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল সব ধরনের চিকিৎসা বন্ধ রেখেছে। এতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন হাসপাতালগুলোর প্রতি সরকারি নজরদারি অনেকটাই বেশি জরুরি। নজরদারির ঘাটতি থাকায় মেডিকেলগুলোতে সেবার মান দিনদিন কমে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে সেবার মান বাড়াতে হলে দরকার সঠিক তদারকি।

জোনিং বাস্তবায়নে এখনো ধোয়াসা

দেশের করোনার পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার জোনিং পদ্ধতি চালু করার সিদ্ধান্ত নিলেও তার বাস্তবিক রুপ দেখছে না কেউই। করোনায় দেশে রেড জোনগুলোতে লকডাউনের সিদ্ধান্ত আছে তবে নেই সঠিক বাস্তবায়ন। এখন পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকায় পূর্ব রাজাবাজার এবং ঢাকার বাইরে তিনটি এলাকা লকডাউনের আওতায় আনা হয়েছে। সেখানে ইতোমধ্যে ভাল ফলাফল মিলছে। তবে রাজধানীতে জোনিং কার্যক্রমের এর সিদ্ধান্ত হলেও কবে হবে, কীভাবে হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তাই দেশে প্রতিনিয়তই বাড়ছে বিভিন্ন ধোয়াসা। ইতোমধ্যে রাজধানীতে রেডজোন কার্যকর করার গুঞ্জন শোনা গেলেও তা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে ভূমিকা কতটুকু তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৭টি এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২৮টি এলাকা, এই মোট ৪৫টি এলাকাকে ঢাকার রেড জোন ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকা দুই সিটির রেড জোন ঘোষণা করা হলেও কবে, কখন লকডাউন করা হবে তা এখনো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়নি। তাই জোন নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ভূমিকাও করা হচ্ছে না।


বিআলোে/ইসরাত