৫১ প্রাণ গেলেও জামিনে ঘুরছে মালিক

৫১ প্রাণ গেলেও জামিনে ঘুরছে মালিক

মেহেদী হাসান: দেশের ইতিহাসে সব অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলছিল নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের সজীব গ্রুপের হাসেম ফুডের সেজান কারখানার আগুন। প্রায় ৪৫ ঘণ্টা পর ৬তলা ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এরমধ্যেই প্রাণহানি হয় ৫২ জন শ্রমিকের। এ বছরের ৮ জুলাই ঘটেছিল ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডটি।

সেজান কারখানা থেকে বিকাল ৪টার সিফটের কর্মরত অনেকেই কাজ শেষে বিদায় নেয়। অজ্ঞাত কারণে ৬তলা ভবনের ৩য় তলাটি সেই দিন রাখা হয়েছিল বন্ধ। কর্মরতদের মধ্যে ছিল অপ্রাপ্ত বয়স্করাও। বিকাল আনুমানিক সাড়ে ৫টা, হঠাৎ করেই ভবনের চারপাশে দ্রুতবেগে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। চারদিক ছুটাছুটি, আগুন নেভানোর প্রাণপণ চেষ্টার ফাকেই বন্ধ করে দেওয়া হয় বের হওয়ার অনেক গেট।

৪র্থ তলার ফ্লোরের সকলকে আটকে বাহির থেকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। সেখানে যেন চলছিল আগুনে পুড়িয়ে মারার হত্যাযজ্ঞের চেষ্টা। ভবনটির এই ফ্লোরেই মারা গেছেন ৪৮জনের মতো তাজা প্রাণ। আগুনে অঙ্গার কাউকেই যেন চেনার কোনো উপায় নেই। অর্ধশতাধিকেরও বেশি পরিবার আজও গুমরে কাঁদে। স্বজনের পোড়া গন্ধ যেন এখনো তাদের হৃদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের বিচারের আশা যেন দিন দিন হচ্ছে দূরাশা। কারণ ইতিমধ্যে দেশে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোতে মামলা হলেও দৃষ্টিন্তমূলক কোনো শাস্তির নজির নেই। একদিকে মালিক পক্ষ যেহেতু ধনী, প্রভাবশালী, দানবীর, হয়তো তাদের ক্ষতিপূরণের দানের টাকার নিচেই চাপা পড়তে পারে ন্যায় বিচার, এমনটাই মনে করছেন অনেকে। আগুনের মাত্রা এতটা তীব্র হবে এবং ক্ষয়ক্ষতি এতটা হবে এটা ভাবতেই পারেনি কতৃপক্ষ। হাজার কোটি টাকার ব্যাংক লোনের বোঝা মাথায় ওঠার পরই অগ্নিকান্ড যেন অনেককেই ভাবিয়ে তুলছে। অনেকেই স্বজন হারিয়েও আসায় বুক বেঁধে আছে, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আসার। বিচারের আশায় এখন সরকারের দিকেই তাকিয়ে আছে স্বজনহারা পরিবারগুলো। 

কিডনির জটিলতায় আক্রান্ত মায়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড়ে জীবন যুদ্ধে নেমে পড়ে সদ্য শৈশব পার হওয়া ১৩ বছর বয়সি কিশোরী শান্তা আক্তার। ৬ বছর বয়সে হারিয়েছেন বাবাকে। শান্তার জন্মস্থান নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। সেজান কারখানা ভবনের ৩য় তলায় নসিলা সেকশানে কাজ করতো শান্তা। ২য় তলায় কাজ করেন ভাই শোভন। কারখানায় আগুন লাগলে ২য় তলা থেকে লাফিয়ে কোনোরকম বেঁচে যায় তিনি। অনেক মানুষকেই শোভন জীবিত উদ্ধার করেছে, তবে পরিশেষে নিজের বোনের নিথর দেহখানা তার কাঁধেই উঠেছে। বাবার পাশেই চিরনিদ্রায় শান্তা। শান্তার মা শিমু আক্তারের শেষ কথা ‘ভবিষ্যতে যেন আর কোনো মাকেই সন্তানের পোড়া দেহ দেখতে না হয় এই কাজটা আপনারা করেন!’ সেই দিন সেজান কারখানায় পুড়ে অঙ্গার হয়েছে অর্ধশতাধিকের বেশি পরিবারের স্বপ্ন।

এ ঘটনায় সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেমসহ আটজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয়। অবহেলার কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে মর্মে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদেও (রিমান্ডে) স্বীকার করেছে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার শিল্পপতি আবুল হাসেম ও দুই ছেলেসহ ৮ আসামি। তবে সহজেই কারখানার মালিক আবুল হাসেম ও তার দুই ছেলে জামিনে মুক্তি পান। পুলিশের দায়েরকৃত মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইডি। প্রাথমিক পরিদর্শন শেষে দশটি পয়েন্টের ওপর নির্ভর করে চলছে তাদের তদন্ত। শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখবে বলেও মনে করছেন সিআইডির কর্মকর্তারা। 

এ বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বাংলাদেশের আলোকে বলেন, হাসেম ফুড কারখানার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলাটির তদন্তের অগ্রগতি খুবই ভালো। তদন্তকাজ শেষ হলে কিছুদিনের মধ্যেই প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হবে।

পাকিস্তানের সেজান জুস আমদানির মধ্য দিয়ে ব্যবসা শুরু হয় আবুল হাসেমের। এরপর আমদানির পাশাপাশি দেশেই তৈরি করেন পাকিস্তানের সেজান জুস। আমদানি থেকে হয়ে ওঠেন উৎপাদক। প্রতিষ্ঠা করেন সজিব গ্রুপ। এই গ্রুপে প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০টিরও বেশি। হঠাৎ করে ফুলেফেঁপে ওঠা আবুল হাসেমের ঋণের বোঝাও যেন অনেকটাই ভারী। সেই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই কারখানাটিতে আগুন লাগে।

রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সজীব গ্রুপের ১১টি কোম্পানির নামে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা (মে মাসের তথ্য)। হাসেম ফুডস লিমিটেডের নামেই রয়েছে ৯৯৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির কারখানাতেই উৎপাদন হতো পাকিস্তানের সেজান জুস। এই প্রতিষ্ঠানের ঋণ আছে ইসলামী ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, এইচএসবিসি, মধুমতি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি ফাইন্যান্সের। এছাড়াও সজীব গ্রুপের সজীব করপোরেশনের নামে ৩৬০ কোটি টাকা, হাসেম ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেডের ২০১ কোটি,  হাসেম রাইস মিলস লিমিটেডের ৩৩৮ কোটি টাকা, সজীব লজিস্টিকস লিমিটেডের ৩৮ কোটি, হাসেম এগ্রো প্রসেসিং লিমিটেডের ২০ কোটি, সজীব হোমস লিমিটেডের ২৯ কোটি, স্যাভি ফুডস লিমিটেডের ৩ কোটি, হাসেম অটো রাইস মিলের ৮ কোটি ও মারস ইন্টারন্যাশনালের ২১ লাখ টাকার ব্যাংক ঋণ রয়েছে।

কারখানা ভবনটিতে সেজান জুস, নসিলা, ট্যাং, কুলসন ম্যাকারনি, বোর্নভিটার মতো জনপ্রিয় সব খাদ্যপণ্য তৈরি হতো। এ সকল খাদ্যপণ্য তৈরি ও প্যাকেটজাতও হতো ৬তলা বিশিষ্ট এই ভবনে। ছিল বিভিন্ন ধরনের ক্যামিকেল ও দাহ্য পদার্থ। কেমিক্যাল গুদাম ব্যবহারে হাসেম ফুডের ছয়তলা ভবনের কোনো অনুমোদন বা লাইসেন্স দেয়নি বিস্ফোরক পরিদপ্তর। ভবনটিতে প্লাস্টিক, পেট্রোসিনথেটিক কেমিক্যাল, রেজিন, বাহারি পানীয়র ফ্লেভার, রোল, ফয়েল প্যাকেট ও কার্টনসহ বিভিন্ন মালামালে গুদাম ভর্তি ছিল। একটি কারখানা ভবনে যে পরিমাণ মালামাল রাখার বিধান আছে, তার চেয়েও পাঁচ গুণ মালামাল মজুত করা ছিল।

বিস্ফোরক পরিদপ্তর সূত্র জানায়, কোনো গোডাউনে বিস্ফোরক পদার্থ ব্যবহার করা হলে অবশ্যই বিস্ফোরক পরিদপ্তর থেকে অনুমোদন বা লাইসেন্স নিতে হয়। অনুমতি ছাড়া বিস্ফোরক পদার্থ নিজেদের মতো করে গোডাউনে রাখলে আইন অনুযায়ী শাস্তি হওয়ার বিধান রয়েছে।  

এ বিষয়ে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক (উপসচিব) ইঞ্জিনিয়ার আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশের আলোকে বলেন, হাসেম ফুডস লিমিটেডের নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কারখানাটিকে বিস্ফোরক পরিদপ্তর কোনো অনুমোদন বা লাইসেন্স দেয়নি। কোনো অভিযোগ পেলে বিস্ফোরক পরিদপ্তর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।

অনুসন্ধান বলছে, হাসেম ফুড কারখানার ভবনটিতে ফায়ার সেফটি প্ল্যানের অনুমোদন নিলেও প্ল্যানে দেওয়া নির্দেশনা মানা হয়নি। দেশের প্রতিটি কারখানার ভবনের নকশা অনুযায়ী কারখানা করার মতো সক্ষমতা থাকলে ফায়ার সেফটি প্ল্যানের অনুমোদন দেয় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। ৩৪ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর স্থাপিত সেজান কারখানায় কয়েকটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছাড়া অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামের তেমন কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। 

এছাড়াও ভবনের ওপরে ওঠার দুটি সিঁড়ি ত্রুটিপূর্ণ। ভবন ও কারখানার লিফট ঘিরে ওঠা সিঁড়িগুলো একেবারেই উপযোগী নয় বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। কারখানাটির ভবনে বহুমাত্রিক সমস্যা ছিল। অনেক স্থানেই ছিল তালাবদ্ধ। আবার প্রতিটি ফ্লোরেই নেট দিয়ে দেওয়া ছিল বেরিকেড। একই ভবনে বিভিন্ন আইটেমের খাদ্য তৈরি করায় বাহারি কেমিক্যালসহ বিভিন্ন দ্রব্যাদি রাখায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগেছে অনেক।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবনটিতে দাহ্য পদার্থ এবং রাসায়নিকের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। এ ধরনের আগুন শুধু পানি ছিটিয়ে নেভানো সম্ভব নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে শুধু পানি ছিটালে আগুন আরো বেড়ে যায়।

এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান, পিএসসি বাংলাদেশের আলোকে বলেন, হাসেম ফুডের সেজান কারখানার জন্য ফায়ার সেফটি প্ল্যানের অনুমোদন নিয়েছিলেন তারা। তবে অনুমোদন নেওয়ার পর প্ল্যান অনুযায়ী যে সরঞ্জামাদি কারখানায় লাগানোর কথা সেটা তারা করেননি। ফায়ার সেফটি প্ল্যান হচ্ছে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং, ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং-এর মধ্যে যে সকল জিনিসপত্র কারখানায় রাখার বা লাগানোর কথা ছিল তা তারা করেননি। এটা আরো বড় অন্যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৬তলা বিশিষ্ট কারখানার ভবনটি তৈরির সময় বিল্ডিং কোড বা ইমারত নকশা বিধিও মানা হয়নি। কারখানাটির পরিবেশ অধিদপ্তরেরও ছাড়পত্র থাকলেও তা নবায়ন ছিল না। অগ্নিকাণ্ডের আগে সঠিক সময়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র নবায়নের আবেদন করেননি।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ আল-মামুন বাংলাদেশের আলোকে বলেন, হাসেম ফুডের কারখানার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছিল আগে থেকেই। তবে তা নবায়ন করেনি তারা। সঠিক সময়ের মধ্যে আবেদন জমা না দিলে ছাড়পত্র নবায়নে বেগ পেতে হয় বলেও জানান তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অর্ধশতাধিক শ্রমিক নিহতের ঘটনায় সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম ও উপ-মহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ অফিসের সহকারী শ্রম পরিদর্শক সৈকত মাহমুদ। তবে সেজান কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ৭দিন আগেই শ্রম আইনের ৯টি ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে গত ৩০ জুন অধিদপ্তরটির শ্রম পরিদর্শক নেছার উদ্দিন আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। মামলায় উল্লেখ ছিল, কারখানাটির ছয়তলার পূর্বদিকের কক্ষে নির্মল বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না অনুমোদিত নকশার সঙ্গে কারখানার মেশিন আউটলেট প্যাটার্নের সামঞ্জস্য, সঠিক ছিল না ভবনের ভেতরে বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা, যন্ত্রপাতি স্থাপনের ক্ষেত্রে দেওয়াল থেকে দেওয়ালের দূরত্বও কম ছিল, কারখানায় ছিল না কার্যকর সেফটি কমিটি। এছাড়াও কারখানায় করোনাকালে জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হতো না, ছিল অনেক শিশুশ্রমিক এবং শ্রমিক সংখ্যানুপাতে লাইসেন্স ক্যাটাগরিও সঠিক নয় বলেও উল্লেখ ছিল।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া বাংলাদেশের আলোকে বলেন, কোনো কারখানা করতে হলে তা উদ্বোধনের ১৫দিন আগেই অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নিতে হয়, আমি যোগদান করেছি ২০১৯ সালে। তবে এ পর্যন্ত লাইসেন্স নেওয়ার জন্য তাদের কাছ থেকে কোনো আবেদন পাইনি।

সেজানের কারখানার এত অনিয়মের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের ভূমিকা সম্পর্কে একাধিকবার সেজান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করতে চাইলেও তারা বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

বিআলো/ইলিয়াস