চট্টগ্রামে জব্বারের বলীখেলা সোমবার শুরু

চট্টগ্রামে জব্বারের বলীখেলা সোমবার শুরু

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : অবশেষে আলোর মুখ দেখছে চট্টগ্রামের শত বছরের ঐতিহ্য লালদীঘিতে ঐতিহাসিক জব্বারের বলী খেলা। এই বলী খেলাকে ঘিরে প্রতি বছরের মতো এবারও লালদিঘীর মাঠের আশপাশের দেড় বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আজ রোববার থেকে শুরু হচ্ছে বৈশাখী মেলা। আগামীকাল সোমবার বিকেল তিনটায় লালদীঘি মাঠের পাশে চার রাস্তার মোড় ঘেঁষে অস্থায়ী মঞ্চ করে হবে বলী খেলা।

অবশ্য গত শুক্রবার রাত থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা পণ্য সামগ্রী নিয়ে আসতে শুরু করেছেন বিক্রেতারা। লালদীঘিসহ আশেপাশের এলাকায় নিয়ে আসা পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন তারা। গতকাল শনিবার বিকিকিনিও হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে গত দুই বছর বলী খেলা হয়নি। এবার লালদীঘি মাঠ পাওয়া না যাওয়ায় অনিশ্চয়তা ছিল। তবে শেষ মুহূর্তে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী উদ্যোগ নেয়ায় এবার বলী খেলা হচ্ছে। মেয়রের উদ্যোগে লালদীঘি মাঠের পাশে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চত্বরে ২০ ফুট বাই ২০ ফুটের অস্থায়ী মঞ্চে হবে বলী খেলা। দীর্ঘ বিরতির পর খেলা ও মেলা হওয়ায় বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে নগরবাসীর চোখে-মুখে। একইসঙ্গে মেলা শুরু হওয়ায় সাজ সাজ রব পড়েছে লালদীঘিসহ আশেপাশের এলাকায়।

ঐতিহাসিক জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষে কোতোয়ালী মোড় থেকে নিউ মার্কেট, বাংলাদেশ ব্যাংক মোড় থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, আন্দরকিল্লা ও জেল রোড থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত বসছে বৈশাখী মেলা।

তবে মেলা ঘুরে দেখা গেছে অন্যান্য বারের তুলনায় এবার বিক্রেতা এসেছে কম। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মাটির তৈজসপত্র, মুড়ি মুড়কি, গাছের চারা, ফুল ঝাড়ু, মাটির তৈরি তৈজসপত্র, খেলনা, ফুলদানি ও পুতুল, বেত-কাঠ ও বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র, হাতপাখা, মাছ ধরার পলো, ডালা, কুলো, গাছের চারা, মুড়ি মুড়কি, পাটি আর নানা রকম দেশি ফলসহ খেলনা আর বাঁশ-বেতের পণ্য নিয়ে এসেছেন বিক্রেতারা।
রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, যশোর, কুমিল্লা থেকে পণ্য সামগ্রী নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেলায় যারা বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিয়ে এসেছেন তারা কিন্তু বংশ পরম্পরায় জব্বারের বলী খেলায় আসছেন।

গতকাল মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, কলসি থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যের পসরা দেখা গেছে। আছে রঙে বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ মাটির পণ্যও। ঢাকা, যশোর ও কুমিল্লা থেকে কুটির ও মাটির শিল্পের পণ্য নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। হাটহাজারী, পটিয়া, বাঁশখালী, সাতকানিয়া থেকে ফুলের ও ফলদ চারা বিক্রি করতে আসেন ব্যবসায়ীরা।

আয়োজক কমিটি জানায়, খাট থেকে শুরু করে সুঁই সুতায় বোনা নিপুণ নকশাদার রুমালও পাওয়া যাবে মেলায়। ফুলঝাড়ু, হাত পাখা, শীতল পাটি, মাটির ব্যাংক, বাঁশি, দা, খুন্তি, মাটির টব ও শো পিস, ছোটদের খেলনা, প্লাস্টিকের মাদুর, মেয়েদের হাতের চুরিসহ সব ধরনের পণ্য পাওয়া যাবে।

মাটির আসবাব নিয়ে আসা শহীদ সওদাগর বলেন, আজ টুকটাক বিকিকিনি হচ্ছে। আজ থেকে বেচাবিক্রি বাড়বে।

মেলার আয়োজক ‘আবদুল জব্বারের স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও মেলা কমিটি’। কমিটির আহ্বায়ক স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী বলেন, প্রতিবারের তুলনায় এবার এখন পর্যন্ত বিক্রেতা এসেছে কম। মাটির তৈজসপত্র, খেলনা আর বাঁশ-বেতের পণ্য নিয়ে বিক্রেতারা এসেছে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে। মুড়ি মুড়কি, গাছের চারা, ফুল ঝাড়ু এসব পণ্য নিয়ে বিক্রেতারা আসছেন পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে।


বলী খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৫০ জন বলীর নাম তালিকাভুক্ত করব। এর মধ্যে বাছাই করে ১০০ জনকে খেলতে দেব। মানে ৫০ রাউন্ড খেলা হবে। এবার ক্রেস্টের পাশাপাশি বলী খেলার প্রথম পুরস্কার থাকছে ২৫ হাজার টাকা। এছাড়া ২য় পুরস্কার ১৫ হাজার টাকা, ৩য় পুরস্কার ৬ হাজার টাকা এবং ৪র্থ পুরস্কার দেয়া হবে ৫ হাজার টাকা।
বলীখেলার ট্রফি ও জার্সির মোড়ক উম্মোচন করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী। মোড়ক উম্মোচনকালে মেয়র বলেন, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শতোর্ধ্ব বর্ষের লোক-ঐতিহ্য আবদুল জাব্বার সওদাগরের বলীখেলা দেশপ্রেম ও স্বদেশী চেতনাকে সমুন্নত রাখে।

এদিকে, ঐতিহ্যবাহী আব্দুল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা উপলক্ষে লালদিঘি অভিমুখী সকল প্রকার যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণের কথা জানিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (জনসংযোগ) শাহাদত হোসেন রাসেল জানান, মেলা উপলক্ষে এখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল সংখ্যক ক্রেতা, বিক্রেতা ও দর্শনার্থীর সমাগম হয়। মেলায় আগত লোকজনের সমাগমের কারণে মেলাকেন্দ্রিক আশপাশ এলাকায় রোববার থেকে মঙ্গলবার লালদীঘি অভিমুখী সকল প্রকার যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রিত থাকবে।

আন্দরকিল্লা মোড় থেকে বক্সিরহাট-লালদিঘিগামী রাস্তা বন্ধ থাকবে। জেলা পরিষদ মার্কেট থেকে টেরিবাজার-আন্দরকিল্লাগামী রাস্তা, সিনেমা প্যালেস থেকে কেসি দে রোড হয়ে সোনালী ব্যাংক পর্যন্ত রাস্তা, জহুর হকার্স/মহল মার্কেট থেকে বাটা ক্রসিং পর্যন্ত রাস্তা, টেরিবাজার ফুলের দোকান থেকে টেরিবাজারগামী রাস্তা, আমানত শাহ মাজার রোডের মুখ থেকে টেরিবাজারগামী রাস্তায় যনবাহন চলাচল করতে পারবে না।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং রোগীদের আসা-যাওয়ার জন্য সিএমপি সব ধরণের সহায়তা দেবে। টেরিবাজার, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ, চাক্তাইগামী সব ধরণের পণ্যবাহী গাড়ি, বড় গাড়ি রাজাখালী দিয়ে প্রবেশ করে মেরিন ড্রাইভ রোড দিয়ে বের হয়ে যাবে।

উল্লেখ্য, ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে এই বলী খেলার সূচনা করেন। তার মৃত্যুর পর এ প্রতিযোগিতা জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। এ খেলায় অংশগ্রহণকারীদের বলা হয় ‘বলী’। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘কুস্তি’ বলী খেলা নামে পরিচিত।

বিআলো/শিলি