জোড়াতালি দিয়ে ২০ দলীয় জোটকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা বিএনপির

জোড়াতালি দিয়ে ২০ দলীয় জোটকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা বিএনপির

নিজস্ব প্রতিবেদক:বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে একের পর বেরিয়ে যাচ্ছে শরিক দলগুলো। ১ অক্টোবর জোটের একমাত্র নিবন্ধন ইসলামী রাজনৈতিক দল খেলাফত মজলিস বিদায় জানিয়েছে ২০ দলীয় জোটকে। দীর্ঘ ২২ বছর দলটি এ জোটের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলো।


এর আগে ১৪ জুলাই জোটের আরেক শরিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামও ত্যাগ করেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। বর্তমানে দৃশ্যমান কোনো অস্তিত্ব নেই ২০ দলীয় জোটে। অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। যুদ্ধাপরাধী ও কোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকায় রাজনীতি করতে পারছে না জোটের অন্যতম শরিক জামায়াত।

এই জোটের বিএনপিসহ দুই-একটি দল ছাড়া ভাঙন ধরেছে প্রতিটি দলে। জোট ছেড়ে চলে গেছে অধিকাংশ দল। যদিও দলগুলোর সিনিয়র নেতারা চলে গেলেও জুনিয়র নেতাদের দিয়ে সেই সকল দলের সাইনবোর্ড টিকিয়ে রাখতে জোড়াতালি দিয়ে ২০ দলীয় জোট জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছে বিএনপি।


এর আগে ২০১৯ সালের ৬ মে জোট ছাড়েন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) আন্দালিব রহমান পার্থ। তার আগে ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর বিএনপি জোট ছাড়ে লেবার পার্টি এবং তারও আগে ২০১৬ সালের ৭ জুন বিএনপির জোট ছেড়ে যায় মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট। মূলত নাম সর্বস্ব বা অস্তিত্বহীনভাবে চলছে ২০ দলীয় জোট।


এর কারণ হিসেবে জোটের এক নেতা অভিযোগ করে বলেন, জোট আর আদৌ আছে কি না তা বলতে পারছেন না। বিগত জাতীয় নির্বাচনের পর এ পর্যন্ত জোটগত বৈঠক হয়েছে মাত্র দুটি। ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক হয়েছে ডজনখানেক। জোটের বৈঠক ডাকা হয়, বিএনপির নেয়া সিদ্ধান্তে সম্মতি নিতে। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টে জোটের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয় বিএনপিকে। এভাবে দুই জোটের শরিকদের দুই রকম মূল্যায়ন করছে বিএনপি। যদিও ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের তুলনায় ২০ দলের শরিকদের সাংগঠনিক শক্তি ও অবস্থান বেশি শক্তিশালী।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে মূলত ৮০ দশকে জোটের রাজনীতি শুরু হয়। সেসময় এরশাদ শাসনামলে রাজপথে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দল এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট রাজপথ কম্পিত রেখেছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় বড় দুটি রাজনৈতিক দল জোটের রাজনীতির বাইরে আসতে পারেনি। ১৯৯১ এবং ৯৬-এর পর থেকে ক্ষমতায় আসার প্রতিযোগিতায় জোটের রাজনীতি অপরিহার্য হয়ে পড়ে।


২০০১ সালে চারদলীয় জোটের ব্যানারেই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে বিএনপি। ২০০৮ সালেও মহাজোট তৈরি করে ক্ষমতায় আসে বর্তমান আওয়ামী লীগ। যদিও আওয়ামী লীগে এখন মহাজোটের অস্তিত্ব না থাকলেও রয়েছে ১৪ দলীয় জোট।


১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি বিএনপি, এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট (আমিনী) নিয়ে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ১৮ দল এবং পরে পর্যায়ক্রমে আরও দুটি দল নিয়ে ২০-দলীয় জোট গঠিত হয়।


২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলো হচ্ছে- বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, ইসলামী ঐক্যজোট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), খেলাফত মজলিস, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা, কল্যাণ পার্টি, ন্যাপ, মুসলিম লীগ-বিএমএল, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এডিপি, লেবার পার্টি, ইসলামিক পার্টি, ডেমোক্রটিক লীগ, পিপলস লীগ, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), সাম্যবাদী দল, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশ ও জাতীয় দল।


২০০০ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাপা জোট ছাড়লেও নাজিউর রহমান মঞ্জু ও কাজী ফিরোজ রশীদের নেতৃত্বে দলটির একাংশ বিজেপি নামে জোটে থেকে যায়। ১৯ বছর পর বিজেপিও জোট ছেড়ে চলে গেছে।
বিআলো/শিলি

আগে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যায় শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)। প্রয়াত নীলু ওই সময় অভিযোগ করেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত ২০ দলীয় জোটে সব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। ওই সময় অবশ্য এনপিপির একটি অংশ জোটে থেকে যায়।


২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপ ও খন্দকার গোলাম মোর্তুজার নেতৃত্বাধীন এনডিপি জোট থেকে বেরিয়ে যায়। তবে একই নামে এসব সংগঠনের একটি অংশ থেকে যায় ২০ দলীয় জোটে। এরপর জাগপাও এ জোট থেকে চলে গেলে খন্দকার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে একটি অংশ থেকে যায় জোটে।


মূলত ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে এবং ড. কামাল হোসেনকে নেতা মেনে যে নির্বাচন করেছে- তার মধ্য দিয়ে ২০ দলীয় জোট নিস্তব্ধ ও মৃতপ্রায় একটি সংগঠনে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ জোট নেতাদের। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে এ জোটকে কার্যত রাজনৈতিকভাবে অকার্যকরও করা হয়েছে বলে বিবার্তাকে জানান জোটের শরিকরা।


২০ দলীয় জোট ছাড়ার কারণ জানতে চাইলে খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক বলেন, খেলাফত মজলিস ২০ দলীয় জোটে দীর্ঘ ২২ বছর যাবত আছে। ২০১৯ সাল থেকে ২০ দলীয় জোটের দৃশ্যমান রাজনৈতিক তৎপরতা ও কর্মসূচী নেই। ২০১৮ সালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে ২০ দলীয় জোটকে কার্যত ঘুমিয়ে রাখা হয়েছে। ইস্যূভিত্তিক রাজনীতিতে মাঠে সক্রিয় নন ২০ দলীয় জোট। এ ঘুমন্ত জোট দেশ ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারবে না।


২০১৮ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে বের হওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ন্যাপ মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূইয়া বিবার্তাকে বলেন, ড. কামালের নেতৃত্বে যখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হয়, তখনই থেকে বুঝতে পেরেছি রাজনীতির ময়দানে ২০ দলীয় জোটকে আড়াল করা হলো। সেই থেকেই এ জোট মূল্যহীন। তাই জোটে থাকার প্রয়োজন মনে করিনি। বিএনপি বলছে- জোট ছাড়ার পিছনে আপনাদের সরকারি চাপ রয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তফা বলেন, বিএনপি নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এ ধরণের অভিযোগ করছে। রাজপথে কঠোর ও শক্তিশালী আন্দোলন হোক বিএনপি নিজেই চায় কিনা তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
এ প্রসঙ্গে জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)'র একাংশের নেতা শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, যারা জোট ছেড়ে চলে গেছে, তারা নিজেদের স্বার্থেই গেছে। এবং কেউ কেউ প্রচণ্ড চাপেও জোট থেকে চলে গেছেন। যারা জোটে চাপ ও হুমকি সহ্য করে টিকে আছেন তারাসহ অন্য রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য খুবই প্রয়োজন। আর তার অপেক্ষায় আমরাসহ গোটা দেশব্যাপী।


কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মুহাম্মদ ইব্রাহীম বীর প্রতীক এ প্রসঙ্গে বিবার্তাকে বলেন, প্রত্যেকে দল নিজ ইচ্ছায় জোটে আসেন, নিজ ইচ্ছায়ই চলে যান। এটা তাদের নিজস্ব মূল্যায়ন। তারা পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে জোট ত্যাগ করছেন বলে আমি মনে করি।


২০ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষনেতা ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)'র কর্নেল অব. অলি আহমেদ বীর বিক্রম বিবার্তাকে জানান, জোট সৃষ্টি হওয়ার পর প্রতি মাসে মাসে জোটের সভা হওয়ার কথা থাকলে বছরেও একবার হয় না। জোটের ব্যানারে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি হয় না। নিজেদের মাঝে নেই কোনো সমন্বয়, সৃষ্টি হয়েছে দূরত্ব। যার কারণে অনেকেই ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ইচ্ছা পোষণ করছেন বলে আমি মনে করি।


জোট থেকে শরিক দলগুলো চলে যাওয়া প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বিবার্তাকে বলেন, যারা যাচ্ছেন তারাই বলতে পারবেন কেনো যাচ্ছেন। জোটের শীর্ষনেতারা এবং বিএনপির নেতাকর্মীরা অটুট রয়েছেন। মনোবল নিয়ে কাজ করছেন। লোভ-লালসা, মামলা-হামলা মোকাবিলা করে যারা টিকে থাকবেন তারাই জয়লাভ করবে। যাদের নীতি ও আদর্শ আছে, তারা কখনো পরাজিত হয় না।


বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বিবার্তাকে জানান, আমাদের জোট ভাঙ্গা সরকারি চক্রান্তেরই একটি অংশ। আমরা যাতে ঐক্যবদ্ধ না থাকতে পারি, তার জন্য নিজেদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে সরকার। যারা সরকারের এ ফাঁদে পা রাখবেন তারা কালের বিবর্তনে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাবেন।


শরিক দলগুলো কেনো ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবার্তাকে বলেন, এগুলো সরকারের চাপে হচ্ছে। বিভিন্ন প্রলোভন দিচ্ছেন তাদের। এছাড়া মামলা-হামলার হুমকি দিচ্ছেন জোট নেতাদের। এ সরকার চায় না দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা হোক। তাই ভয় প্রদর্শন করে আমাদের জোট থেকে শরিক দলগুলোকে বের করে নিচ্ছে।


বিআলো/শিলি