অবশেষে আলোচিত সেই সুন্দরী ডায়না উদ্ধার
ডায়না আক্তার সুন্দরী ও বহুরূপী লাবণ্যময় এক রহস্যময়ী তরুণী। যার রূপে প্রেমের সাগরে ডুবেই প্রতারিত হচ্ছেন দেশ-বিদেশের অর্ধশতাধিক যুবক। ভয়ঙ্কর সুন্দরী বহুরূপী ডায়নার প্রেমের ফাঁদে পড়ে সৌদি আবর, কাতার, ওমান, দুবাই, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, ইতালি, ইরাক, ইরান ও গ্রিস প্রবাসীসহ দেশে অবস্থানরত বিত্তশালী পরিবারের যুবক আজ নিঃস্ব হয়েছেন।
সেই সুন্দরী ডায়না আক্তারকে ছাতক ও বড়লেখা থানার পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছে। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার ৫নং দক্ষিণ সাহবাজপুর ইউনিয়নের ষাটঘরি গ্রামের মৃত আব্দুল ইয়াবেদ ও শাহানা বেগমের পুত্র সৌদি প্রবাসী আব্দুল জলিলের বাড়ি থেকে গত শনিবার সন্ধ্যায় তাকে উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে তার মায়ের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে।
ডায়না আক্তার রূপকে পুঁজি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সৌদি প্রবাসীদের সঙ্গে খাতির জমাতেন। কখনো আবার সংসারের আর্থিক সংকটসহ নানা কারণ দেখিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। দেশে ফিরলে তাদের সঙ্গে দেখা করতেন নীরবে। একান্তে সময় কাটিয়ে গোপনে ছবি তুলতেন।
পরে সেই অন্তরঙ্গ ছবি দেখিয়ে করতেন বিয়ে। ভয় দেখিয়ে লিখে নিয়েছেন নগদ টাকা-পয়সা। তার পুরো পরিবারের সবাই এ প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। সেই পরিবারটিকে খুঁজে পেয়েছে পুলিশ। বহুরূপী ডায়না আক্তার নানা টালবাহানা করে সুকৌশলে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার এ ঘটনায় দেশ-বিদেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
এ আলোচিত ঘটনার রহস্যময়ী তরুণী হচ্ছে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক শিল্পনগরী উপজেলার জাউয়া বাজার ইউনিয়নের মুলতানপুর গ্রামের ফনা উল্লা ও দিলা বেগমের কন্যা ডায়না আক্তার (৩০)।
জানা যায়, ফনা উল্লা ও দিলা বেগম দম্পতির ৫ মেয়ে ও ৩ ছেলে। ১৫ সদস্যের একটি প্রতারক চক্র গঠন করে ডায়নার বড় বোন সৌদি প্রবাসী গৃহকর্মী রিনা বেগমের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে অনলাইনে ভিডিও কলের মাধ্যমে প্রথমে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রেম করে ১২টি দেশে থাকা অর্ধশতাধিক প্রবাসী যুবক প্রতারিত হয়েছেন।
যুবকদের প্রেম ও বিয়ের ফাঁদে ফেলে অর্থ-লুট, প্রতারণা-ব্ল্যাকমেইল, জালিয়াতি ও নিরীহ লোকদের হয়রানিসহ বিভিন্ন ধরনের নানা অসামাজিক কার্যকলাপের ছাতকে বহুলালোচিত সৌদি প্রবাসী গৃহকমী রিনা বেগম তার স্বামী আলী হোসেন, আপন ভাই ইমাদ উদ্দিন, ছোটবোন রোবেনা ও ডায়না আক্তারের বিরুদ্ধে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেন সৌদি প্রবাসী আব্দুল জলিল।
এসব ঘটনার প্রতারক চক্রের মূল হোতা ও প্রধান সহযোগী সৌদি গৃহকর্মী রিনা বেগম ও তার স্বামী আলী হোসেন। গৃহকর্মী রিনা বেগম ফনা উল্লার ২য় মেয়ে। রিনা বেগমকে একই উপজেলার সিংচাপইড় ইউনিয়নের মামনপুর গ্রামে আলী হোসেনের সঙ্গে বিয়ে দিলেও সে ঘরজামাই হিসেবে ফনা উল্লার বাড়িতেই বসবাস করেন।
বিয়ের কিছুদিন পর আলী হোসেনের স্ত্রী গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে চলে যান। স্ত্রী প্রবাসে থাকার সুযোগে আলী হোসেন তার শ্যালিকা রোবেনা ও ডায়নার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ঘরজামাই আলী হোসেন স্ত্রী প্রবাসে থাকায় স্ত্রীকে ব্যবহার করে সৌদি প্রবাসে বসবাসরত টাকাওয়ালা যুবকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন।
গৃহকর্মী রিনা ও তার স্বামী আলী হোসেনের মূল টার্গেট সম্পদশালী ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী ও প্রবাসী যুবক। প্রথমে টার্গেট নিশ্চিত করে তিনি ধীরে ধীরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে নিজ দেহের সৌন্দর্য ও কথামালার মারপ্যাঁচে আটকে ফেলে টার্গেটকৃত যুবকদের।
২০১৯ সাল থেকে গৃহকর্মী রিনা সৌদি যাওয়ার পর কিছু সংখ্যক প্রবাসী যুবকদের টার্গেট করে তাদের সঙ্গে প্রথমে সে নিজে, পরে তার আপন ছোটবোন রোবেনা ও ডায়না আক্তারকে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং তাদের সঙ্গে ভিডিও কলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে। ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘায়িত হলে ভিডিও কলে ডায়না আক্তার ও রোবেনা তাদের শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গ দেখিয়ে যুবকদের আকৃষ্ট করে।
সুকৌশলে ভিডিও কলের কিছু অংশ স্ত্রিন রেকর্ড ও স্ক্রিনশট রেখে যুবকদের সামাজিকভাবে হেয় করার হুমকি দিয়ে তা অনলাইনে প্রকাশ করার কথা বলে ব্ল্যাকমেইল করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এসব টাকা গৃহকর্মী রিনা ও তার স্বামী আলী হোসেন, রিনার বড়ভাই জয়নাল ও ইমাদ মিলে ডায়না আক্তার ও রোবেনাকে জিম্মি করে তাদের ব্ল্যাকমেইলের টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেন।
গত জুন মাসে প্রথম সপ্তাহে ডায়না আক্তার তার পরিবারের জিম্মিদশা থেকে সুকৌশলে বের হয়ে রাতের আঁধারে পিত্রালয় থেকে পালিয়ে মৌলভীবাজার জেলাধীন বড়লেখা উপজেলার আব্দুল গফুরের ছেলে সৌদি প্রবাসী আব্দুল জলিলের কাছে চলে যান।
এ পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় তার বড়ভাই জয়নাল বাদী হয়ে ছাতক থানায় একটি অপহরণ নাটক সাজিয়ে এলাকার খাদিজা ও সাবানা বেগম নামের দুটি নিরীহ গৃহবধূর নামে একটি অভিযোগ থানায় দায়ের করেন। তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে দেশ-বিদেশের প্রায় অর্ধশতাধিক যুবকের প্রতারণার রহস্যময় ঘটনা বেরিয়ে আসছে।
এ চক্রে প্রতারিত যুবকরা হয়েছেন- মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার সৌদি প্রবাসী আব্দুল জলিল, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার গ্রিস প্রবাসী হাছান তালুকদার, মালয়েশিয়া প্রবাসী আব্দুর রহিম, পর্তুগাল প্রবাসী তুফায়েল আহমদ, কাতার প্রবাসী রুকন উদ্দিন, দুবাই প্রবাসী আলী আকবর, ওমান প্রবাসী নোমান আহমদ, ইতালি প্রবাসী ছাদিকুর রহমান, ইরান প্রবাসী মকবুল আলী, ইরাক প্রবাসী মিছবাহ উদ্দিন ফকিরসহ দেশে-বিদেশের প্রায় অর্ধশতাধিক যুবক। এদের কাছ থেকে বিভিন্ন টালবাহানা দেখিয়ে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে আলী হোসেন-জয়নাল চক্র।
পুলিশ জানায়, সৌদি গৃহকর্মী রিনা বেগম ও তার স্বামী আলী হোসেন, জয়নাল, ইমাদ চক্রের বেপরোয়া তৎপরতা বৃদ্ধির কারণে দেশ-বিদেশের অনেক যুবক প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ডায়না আক্তারের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে সে জানায়, জিম্মিদশা থেকে মুক্তিলাভ ও নিজের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় রাতের আঁধারে নিজগৃহ ত্যাগ করেছেন।
তিনি জানান, তার বোন সৌদি প্রবাসী রিনা বেগমের স্বামী আলী হোসেন প্রায় রাতেই তার রুমে জোরপূর্বক প্রবেশ করে বিভিন্ন টাকাওয়ালা যুবকের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা আনার জন্য বাধ্য করেছে। আমি এ বিষয়ে তাকে মানা করলে তিনি আমাকে এসিড নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারবে এবং তার সঙ্গে রাতে না ঘুমালে আমাকে আমার মা-বাবার সামনে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করত।
ডায়না আক্তার জানান, এসব নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে আর কোনো যুবকের সঙ্গে প্রতারণা না করার উদ্দেশ্যে আমি স্বেচ্ছায় ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছি। কেউ আমাকে অপহরণ করেনি বলে দাবি করেন তিনি।
তাকে ন্যাংটা করে মারপিট করে ইমুর মাধ্যমে সৌদি আরবে একাধিক যুবকের কাছে ছবি দিয়ে প্রথমে প্রেম তারপর বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দুটি সিমে বিকাশের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ডায়না। এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিকার চেয়েছেন ডায়না আক্তার।
একটি ভিডিও রেকর্ডের মাধ্যমে প্রতারণার ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করেছেন ডায়না আক্তার।
এ ব্যাপারে তদন্তকারী কর্মকর্তা এহতেশাম তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মেয়ে নিখোঁজের একটি অভিযোগ নিয়ে সরেজমিন তদন্তকালে জানতে পারি, মেয়েটির সঙ্গে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত একাধিক যুবকের প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্ক নিয়ে একটি ছেলের সঙ্গে সে পালিয়ে গেছে। এ ঘটনায় সন্দেহের তীর বাদীর দিকেই যায়।
এদিকে ডায়না বেগম গত ১৫ জুন নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এফিডেভিট করে তার জন্মতারিখ ২০০১ সালের ১৮ আগস্ট ও ২০ বছর দেখিয়ে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার ৫নং দক্ষিণ সাহবাজপুর ইউনিয়নের ষাটঘরি গ্রামের মৃত আব্দুল ইয়াবেদ ও শাহানা বেগমের পুত্র সৌদি প্রবাসী আব্দুল জলিলকে বিয়ে করেছেন।
এ ব্যাপারে সৌদি প্রবাসী আব্দুল জলিল মোবাইল ফোনে জানান, নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এফিডেভিট করে তাদের বিয়ে হয়েছে। ডায়না বেগম আমার বিবাহিত স্ত্রী। তার পরিবারের মারপিট সইতে না পেরে গত ৩০ মে ঘর ছেড়ে আমার বাড়ির ঠিকানায় স্বেচ্ছায় চলে আসে ডায়না বেগম।
এ ব্যাপারে অফিসার ইনচার্জ শেখ নাজিম উদ্দিন সুন্দরী ডায়না বেগম উদ্ধারের ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, তার পরিবারের তথ্য বিবরণী মোতাবেক ডায়নার বয়স বিবাহের বয়সের ১৮ দিন কম থাকায় বিবাহ সঠিক নয়। তাই তাকে তার মায়ের জিম্মায় দেয়া হয়।