আসছে স্মার্টগ্লাসের যুগ
বিআলো ডেস্ক: স্মার্ট ঘড়ি ও স্মার্ট আংটির পর পরিধানযোগ্য নতুন প্রযুক্তি স্মার্ট চশমা। এবারের সিইএসে বিভিন্ন ধরনের স্মার্টগ্লাস প্রদর্শন করেছে বেশ কিছু নির্মাতা। প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের ধারণা, এ বছরই মূলধারায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে স্মার্টগ্লাস।
এসব ডিভাইস কেমন হতে পারে?
প্রায় দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করে যাচ্ছে চশমার মধ্যেই নানাবিধ প্রযুক্তি যুক্ত করার। বেশ কয়েকটি মডেল এনেও স্মার্টগ্লাস জনপ্রিয় করতে পারেনি গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো টেক জায়ান্ট। এসব ডিভাইসের সীমাবদ্ধতাও ছিল—দুর্বল প্রসেসর, মানহীন ডিসপ্লে ও স্বল্প ব্যাটারিলাইফ। সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তিতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, তাই স্মার্টগ্লাস তৈরিতে আবারও আগ্রহী হয়ে উঠেছে নির্মাতারা। সর্বসাধরণের কাছে স্মার্টগ্লাস একেবারেই নতুন ধরনের পণ্য। তাই এতে কী ধরনের ফিচার থাকা চাই সে বিষয়ে নির্মাতাদের মধ্যে আছে বড়সড় মতপার্থক্য।
কিছু ব্র্যান্ড কাজ করছে ক্যামেরাযুক্ত ‘ভ্লগিং’ স্মার্টগ্লাস তৈরিতে, অন্য নির্মাতারা বাজারে আনছে উচ্চমানের ডিসপ্লেযুক্ত চশমা। এ মুহূর্তে অন্তত তিন ধরনের স্মার্টগ্লাস তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। চশমার মধ্যে অতিরিক্ত প্রযুক্তি না বসিয়ে, বরং দৃষ্টিনন্দন ডিজাইনের স্মার্টগ্লাস তৈরির চেষ্টা করছে কিছু নির্মাতা। তাদের দাবি, ‘স্মার্ট’ মানেই ডিভাইসে ইন্টারনেট সংযোগ বা এআই নয়। এ স্মার্টগ্লাসগুলো দেখতে সাধারণ চশমার মতো, চারপাশের মানুষ চট করে বুঝতেও পারবে না সেটির কোনো বিশেষত্ব আছে কি না। ক্যামেলোর তৈরি স্মার্টগ্লাস ফ্যাশনেবল চশমার মতোই দেখতে। তবে সেটির ফ্রেমে আঙুলের এক ছোঁয়ায় বদলে যাবে লেন্সের রং।
ইলেকট্রোক্রোমাটিক প্রযুক্তির লেন্সগুলোর মধ্যে আছে লিকুইড ক্রিস্টাল। অল্প পরিমাণ বিদ্যুৎ সঞ্চালন করলেই সেটির রং বদলে যায়। ব্যবহারকারীরা ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন ক্যামেলোর সানগ্লাস কতটা স্বচ্ছ বা টিন্টেড হবে। দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য তৈরি চশমার লেন্সের রংও একইভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। হিয়ারিং এইড হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে, এমন স্মার্টগ্লাস তৈরি করেছে এসিলর-লাক্সোটিকা। ডিভাইসটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘নুয়ান্স অডিও’। মেডিক্যাল গ্রেড হিয়ারিং এইড হিসেবে কাজ করবে চশমার বডিতে থাকা ছোট স্পিকার। পাশাপাশি নয়েজ ক্যান্সেলিংয়ের কাজও করতে সক্ষম এটি।
ফ্যাশনসচেতনরাও যাতে স্মার্টগ্লাস পরায় উৎসাহী হন সেটাই এ দুটি ডিভাইসের লক্ষ্য। কারণ ব্যবসায়িকভাবে সফল করতে হলে স্মার্টগ্লাসকে শুধু প্রযুক্তিপ্রেমীদের মধ্যে জনপ্রিয় হলেই চলবে না।
রে-ব্যান ও মেটা যৌথভাবে তৈরি করেছে ‘মেটা ওয়েফেরার’। স্মার্টগ্লাসটি বেশ কিছুদিন ধরেই বাজারে আছে, ধীরে ধীরে তার জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। এর মধ্যে আছে স্পিকার, মাইক্রোফোন ও ক্যামেরা। ভয়েস কমান্ড দিয়ে ব্যবহারকারীরা তাঁদের চারপাশের দৃশ্য ধারণ করতে পারবেন, পাশাপাশি বিভিন্ন তথ্য জানার জন্য মেটা এআইকে প্রশ্নও করতে পারবেন। ডিভাইসগুলো দেখতে অনেকটা সাধারন চশমার মতো, তবে এটির ফ্রেমে বসানো ক্যামেরা সহজেই বোঝা যায়। আর সেখানেই যত বিপত্তির শুরু। অনেকে এর মধ্যেই এই স্মার্টগ্লাসের বিরুদ্ধে প্রাইভেসির সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে এর মধ্যেই দেওয়া হয়েছে স্মার্টগ্লাস ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা। স্ন্যাপচ্যাটও ক্যামেরা গ্লাস এনেছিল, তবে সমালোচনার মুখে দ্রুতই সেই প্রজেক্ট বাদ দিয়েছে তারা।
স্মার্টগ্লাসে উচ্চ রেজল্যুশনের ডিসপ্লে বসিয়ে সেটি পরিধানযোগ্য মনিটরে পরিণত করেছে নির্মাতা এক্সরিয়েল। স্মার্টগ্লাসটির সঙ্গে পিসি, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট অথবা স্মার্টফোন সংযোগ করে প্রশস্ত মনিটর হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যারা অনেক ভ্রমণ করেন, এই ডিভাইসগুলো তাঁদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়। দেখতে অনেকটা সানগ্লাসের মতো হলেও এটি পরা অবস্থায় চারপাশের কিছু দেখা যাবে না। ফলে এক্সরিয়েলের এই স্মার্টগ্লাস পরে চলাফেরা করা প্রায় অসম্ভব।
স্বচ্ছ গ্লাসের মধ্যেই ডিসপ্লে বসিয়ে স্মার্টগ্লাস তৈরি করেছে নির্মাতা ভিউজিক্স। তাদের জেড১০০ মডেলটি দেখতে মোটাসোটা সানগ্লাসের মতো, এটির মধ্যেই আছে ডিসপ্লে। স্মার্টফোনের সঙ্গে তারহীনভাবে সংযুক্ত করে ফোনের বিভিন্ন তথ্য ডিভাইসটিতে দেখা যাবে। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র, যেমন নির্মাণ অথবা ডেলিভারিতে ব্যবহৃত হতে পারে এ ধরনের স্মার্টগ্লাস। তবে ভিউজিক্স আপাতত স্বচ্ছ ডিসপ্লে প্রযুক্তি তৈরিতেই মনোযোগ দিচ্ছে বেশি।
হ্যালিডে এবং শারগি—দুটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানই চেষ্টা করছে স্মার্টগ্লাসের মধ্যে কম্পিউটিং এবং এআই প্রযুক্তি দেওয়ার। দুটি প্রতিষ্ঠানের ডিভাইসেই আছে স্বচ্ছ লেন্সের মধ্যে বসানো ডিসপ্লে। ওয়েভগাইড প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি সেসব ডিসপ্লে চশমার ফ্রেম ও গ্লাসের মধ্যেই মিশে যায়, গুগল গ্লাসের মতো আলাদা প্রজেক্টর সিস্টেম ব্যবহার করে কাজ করে না। এ দুই নির্মাতার তৈরি স্মার্টগ্লাসে আছে ক্যামেরার মাধ্যমে দৃশ্য ধারণ এবং সে বিষয়ে চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথোপকথনের ফিচার। তবে এগুলো দেখতে বড়সড় ওয়েলডিং গগলসের মতো হওয়ায় ব্যবহারকারীদের মধ্যে সহসাই জনপ্রিয় হচ্ছে না। এ ধরণের স্মার্টগ্লাসের কিছু মডেলে ব্যবহৃত ব্যাটারি চশমার ফ্রেম থেকে আলাদা, সেটি লম্বা তারের মাধ্যমে চশমার সঙ্গে সংযুক্ত করতে হয়। বিশ্লেষকদের ধারণা, এরূপ স্মার্টগ্লাস ভবিষ্যতেও জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা কম।
কেমন স্মার্টগ্লাস জনপ্রিয় হতে পারে শুধু ফিচারের জোরেই স্মার্টওয়াচ বা স্মার্টফোন জনপ্রিয়তা পায়নি। দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন এবং ব্যবহার সহজ হওয়ায় সাধারণ জনগণ ব্যবহার শুরু করেছে এসব ডিভাইস। স্মার্টগ্লাসের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটবে। ক্যামেরাযুক্ত স্মার্টগ্লাস সম্ভবত তেমন জনপ্রিয় হবে না। দ্রুতই ব্যবহারকারীদের মন জয় করবে স্পিকার ও স্বচ্ছ ডিসপ্লেযুক্ত স্মার্টগ্লাস। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ব্যাটারির ধারণক্ষমতা। প্রতি রাতে চশমা চার্জ দেওয়া মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়—এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ক্যামেলোর মতো ইলেকট্রোক্রোমাটিক গ্লাসযুক্ত চশমাই হয়তো শুরুতে ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করবে। তবে ভবিষ্যতে কোন ফিচারগুলো জনপ্রিয় হবে—সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। স্মার্টগ্লাসের যুগ আসছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, সেটা শুরু হতে পারে এ বছরই।
বিআলো/শিলি