আসুন বাল্যবিয়ে কে না বলি: মন্তব্য প্রতিবেদন
“আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ এখন ভয়ংকর রুপ ধারন করেছে। মিডিয়াতে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কতোটা মর্মান্তিক হতে পারে এর কুফল।
বাস্তব গল্প দিয়েই শুরু করতে চাই। রহিমা (ছদ্ম নাম) ৭ম শ্রেণীতে পড়া ছোট একটি মেয়ে। নিশ্চয়ই রহিমাকে ছোট্ট একটি ফুলের সাথে তুলনা করতে পারি আমরা। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় মেয়ে সে। গ্রামের নিতান্ত গরিব ঘরের সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠেছে রহিমা। মহল্লায় অবস্থিত উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে রহিমা (ছদ্মনাম) কোনো দিন স্কুল ফাঁকি দেয় না সে। স্কুলের শিক্ষকরা বলছেন পড়ালেখার প্রতি অনেক আগ্রহ আছে তার। কিন্তু হঠাৎ সমস্যা হয়ে গেলো মেয়েটির জীবনে।তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো অথচ এ বিষয়ে সে বিন্দুমাত্র জানেই না। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো বিয়ের মতো জীবনের একটি মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার মতামত জানা হলো না। এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে আমাদের দেশে। বিয়ের কয়েক মাস যেতেই শুরু হলো মেয়েটির ওপর তার স্বামীর চরম নির্মম অত্যাচার। দুই বছর টিকলো এই অত্যাচার। অতঃপর মারা গেলো রহিমা নামে মেয়েটি। গণমাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে এমন ঘটনা নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতিবেদন তৈরি করছি আমরা। কিন্তু কেনো এ ধরনের অমানবিক কাজ চলতে থাকবে? এগুলো কি আমরা সুস্থ মস্তিষ্কে মেনে নিতে পারি?
বাল্যবিবাহ শুধু একটি সামাজিক ব্যাধিই নয় বরং একটি অভিশাপও বটে। এর মাধ্যমে ঘটে একটি শৈশবের অপমৃত্যু। মফস্বলসহ শহরের অলিতে গলিতে আমরা এই সামাজিক ব্যাধি দেখতে পাচ্ছি অহরহ। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমরা নিজেদেরকে উন্নত সমাজের অংশীদার দাবী করলেও কিছু কিছু পরিবারের মধ্যে কন্যা সন্তানদেরকে সমান সুযোগ দিচ্ছি না।এমন আধুনিক যুগেও কন্যা সন্তান হওয়া মানেই যেনো মস্ত বড় অপরাধ। তার বড় হওয়া থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যেন একটা পরীক্ষা ক্ষেত্র। আর এই পরীক্ষা ক্ষেত্রের আরও একটি বিশেষ পরীক্ষা হল ‘বিয়ে’। আর তা যদি হয় বাল্যবিবাহ তাহলে তো কথাই নেই। কিছু পরিবার নিজেদের বোঝা মুক্ত করার জন্য অপরিপক্ক বয়সে কন্যাকে অন্যের ঘরে পাঠিয়ে দেয়। একটা ১৩-১৭ বছরের মেয়ে কেমন করে একটা পরিবারের দায়িত্ব হাতে নেবে, কিভাবে মানিয়ে নেবে অন্য পরিবেশের সাথে, কিভাবে অপটু হাতে ঘরকন্যার কাজ সামলাবে? এটা মূলত তারা এডজাস্ট ( মানিয়ে নিতে) করতে পারে না। গ্রামীণ কিছু পরিবারের কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালে মনে হয় কন্যা সন্তানকে বিদায় করতে পারলেই যেন তারা বাঁচেন। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বড়ই অভাব রয়েছে। ধর্মের নামে অপব্যাখ্যা দিয়ে অনেকেই বাল্য বিবাহ কে সহজ করে তুলতে চান। অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলতে চাই যে এগুলো মোটেও সঠিক কথা বা থিউরী নয়। যে বয়সে একটা মেয়ের স্কুলে যাওয়ার কথা, সহপাঠীদের সঙ্গে খেলার কথা, সে বয়সে সে প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে। অকাল মৃত্যুতে ঝরে পড়ছে। বাল্য বিয়ের কারণে মেয়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। বাস্তব চিত্র দেখলে বুঝা যায় অপ্রাপ্তবয়সে বিয়ে মাঝেমধ্যে আত্মহত্যারও প্রধান কারণ হয়ে ওঠে।
অবচেতন মনে আমরা কেউ কেউ এই সামাজিক ভয়ংকর ব্যাধিটাকে সমর্থন করি। যেমন, প্রতিবেশী একটা মেয়ের বাল্য বিয়ে হচ্ছে। পারস্পরিক সুসম্পর্কের খাতিরে আমরা পুলিশে খবর দিতে পারছি না বা না করতে পারছি না। অথচ বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আমাদের সকলের সংঘবদ্ধ ভাবে কাজ করা উচিত। তবে আশার দিক হলো যে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন এনজিও এবং সংগঠনগুলো বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে কাজ করছে। আমাদের উচিত, ‘বাল্যবিয়েকে না বলা’ এই স্লোগানে সবার মনের মধ্যে স্থাপন করা ও সময়োপযোগী পন্থায় সচেতনতা সৃষ্টি করা।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কথা মনে আছে সবার? ব্যাঙ্গাত্মক ও কটাক্ষময় ছড়া তিনি তৈরী করতেন প্রায়শই মনের দুঃখে। যার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক ব্যাধিকে নিরুৎসাহিত করেছেন। তবে আফসোস একবিংশ শতাব্দীতেও এসে বাল্যবিয়ের মতো মারাত্মক সামাজিক ব্যাধির রেশটা বেশ জোরালোভাবেই রয়ে গেছে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাল্যবিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে এবং বিশ্বে পঞ্চম। বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতিতে ২০২৩ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০০৬ থেকে ২০২২ সালে বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ এবং ১৫ বা তার কম বয়সের আগেই ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। আমাদের সমাজব্যবস্থায় বাল্যবিয়ের অধিকাংশ কারণগুলো হচ্ছে- দারিদ্র্য, সচেতনতার অভাব, প্রচলিত প্রথা ও কুসংস্কার, সামাজিক অস্থিরতা, মেয়েশিশুর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, নিরাপত্তার অভাব, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, যৌতুক প্রথা এবং বাল্যবিয়ে রোধ-সংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া।
ইউএনএফপিএর তথ্য মোতাবেক, যে সকল কারণ বাল্যবিবাহের জন্য দায়ী তার মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা; লিঙ্গ বৈষম্য; জমি-জমা বা সম্পদের চুক্তি; পরিবারের সম্মান রক্ষা; প্রচলিত প্রথা বা চর্চা; এবং নিরাপত্তাহীনতা, বিশেষত যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ বা মহামারীর সময়। অন্যান্য কারণসমূহের মধ্যে আছে- বিয়ের মাধ্যমে দুই পরিবারের মধ্যে শক্তিশালী বন্ধন গড়ে তোলা।
বিভিন্ন কারণেই বাল্যবিবাহের প্রচলন অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- দারিদ্রতা, নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণসমূহ। এখনও উন্নয়নশীল দেশসমূহ যেমন: আফ্রিকার কিছু অংশ ,দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া,লাতিন আমেরিকা এবং ওশেনিয়া প্রভৃতি দেশে বাল্যবিবাহ বহুল প্রচলিত। ভয়ংকর চিত্র হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও আইনী ব্যতিক্রম থাকার কারনে ১৭ টি রাজ্যে ন্যূনতম বয়সের প্রয়োজন নেই। নাইজার, চাদ, মালি, ভারত, বাংলাদেশ, গিনি ও মধ্য আফ্রিকার কিছু দেশে বাল্যবিবাহের হার সবচাইতে বেশি। যা প্রায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৬০% এর উপর। ২০০৩-২০০৯ জরিপ অনুযায়ী, নাইজার, চাদ, বাংলাদেশ, মালি এবং ইথিওপিয়াতে ১৫ বছরের নিচে শিশুদের বাল্যবিবাহের হার ২০% এর উপর।
এই চিত্র সচেতনভাবে বিশ্লেষন করলে বুঝা যায় আমাদের দেশে বাল্যবিয়ের কারণে অপরিণত বয়সে সন্তান ধারণ, মাতৃমৃত্যুর হার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যহানি, তালাক, পতিতাবৃত্তি, অপরিপক্ব সন্তান প্রসবসহ নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন করতে হবে। এই সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও আন্দোলনটা শুরু করতে হবে আমাদের পরিবার থেকেই। এছাড়াও মেয়েদের নিরাপদ পথচলা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল, রাস্তাঘাট ও গণপরিবহনকে নারীবান্ধব ও যৌন হয়রানিমুক্ত করতে হবে। যৌতুক নিরোধ আইনে সাজার পরিমাণ বাড়িয়ে আইনকে যুগোপযোগী করার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তা দ্রুত বাস্তবায়ন চাই। তাছাড়াও বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, ২০১৭ ও বাল্যবিয়ে নিরোধ বিধিমালা-এর বাস্তব প্রয়োগে সংশ্লিষ্টরা সঠিক দায়িত্ব পালন করবেন বলে বিশ্বাস করি।
রাকিব হোসেন মিলন
লেখক ও সাংবাদিক
বিআলো/তুরাগ