ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান ও পূর্ব আজারবাইজানের গভর্নর মালেক রহমাতি মারা গেছেন।
ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহতের ঘটনায় ইরানজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তবে জনগণকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি।
তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিদ্ধস্তের ঘটনায় ইরানের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৃত্যুর ঘটনায় শোক জানিয়েছে ভারত, রাশিয়া, ভেনিজুয়েলাসহ অন্যান্য দেশ।
সোমবার (১০ মে) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এ খবর জানিয়েছে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে দেখা হতো। তার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ শিয়া আল-সুদানি। এক বিবৃতিতে তিনি জানিয়েছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিমান দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তাদের সঙ্গীদের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছি।
দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি, তার সরকার ও জনগণের প্রতি আমাদের আন্তরিক সমবেদনা ও সহানুভূতি প্রকাশ করছি। ইরানের সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর সমবেদনা ও সংহতি জানিয়েছে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। গভীর শোক জানিয়েছেন ইয়েমেনের হুথি সুপ্রিম রেভোলুশনারি কমিটির প্রধান মোহাম্মদ আলী আল-হুথি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেছেন, ইরানের জনগণ, তাদের নেতৃত্ব ও রাইসি ও তার নিহত সহযোদ্ধাদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। তাদের পরিবারকে ধৈর্য ও সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা করি।
নিহতদের প্রতি গভীর শোক জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেয়া এক পোস্টে তিনি বলেছেন, ইরানের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত এবং মর্মাহত। ভারত-ইরান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করার জন্য তাঁর অবদান সর্বদা স্মরণ করা হবে। ভারত এই দুঃখের সময়ে ইরানের পাশে আছে।
ইরান ও দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ভেনিজুয়েলার নিঃশর্ত বন্ধু ছিলেন রাইসি। মস্কোয় ইরানের রাষ্ট্রদূত কাজেম জালালির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
এছাড়াও ইরানের প্রেসিডেন্ট ও রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বিশ্ব নেতারা।
উল্লেখ্য, রবিবার আজারবাইজান সীমান্তবর্তী এলাকায় একটি প্রকল্প উদ্বোধনের পর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহর তাবরিজে ফিরছিলেন রাইসি এবং তার সফরসঙ্গীরা। ঘন কুয়াশার মধ্যে হেলিকপ্টারটি পার্বত্যাঞ্চলে দুর্ঘটনায় পড়ে। এরপর ৪০ জনের বেশি উদ্ধারকর্মী, অনুসন্ধানী কুকুর এবং ড্রোন দিয়ে শুরু হয় বড় ধরনের উদ্ধার অভিযান। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কুয়াশার মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে উদ্ধারকর্মীদের বেগ পেতে হয়।
পরে সোমবার সকালে উদ্ধার অভিযানে যোগ দেয়া একটি তুর্কি ড্রোন ‘হিট সোর্স’ শনাক্ত করলে দুর্ঘটনাস্থলের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু পাহাড়ের উপরে হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার পর ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রধান রহোসেইন কোলিভান্দ বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে প্রাণের কোনো চিহ্ন মেলেনি।
পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শোনা যাচ্ছে মোহাম্মদ মোখবারের নাম। রয়টার্সের খবরে ইরানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার বরাতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ইরানের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও রাইসির নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি।
এ ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে। প্রথমত, ইরানের রাজনীতিতে কী হবে? দ্বিতীয়ত, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবেন? উত্তর খুঁজতে গিয়ে যে নাম সবার আগে উচ্চারিত হচ্ছে, তিনি মোহাম্মদ মোখবার। ইরানের বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি।
ইরানের সংবিধানে বলা আছে, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট মারা গেলে বা কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে সক্ষম না হলে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। পরবর্তী ৫০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে এবং নতুন প্রেসিডেন্ট বেছে নিতে হবে। নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সামলাবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট।
তবে যিনিই নতুন প্রেসিডেন্ট হন না কেন, তাঁকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার অনুমোদন নিতে হবে। ইরানে রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে ভূমিকা পালন করেন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনি। ক্ষমতাকাঠামোয় এরপরই রয়েছেন প্রেসিডেন্ট। তাকে সরকারের প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাইসি নিহত হওয়ায় খামেনির অনুমোদন সাপেক্ষে বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবারের ইরানের পরবর্তী কাণ্ডারি হওয়ার পথ খুলে গেছে বলা যায়।
আগে ইরানে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছিল। ১৯৮৯ সালে তা বিলুপ্ত করা হয়। সরকারে প্রেসিডেন্টের পরবর্তী পদে বসানো হয় একজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে। তবে প্রেসিডেন্টের মতো এই পদ নির্বাচিত নয়। ভাইস প্রেসিডেন্টকে নিয়োগ দেয়া হয়।
২০২১ সালের আগস্টে ইরানের প্রেসিডেন্ট হন ইব্রাহিম রাইসি। এর পরপরই খামেনির অনুমতি সাপেক্ষে মোহাম্মদ মোখবারকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ দেয়া হয়। সংবিধান সংশোধনের পরবর্তী সময়ে ইরানের সপ্তম ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন
মোহাম্মদ মোখবার। ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে মোহাম্মদ মোখবার ইরানের সিতাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে টানা ১৪ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এটা ইরানের অন্যতম শক্তিশালী একটি অর্থনৈতিক কনগ্লোমারেট (একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অধীন থাকা বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী)। মূলত দাতব্যকাজের জন্য এ প্রতিষ্ঠান বিশেষভাবে পরিচিত। সর্বোচ্চ নেতার সরাসরি তত্ত্বাবধানে এটা পরিচালিত হয়।
মোহাম্মদ মোখবারের নজরদারিতে সিতাদ করোনার নিজস্ব টিকা ‘কোভিরান বারেকাত’ তৈরির কাজ এগিয়ে নিয়েছিল। যদিও এই টিকার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা গেছে, এই টিকা নেয়ার পর অনেকেই জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগেছেন।
একসময় ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের গভর্নর ছিলেন মোহাম্মদ মোখবার।
রবিবার আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের যৌথভাবে নির্মিত একটি বাঁধ উদ্বোধন করতে যান প্রেসিডেন্ট রাইসি। সেখানে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভও ছিলেন। সেখান থেকে ৩টি হেলিকপ্টারের বহর নিয়ে ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী তাবরিজে ফিরছিলেন রাইসি ও তার সঙ্গে থাকা অন্য কর্মকর্তারা।
পথে পূর্ব আজারবাইজানের জোলফা এলাকার কাছে দুর্গম পাহাড়ে প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বহনকারী বেল-২১২ মডেলের হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। হেলিকপ্টারটি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। অন্য দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছায়।
রাইসিকে বেল-২১২ মডেলের একটি হেলিকপ্টার বহন করছিল। এই মডেলটি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি। তার সফর সঙ্গি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদোল্লাহিয়ানসহ বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের সব আরোহী নিহত হয়েছেন।
কারা ছিলেন ওই হেলিকপ্টারে? সোমবার এক প্রতিবেদনে তাদের পরিচয় জানিয়েছে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি। ওই হেলিকপ্টারে তার সঙ্গে ছিলেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তাদের মৃত্যুর বিষয়টিও নিশ্চিত করেছে
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম।
২০২১ সাল থেকে ইরানের পররাষ্টমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান। গাজা যুদ্ধ ঘিরে গত কয়েক মাসে ইরানের কূটনৈতিক তৎপরতায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ৬০ বছর বয়সী আব্দোল্লাহিয়ান। পশ্চিমা দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আসছিলেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক হিসেবে কয়েক দশক ধরে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলেছেন আব্দোল্লাহিয়ান। তবে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর আইআরজিসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার কারণে তিনি সমধিক পরিচিত।
ওই হেলিকপ্টারে ছিলেন আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনির প্রতিনিধি ও তাবরিজের ইমাম সৈয়দ মোহাম্মদ আলি আলে হাশেম। পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের ভ্যালি-ই ফকিহের প্রতিনিধিও ছিলেন তিনি।
এছাড়া পূর্ব আজারবাইজানের গভর্নর মালিক রাহমাতিও নিহত হয়েছে। তার সঙ্গে ছিলেন প্রেসিডেন্ট প্রোটেকশন ইউনিটের কমান্ডার সরদার সৈয়েদ মেহদি মৌসভি। এছাড়াও কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী এবং ক্রু ছিলেন। দুর্ঘটনায় তারা সবাই নিহত হয়েছেন।
রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষের ছবি-ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে। ড্রোনে ধারণ করা ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ প্রকাশ করেছেন আল-জাজিরার সাংবাদিক আলি হাশেম। এছাড়া ইরানের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল প্রেস টিভি এই ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেছে।
সোমবার প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটি পিছনের অংশ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই।
এদিকে প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর পর আগামী ৫০ দিনের মধ্যে ইরানে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধান অনুসারে, অন্তবর্তী সময়ে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মোখবের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
বিআলো/শিলি