কবি ফররুখ আহমদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে অধ্যাপক আবদুল খালেক এম, এ (র.)’র ভূমিকা ও অবদান
মুসলিম নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ; একাধারে ছিলেন কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। ইসলামী চিন্তা-চেতনার অত্যধিক প্রভাব আর প্রচুর আরবি ও ফারসি শব্দমালার ব্যবহার ছিল ফররুখ রচনাবলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাহিত্যকর্মে মুসলিম পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা ও ইসলামী চিন্তা-চেতনার বাহক হলেও কাব্যকৌশল, শব্দচয়ন ও বাক্যশৈলী ছিল অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আরবি, ফারসি ও আধুনিক বাংলার বহুমাত্রিক ব্যবহারে প্রণীত অনবদ্ধ রচনাশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে ফররুখ আহমদকে মূল্যায়ন করেছেন। কেউ ‘ইসলামী রেনেসাঁর কবি’ আবার কেউ ‘মুসলিম নবজাগরণের কবি’ কেউ ‘মানবতাবাদী কবি’ শিরোনামে চিত্রায়িত করেছেন। যে মানুষটি কবির ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন তিনি হলেন, অধ্যাপক মাওলানা আব্দুল খালেক এম,এ ছতুরবী (র.)। তিনি ভারতের ফুরফুরা দরবার শরীফের দাদাপীর মুজাদ্দেদে জামান হজরত মাওলানা আবুবকর সিদ্দিকি ফুরফুরাবী (র.)-এর খলিফা ছিলেন। জন্ম ১৮৯২ সালে। জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার ধরখার ইউনিয়নের ছতুরা গ্রামে। তিনি একাধারে ছিলেন, শিক্ষাবিদ, সুদক্ষ প্রশাসক, সুফিতত্ত্ববিদ, রাজনীতিবিদ, গ্রন্থ প্রণেতা ও বাংলার অমর কলম সম্রাট। তিনি সুদীর্ঘকাল একাধিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ছিলেন- (১) ফেনী কলেজের ফারসি বিভাগের অধ্যাপক এবং ইসলামিয়া হোস্টেলের সুপারিনটেডেন্ট, (২) কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক এবং অধ্যক্ষ, (৩) কলকাতা লেডি ব্র্যার্বোন কলেজের অধ্যাপক এবং কলকাতা টেইলর হোস্টেলের সুপারিনটেডেন্ট, (৪) ঢাকা বদরুন্নেছা সরকারি কলেজের অধ্যাপক, (৫) ইডেন সরকারি গালর্স কলেজের উপাধ্যক্ষ। তিনি আবার ‘তালীমাত-ই ইসলামিয়া’ পাকিস্তানের আইন পরিষদ বোর্ডের সদস্যও ছিলেন। এ পরিষদটি ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় এবং পরিষদটির কার্যক্রম ৪ বছর স্থায়িত্ব ছিলো। অধ্যাপক আবদুল খালেক (র.)- ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দক্ষিণ-পূর্ব আসনের সংসদ সদস্যও ছিলেন। কবি ফররুখের মেয়ের নাম সাইয়েদা ইয়াসমিন বানু। কবি তনয়া সাইয়েদা ইয়াসমিন বানু বলেছেন, ‘প্রথম জীবনে আব্বা ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত মানবতাবাদী কমরেড এম. এন. রায়ের শিষ্য। যিনি আটটি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। আব্বার জীবনে এক অচিন্তনীয় পরিবর্তনের মূলে যে মহান আউলিয়ার দোয়া ছিল, তিনি হচ্ছেন আব্বার পীর মরহুম অধ্যাপক আবদুল খালেক-তৎকালীন যুগে ইংরেজি এবং আরবিতে এম. এ. ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট (গোল্ড মেডালিস্ট)। বহু বিতর্কের মাধ্যমে আব্বাকে পরাস্ত করে সেদিন তিনি আব্বাকে বুঝিয়েছেন যে, ইসলামই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা, যেখানে মানুষের জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় প্রকার সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান রয়েছে’। কামরুল হাসান নামের একজন ফররুখ আহমদের ছোট ভাই মুশীর আহমদের সহপাঠী তার ‘ফররুখ ভাই’ স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘সে বোধহয় ১৯৩৫ সালের কথা। তখন স্বদেশী আন্দোলনের রেশ। আমরা কেবল এটা-ওটা শুনি আর থ্রিল অনুভব করি। এমনি একদিন মুশীর সন্ধ্যাবেলা আমাদের বেনে পুকুরের বাড়িতে এসে, যেন সাংঘাতিক একটা ঘটনা এমনি ভাব নিয়ে, অতি গোপনে আমাকে ডেকে বলল, জানিস ফররুখ ভাই কম্যুনিস্ট হয়ে গেছে।’ ১৯৩৭ সালে; অর্থাৎ সাহিত্য-জীবনের সূচনালগ্নে তিনি কম্যুনিস্ট আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। কবিকন্যা এবং তার ছোট ভাইয়ের সহপাঠীর স্মৃতিচারণ থেকে নির্গত বিধায় এ তথ্যটি সম্পর্কে সন্দেহ পোষণের কারণ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কিভাবে এ মতাদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইসলামী মতাদর্শে দীক্ষিত হলেন? সাইয়েদুল মুরসালীন’র ভাষা পরিমার্জনায় কবি ফররুখ আহমদ সরাসরি সহায়তা করেছিলেন। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ফররুখ আহমদ রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকায় আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন, ‘কবি-সমালোচক সৈয়দ আলী আহসানের মুখে শুনেছি, মওলানা আবদুল খালেকের বিখ্যাত রসুল (সা.)-চরিত সাইয়েদুল মুরসালীন গ্রন্থ ফররুখ আহমদের হস্তাবলেপ ছিল।’ প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৪৫ সালে। তখনকার স্মৃতিস্মরণে তিনি বলেন, ‘এ সময়ে ফররুখ ভাই দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছিলেন। তার সম্পূর্ণ ব্যক্তিসত্তাই তখন ভেঙেচুরে এক নতুন রূপ নিতে চলেছে। এক কথায় তখন তার ‘কনভার্সন’-এর শেষ পর্যায়। ‘কনভার্সন’ একটি আত্মিক প্রক্রিয়া, এর কোনো বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই। আমি এই প্রক্রিয়া সম্বন্ধে শুনেছি ও পড়েছি; তবে অভিজ্ঞতা হিসেবে এটা এতই দূরবর্তী যে, এ বিষয়ে আমি কথা বলতে সংকোচ বোধ করি। যিনি ফররুখ ভাইয়ের এই ‘কনভার্সনের’ মুখ্য পুরুষ, সেই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিটি মাওলানা আবদুল খালেক; ঘটনাচক্রে আমাদের টেইলর হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। তার পরিচয় হিসেবে এটা একেবারেই তুচ্ছ। তিনি অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন। তখন কোনো একটা গ্রন্থ রচনায় ব্যস্ত ছিলেন এবং তাকে ভাষার পরিমার্জনায় সাহায্য করছিলেন ফররুখ ভাই। এ উপলক্ষে তাকে মাঝে মধ্যে টেইলর হোস্টেলে আসতে দেখেছি এবং সবসময় তার মধ্যে একটা অস্থিরতা লক্ষ্য করেছি।’ কম্যুনিস্ট আদর্শকে তালাক দিয়ে ইসলামের আধ্যাত্মিক ধারা অর্থাৎ সুফিধারায় যে ফররুখ আহমদ অধ্যাপক আবদুল খালেকের মাধ্যমেই পূর্ণোদ্যমে প্রবেশ করলেন তা উপর্যুক্ত জবানবন্দি থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে। কবিতনয়ার স্মৃতিচারণের একটি খণ্ড এখানে অনিবার্য উল্লেখ্য, ‘যিনি প্রথম জীবনে সরাব এবং কাবাবের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন, কিভাবে পরবর্তী জীবনে আবার তিনিই হলেন সাধক। এই বিস্ময়কর এবং অনিন্দ্যসুন্দর কাহিনি বলবার সময় আব্বার গভীর চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়তো।’ কবি তার সিরাজুম মুনীরা কাব্যগ্রন্থ তার মুর্শিদ পীর প্রফেসর আবদুল খালেক সাহেবকে (র.) উৎসর্গিত করেন। মোদ্দা কথা হলো, কবি ফররুখ আহমদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তনের অন্যতম কারিগর ছিলেন অধ্যাপক মাওলানা আবদুল খালেক এম,এ ছতুরবী (র.)।
লেখক: কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী
(গবেষক ও ব্যাংকার)
বিআলো/তুরাগ