গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে দেশেই আছেন মতিউর
নিজস্ব প্রতিবেদক: সম্প্রতি ১৫ লাখ টাকায় ছেলের ছাগল কেনা নিয়ে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি পদ হারানো ড. মতিউর রহমান গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে দেশেই আছেন! তিনি রাজধানীতে নিজ বাসায় অবস্থান করছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন। মতিউর রহমান শুধু দেশেই আছেন তা নয়। তাকে সংযুক্তি দেয়ার একদিন পর সোমবার অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে (আইআরডিতে) তিনি যোগদান করেছেন। তবে তিনি অসুস্থ থাকায় বাহক মারফত চিঠি দিয়ে তিনি যোগদান করেছেন বলে এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
দুর্নীতি করে সাগর চুরির মতো ঘটনার পরও গ্রেফতার করা হয়নি কারণ মতিউরের মাধ্যমে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করছেন, স্বর্ণ চোরাচালান করেছেন এমন ক্ষমতাধর ব্যবসায়ীসহ সুবিধাভোগীরা এখন মতিউরকে রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এমনকি এই তালিকায় একাধিক ক্ষমতাধর সচিবও রয়েছেন। বিশেষ করে যারা বিদেশে বিপুল অর্থ পাচার করেছেন। তাদের আশঙ্কা মতিউর ধরা পড়লে তাদের সবার গোমর ফাঁস হয়ে যাবে। মতিউর রহমান দেশে বিপুল অর্থ-সম্পদ করেছেন। একই সঙ্গে বিদেশে অর্থ পাচার করে কানাডা ও দুবাইয়ে বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন সম্পদ ক্রয় করেছেন। মতিউরের সম্পদ সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বলে একাধিক কর্মকর্তাও দাবি করেছেন।
মতিউর কাস্টমস এ চাকরি করেছে, তাও আবার ভালো জায়গায়। যেখানে দৈনিক কয়েক কোটি টাকা পকেটে আসে। ঢাকার এয়ারপোর্ট, চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট, সিলেট এয়ারপোর্ট ও বেনাপোল স্থলবন্দরে চাকরি করার সময় স্বর্ণ চোরাচালান ও অবৈধ মালামাল পাচারকারীদের সঙ্গে তার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তার পেছনে রয়েছে স্বর্ণ চোরাচালানের গডফাদার, হুন্ডি ব্যবসায়ী, ও অবৈধ মালামাল আনা নেওয়া যারা করে সেই সব বড় বড় ব্যবসায়ীরা। তারা এদেশের বড় বড় মাফিয়া।
এছাড়া আমলাদের মধ্যে যারা খুবই শক্তিশালী, যারা নির্দেশনা দিলে মন্ত্রণালয়ে এক মিনিটে আদেশ জারি হয়ে যায়, এমন কয়েকজন আমলার সাথে মতিউরের গভীর সখ্যতা ছিল। ব্যাংক সেক্টরের একজন শীর্ষ ক্ষমতাধর কর্মকর্তাও মতিউরের কাছ থেকে বিপুল সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। তার মাধ্যমে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকা বানিয়েছেন। শেয়ারবাজারের একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তির সঙ্গে মতিউরের সম্পর্কে ছিল, যারা হাজার হাজার কোটি টাকা শেয়ারবাজারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সাথেও মতিউর জড়িত। ব্যাংকের পরিচালকও ছিলেন মতিউর। অর্থাৎ হাজার হাজার কোটি টাকা যেখানে বানানো যায়, সেখানেই মতিউর।
এদিকে, আখাউড়া স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মতিউর রহমানের পাসপোর্ট দিয়ে এখান থেকে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে সরকারের অপর একটি সংস্থার কর্মকর্তা বলেছেন, রাজধানী ঢাকায় তার নিজের বাড়িতে আছেন। অসুস্থতার কথা বলে তিনি গত তিন দিন অফিস করেননি। তবে দীর্ঘ ১৪ দিন পর জনসম্মুখে আসলেন ছাগলকাণ্ডে বিতর্কিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য ড. মতিউর রহমানের স্ত্রী ও রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকী।
বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) বেলা ১২টার দিকে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে উপজেলা পরিষদে আসেন লায়লা কানিজ লাকি। পরে তিনি আসন্ন এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা উপলক্ষে এক প্রস্ততিমূলক সভায় যোগ দেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হাসান। এ সময় উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) শফিকুল ইসলাম ও বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, কোরবানি ঈদের সময় ১৫ লাখ টাকায় ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রো থেকে ইফাত নামের এক তরুণের ১৫ লাখ টাকা দামে ছাগল কেনার ফেইসবুক পোস্ট ঘিরে আলোচনায় আসেন মতিউর রহমান। এরপর তাকে ঘিরে সোশাল মিডিয়ায় আলোচনার মধ্যে সংবাদমাধ্যমে একের পর এক খবর আসতে থাকে।
পরে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমানকে ইতোমধ্যে এনবিআর থেকে সরিয়ে রোববারই অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তার সম্পদের খোঁজে অনুসন্ধানে নামে দুদক। তিনি মুশফিকুর রহমান ইফাতসহ দেশত্যাগ করেছেন বলে খবর আসে সংবাদ মাধ্যমে। এমন খবরের মধ্যে গত সোমবার দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনে মতিউর, তার স্ত্রী লায়লা কানিজ ও ছেলে আহম্মেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত।
‘ছাগলকাণ্ডের’ পর মতিউর রহমান এ আলোচনায় ঘি ঢালেন ‘ছেলের’ পরিচয় অস্বীকার করে। একটি টেলিভিশনের প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে কেউ তার ছেলে বা আত্মীয় নয়, এমন নামে কাউকে চেনেন না পর্যন্ত। তার একটিই ছেলে, তার নাম তৌফিকুর রহমান। এরপর ইফাতের পরিচয় ও পারিবারিক ঠিকুজি নিয়ে ফেইসবুকে নানা তথ্য আসতে থাকে। ইফাতের সঙ্গে মতিউর রহমান এবং পরিবারের অন্যদের ছবিও প্রকাশিত হয়। এক পর্যায়ে সামনে আসেন ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেন, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই ইফাতের বাবা।
এরপর মতিউর ও তার পরিবারের সম্পদের বিষয়ে নানা তথ্য আসতে থাকে খবরে। একে একে পুঁজিবাজারের তার বিনিয়োগ ও মুনাফার খবরও আসে। এর সূত্রপাত তিনিই করেছিলেন ওই বেসরকারি টেলিভিশনের সঙ্গে আলোচনায়। তিনি বলেছিলেন, চাকরির পাশাপাশি তিনি ব্যবসায় জড়িয়েছেন; বিনিয়োগ করেছেন পুঁজিবাজারেও। তিনি নিজেই বলেছিলেন মেয়ের নামে ১ কোটি টাকা বিনয়োগ করে ১৪ কোটি টাকা মুনাফা করার কথা।
এরপর বিভিন্ন কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনার মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে বিপুল অর্থ মুনাফা করার খবর আসতে থাকে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এই বিষয়ক এক প্রতিবেদনে মতিউর এবং তার দুই স্ত্রী ও সন্তানদের নামে ১৬টি বিও অ্যাকাউন্ট থাকার তথ্য প্রকাশ করা হয়। পুঁজিবাজারে মতিউরের বিনিয়োগ নিয়ে এমন সব খবরের মধ্যে সিডিবিএলকে তাদের সব বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ রাখার নির্দেশ দেয় বিএসইসি।
বিআলো/শিলি