ছোট গরুর চাহিদা বেশি, শঙ্কায় বড় গরুর বিক্রেতারা
বিআলো প্রতিবেদক: প্রতিবারের মতো রাজধানীর হাটগুলোতে বড় সাইজের গরু উঠেছে। কিন্তু বড় গরুর চাহিদা এবার কম। মাঝারি ও ছোট গরুই বেশি কিনছে ক্রেতারা। বড় সাইজের গরু নিয়ে এসে দুচিন্তায় পড়েছেন ব্যাপারীরা। তারা যে দাম হাঁকাচ্ছেন তার অর্ধেক দাম বলছেন ক্রেতারা। তাই ব্যাপারীরা বেশ হতাশ। ঈদের বাকী দুই দিন, এর মধ্যে বড় সাইজের গরু বিক্রি করতে না পারলে কপালে হাত উঠবে তাদের।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদিত স্থায়ী-অস্থায়ী ২০টি হাটের মধ্যে গাবতলি, রামপুরার মেরাদিয়া, তেজগাঁওয়ের পলিটেকনিকের খেলার মাঠ, হাজারীবাগ, কমলাপুরসহ কয়েকটি বাজারের ক্রেতা- বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছোট ও মাঝারি সাইজের গরুর ক্রেতা সবচেয়ে বেশি। বিক্রেতাদের মধ্যেও যারা এই আকারের গরু নিয়ে বাজারে এসেছেন তাদের বিক্রি ভালো হচ্ছে।
শুক্রবার (১৪ জুন) রাজধানীর গাবতলী গরুর হাটে দেখা যায়, বড় গরু বিক্রি হচ্ছে কম। দেশি ও ভারতীয় গরুই শুক্রবার বেশি বিক্রি হয়েছে। বিশেষ করে শাহীওয়াল জাতের গরুগুলোই ক্রেতারা পছন্দ করছেন।
বিক্রেতারা বলছেন, বাজারগুলোতে বৃহস্পতিবার পর্যন্তও খুব বেশি ক্রেতা ছিল না। শুক্রবার সকাল থেকেই বিক্রি বাড়তে থাকে। জুম্মার নামাজের পর থেকে ক্রেতা সমাগম আরও বেড়েছে।
বিক্রেতাদের আশা, ১৭ তারিখের আগ পর্যন্ত ক্রেতার চাপ বাড়তেই থাকবে।
কুষ্টিয়া থেকে আসা আরেক বিক্রেতা আলিম উদ্দিন জানান তিনি ৩৭টি গরু নিয়ে এসেছেন। তার গরুগুলো মাঝারি আকারের। একেকটার দাম সাইজ অনুযায়ী দেড় লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকার মধ্যে। তিনি জানান, ইতোমধ্যে তার ৯টি গরু বিক্রি করেছেন। শুক্রবার দুপুরের পর থেকেই ক্রেতার সংখ্যা বেড়েছে।
এদিকে, ক্রেতাদের অভিযোগ বিক্রেতারা এবারে অতিরিক্ত দাম চাচ্ছেন। যারা লাখ টাকা বাজেট করে বাজারে এসেছেন, তাদের বাজেট বাড়াতেই হচ্ছে।
প্রতি বছর গাবতলী হাটে উত্তরের বিভিন্ন জেলা থেকে গরু আসে। এবারও ট্রাকে ট্রাকে গরু আসছে। যথারীতি কুষ্টিয়া, যশোর, নড়াইল, মাগুড়া, পাবনা ও রাজশাহী, জয়পুরহাট, নওগাঁ ও বগুড়া ছাড়াও সিরাজগঞ্জ থেকে গরু এসেছে। এ হাট এখন গরুতে ভরে গেছে। তবে ক্রেতাও রয়েছে। দেশি গরুর পাশাপাশি হাটে এসেছে ভারতীয় গরুও। ফলে সংকরজাতের গরুর চাহিদা কমছে এ হাটে।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার গরু ব্যাপারী সনাতন। নিজেরই বাড়িতে একটি গরু পালন করেছিলেন। সেটি এবার হাটে তুলেছেন। তিনি সাড়ে ৭ লাখ টাকা হলে বিক্রি করবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ক্রেতারা মাত্র ৩ লাখ বলেছে।
তার কাছ থেকে কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ে ভারতীয় অনেকগুলো গরু নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় ইউনুস ব্যাপারী। ইন্ডিয়ান সাদা একটি গরুর দাম তিনি পাঁচ লাখ টাকা চাইলেন। কিন্তু ক্রেতা তার মুখের ওপর বলে বসল মাত্র আড়াই লাখ টাকা।
অন্যদিকে দুটি ফ্রিজিয়ান জাতের গরু নিয়ে এসেছেন বগুড়ার সোনাতলার কৃষক হাবিব ও বাবু। তারা দাম চাচ্ছেন ৯ লাখ টাকা। কিন্তু ক্রেতারা দাম বলছেন, মাত্র সাড়ে চার থেকে ৫ লাখ টাকা।
হাবিব বলেন, গতবার একটি গরুই সাড়ে চার লাখ ও ৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেছি। কিন্তু এবার বড় সাইজের গরুর ক্রেতা পাচ্ছি না। ফলে চিন্তা হচ্ছে যদি শেষমেষ গরু দুটি বিক্রি না হয়!
শুধু গাবতলীই নয়, রাজধানীর ধোলাইখাল এলাকার বসা পশুর হাটেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার বড় সাইজের গরু এখন পর্যন্ত বেশি বিক্রি হচ্ছে না। ফলে ব্যাপারীরা চিন্তায় পড়েছেন। কেউ কেউ আবার কম দামেই ছেড়ে দিচ্ছেন। একই চিত্র বছিলা হাট, লালবাগ হাট, হাজারীবাগ হাটসহ অন্যান্য হাটেও।
শুক্রবার বিকেল থেকে যতো গরুর বিক্রি হয়েছে তার বেশির ভাগই ছিল মাঝারি সাইজের। তবে ছোট গরুর দাম এ হাটে ছিল চড়া। তারপরও গতবারের তুলনায় ২০ থেকে ৩০ হাজার কম। এ হাটে প্রতিটি হাসিল ঘর থেকে শুক্রবার যতো হাসিল টোকেন কাটা হয়েছে তার বেশির ভাগই ছিল ছোট ও মাঝারি সাইজের গরু ক্রেতার।
বড় গরু খুবই কম বিক্রি হয়েছে। এ হাটে মাঝারি গরুগুলো ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। আর ছোট গরু ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। যেগুলো গতবার ছিল লাখ টাকার ওপরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেন হঠাৎ এই বড় সাইজের গরু কেনা থেকে পিছু হটলো ক্রেতা। এ হাটে প্রায় অর্ধশতাধিক ক্রেতার সাথে কথা হয়েছে। তারা প্রত্যেকে বলেছেন, বড় গরুর মাংস খেতে তেমন স্বাদ পাওয়া যায় না। তাছাড়া বড় সাইজের গরু কিনতে গেলে মাংসের কেজির দামে বেশি পড়ে। শুধু তাই নয়, বড় গরুর দাম বেশি হলেও মাংস সেই অনুপাতে পাওয়া দুস্কর হয়। ফলে গতবারের বড় গরু কেনা ক্রেতারা এবার মাঝারি সাইজের দুটি করে গরু কিনছেন।
কুষ্টিয়ার সুজা আহমেদ নামে এক ব্যাপারী জানালেন, তারা গতবার বড় সাইজের গরু এনে ধরা খেয়েছেন। বিক্রি করতে না পেরে পরে ফেরত নিয়ে গেছেন। এবার যেন এমন না হয় তার জন্য তারা সচেতন রয়েছেন। তিনি বলছেন, লাভ দরকার নেই, আসল দাম থেকে কিছুটা লাভ রেখে ছেড়ে দেব।
ব্যাপারীরা জানান, তারা এখনো বড় সাইজের গরুগুলো বিক্রির জন্য তেমন বড় ক্রেতা পাচ্ছেন না। যারাই আসছেন তারা তাদের হাঁকানো অর্ধেক দাম বলেই চলে যাচ্ছেন। তাদের মতে, ক্রেতারা এবার চালাক হয়েছেন, বড় সাইজের গরুর দামে তারা এবার দুটি করে গরু কিনে বাড়িতে যাচ্ছেন।
ব্যাপারীরা আরও জানান, এবার হাটের অবস্থা ভালো নয়। ক্রেতাদের হাতে তেমন টাকা নেই বলে তাদের ধারণা। কারণ অধিকাংশ ক্রেতা হাটে ঢুকেই মাঝারি গরু খুঁজছেন। ফলে বড় সাইজের গরুর কি হবে তা নিয়ে তারা এখন দুচিন্তায় পড়েছেন।
মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছর ১ কোটি ৭ লাখ ২৩৯৪টি পশুর চাহিদার বিপরীতে দেশে কোরবানিযোগ্য পশুর সরবরাহ রয়েছে ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি।
মৎস্য ও প্রাণীসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমান জানান, এবারে চাহিদার তুলনায় ২২ লাখ ৭৭ হাজার ৯৭৩টি কোরবানির পশু বেশি রয়েছে। যা আমাদের দেশেই লালন-পালন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের সক্ষমতার সঙ্গে তাল মিলিয়েই প্রতি বছর পশু কোরবানি হয়ে থাকে। এ বছর কোরবানির সক্ষমতার ক্ষেত্রে বছরজুড়ে ১০ শতাংশের কাছাকাছি মূল্যস্ফীতির যে চাপ, তারও একটা প্রভাব পড়তে পারে। একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ, অন্যদিকে বাড়তি উৎপাদন খরচ; তাই ক্রেতাদের নজর ছোট গরুর দিকে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির কারণে এবারে ছোট গরুতে একটা বাড়তি চাপ থাকবে। অন্যদিকে আবার গরুর উৎপাদন খরচে শুধু খাদ্যের দামই ৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘গত বছর অনলাইনে লাইভওয়েট হিসেব করে ৪৮০-৫০০ টাকা কেজি দরে যেসব গরু বিক্রি হয়েছে, এবছর সেগুলোই আকারভেদে ৫০০-৬০০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি করতে হয়েছে।’
প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, ‘উৎপাদন খরচ বেড়েছে এটা সত্য। কিন্তু কোরবানির পশুর কিন্তু সংকট নেই, বাজারগুলোতে প্রচুর দেশি গরু রয়েছে।’
প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর জানায়, ২০২৩ সালে পশু কোরবানি হয়েছে ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি। এর মধ্যে ৪৫ লাখ ৮১ হাজার ছিল শুধু গরু।
এছাড়া ১ লাখ ৭৮ হাজার মহিষ, ৪৮ লাখ ৪৯ হাজার ছাগল এবং কয়েক লাখ অন্যান্য পশু কোরবানি হয়। যার বাজার মূল্য ছিল ৬৪ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। যা ২০১৭ সালে ছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা।
বিআলো/শিলি