জুলাই-আগষ্ট গনঅভ্যুথ্যান: শোক আর অনিশ্চয়তায় দিশেহারা শহীদ মাসুদের পরিবার
ইবনে ফরহাদ তুরাগঃ জুলাই গনঅভ্যুথ্যানে নিজ বাসার সামনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত হেলমেটধারীদের গুলিতে প্রাণ হারান এলাকার ক্ষুদ্র নির্মাণ সামগ্রী ব্যবসায়ী মোঃ মাসুদ। এরপর থেকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে শহীদ মাসুদের পরিবার।
প্রতিবেশীরা জানান, একদিকে প্রিয়জন হারানোর বেদনা অন্যদিকে খাওয়া-পড়ালেখার অনিশ্চয়তা। সন্তানেরা হারিয়েছেন তাদের বাবাকে। স্ত্রী হারিয়েছেন স্বামী। পাঁচ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মাসুদের অনুপস্থিতিতে তারা একই সাথে মানসিক ও অর্থকষ্টে দিন যাপন করছেন। তিন শিশু সন্তান নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন শহীদ মাসুদের স্ত্রী।
প্রসঙ্গত, জুলাই মাসের ১৯ তারিখ বিকেলে রাজধানীর কদমতলী থানাধীন মেরাজনগর বি-ব্লক আবাসিক এলাকায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সমর্থিত হেলমেটধারীরা গুলিতে করে হত্যা করে এলাকার স্থানীয় ব্যক্তি মোঃ মাসুদ (৪২) কে। একই সময় শান্তি নিবাস- ২ ভবনের ৮ম তলার বারান্দা দিয়ে প্রবেশ করা একটি গুলিতে প্রাণ হারান ৪ বছরের শিশু ছেলে আহাদ।
স্থানীয়দের সূত্রমতে জানা যায়, সেদিন ১৯ জুলাই জুম্মার নামাজের পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিতে রায়েরবাগ ষ্ট্যান্ড এ অবস্থান করেন মো: মাসুদ। পরবর্তীতে তিনি বিকেল ৫টার দিকে তিনি নিজ বাসা থেকে মেরাজনগর বি-ব্লকের শাহী মসজিদ সংলগ্ন সড়কে আছরের নামাজ পড়তে যান। এ সময় পথিমধ্যে তার দুই পুত্রের সামনে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের হেলমেট বাহিনী গুলি করে মাসুদকে হত্যা করে। এ ঘটনার নিহতের স্ত্রী হেনা বেগম বাদী হয়ে কদমতলী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হলে এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১২ জন আসামী গ্রেফতার করতে পেরেছে পুলিশ।
এলাকাবাসী জানায়, মাসুদ ছিলেন একজন সত্যভাষী, পরোপকারী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল একজন ব্যক্তি। এলাকাবাসীর যেকোনো বিপদে-আপদে মাসুদের অবস্থান একাই থাকতো সবার সম্মুখে। তারা বলেন, মাসুদ মারা যাওয়ার পর সেদিন কার্ফিউ (১৪৪ধারা) উপেক্ষা করে তার জানাযা নামাজে অংশগ্রহণ করেন শতশত মানুষ। এর ১৭ দিন পর গত ৫ আগস্ট দুপুরে স্বৈরাচারী সরকার প্রধান শেখ হাসিনার পতন ঘটে।
মাসুদকে গুলি করে হত্যার দিন একটি আবাসিক ভবন থেকে মোবাইল ফোনে গোপনে ধারণকৃত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ২ যুবক শাস্তি নিবাস ভবনের নিচ থেকে ভবনের আশপাশে ও শাহী মসজিদের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছে। এর মধ্যে ১ যুবক মুখে লাল রুমাল বেঁধে সামনে থেকে গুলি করছে। এ সময় তাদেরকে গুলি চালাতে নির্দেশনা দিচ্ছে কয়েকজন হেলমেটধারী, অনেকের হাতে ছিলো দেশীয় অস্ত্র।
সম্প্রতি শহীদ মাসুদের মেরাজনগর বাসায় দৈনিক বাংলাদেশের আলো’র সাথে আলাপকালে মাসুদের স্ত্রী হেনা প্রতিবেদক-কে বলেন, ‘হামলাকারীদের কিছু লোক মাথায় হেলমেট পরা ছিলো, তারা আমার স্বামীকে আসর নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় ধরে এবং ঐ মুহূর্তেই তাকে গুলি করে হত্যা করে’। আমার বড় ছেলে মাহফুজ (১১) তখন সেই রাস্তার পাশে একটা বাসার ছাদে বসে সংঘর্ষ দেখছিলো। সেখান থেকে রাস্তায় নেমে এসে বলে ‘আমার আব্বু ঐটা। আমার আব্বুকে মেরে ফেলসে’। হেনা বলেন, ‘উনি বিভিন্ন ভবনের নির্মাণ সামগ্রী কিনতে কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করে আমাদের ভরণ-পোষণের যোগান দিতেন। কিন্তু তার আকস্মিক মৃত্যুতে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি।’
ক্ষুদ্র নির্মাণ সামগ্রী ব্যবসায়ী মোঃ মাসুদের মৃত্যুর পর থেকে পরিবারটি এখন শোক আর অনিশ্চয়তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তাদের তিন পুত্রের মধ্যে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র মাহফুজ (১১), তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র মারুফ (৬) এবং নার্সারির ছাত্র মাশরাফিকে নিয়ে তাদের মা হেনা (৩৭) চোখে অন্ধকার দেখছেন।
নিহতের বড় ভাই কবির কান্না স্বরে বলেন, ‘আন্দোলন শুরুর মাঝামাঝি সময় থেকে মাসুদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পরিবারের সদস্যদের সাথে আন্দোলনে অংশগ্রহণের বিষয়ে কখনো কথা বলেননি। এই আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান হয়েছে, কিন্তু আমরা তো ভাইকে হারিয়েছি। আমার ভাই সেদিন আর বাড়ি ফেরেনি।
সেদিনের হামলার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই দিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ঘটনার ৫ মিনিটের মধ্যে খবর পাই আমার ভাই মাসুদকে গুলি করে ও কুপিয়ে মেরেছে। সেদিন এখানে পুলিশ আসে নাই, পুলিশ কিন্তু ঘটনার ৩ দিন পরও আসে নাই। হামলার ঘটনায় এলাকার আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা অস্ত্রসস্ত্রসহ উপস্থিতি ছিলো। যা এলাকার বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ ও মোবাইলফোনে ধারণ করা হয়েছে।’ আসরের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় তার দুই পুত্রের সামনে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের হেলমেট বাহিনী গুলি করে মাসুদকে হত্যা করে।
মাসুদের স্ত্রী শোকস্তব্ধ হেনা পরিবারের অসহায়ত্বের কথা প্রতিবেদককে বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পরছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি সংক্ষেপে তার যন্ত্রণার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীই আমাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল। তার মৃত্যুতে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। এত কম সময়ে স্বামীকে হারিয়ে আমি দু’চোখে অন্ধকার দেখছি।’
কাঁদতে কাঁদতে হেনা বলেন, ‘আমার ৩ শিশু ছেলে সন্তানেরাই এখন আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। আমার ছেলেদের তাদের বাবার মতো আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। এজন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন।’ তিনি তার ছেলেদেরকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে পড়ালেখার খরচ বহন করার জন্য সরকারের কাছে সহযোগিতা চান।
এদিকে শহীদ মাসুদকে যারা হত্যা করেছে তাদের ফাঁসির দাবি জানিয়েছে মাসুদের পরিবার সহ এলাকার সর্বস্তরের জনসাধারণ। এই ঘটনায় অস্ত্র দিয়ে গুলি করা ব্যক্তিদের দলীয় পরিচয় রয়েছে বলে জানায় স্থানীয়রা। তাদের দাবি আশপাশের সব সিসি টিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে খুনিদের শনাক্ত করার ও আইনের আওতায় নিয়ে আসার।
শহীদ মাসুদ হত্যাকান্ড: তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, সেদিন ১৯ জুলাই (শুক্রবার) জুমার নামাজের পর গনঅভ্যুথ্যানে অংশ নেওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা রায়েরবাগ বিশ্বরোড থেকে তাদের অবস্থান সরিয়ে কদমতলী থানা ঘেরাও করতে আসে। এর পরিপেক্ষিতে পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বাধার সম্মুখীন হয়ে আন্দোলনকারীরা মুজাহিদনগর ও মেরাজনগর আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে। যার ফলে এলাকাবাসীর জন্য নেমে আসে বিরাট বিপর্যয়। এ সময় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রায়েরবাগ আবাসিক এলাকা।
এক পর্যায়ে কোটাবিরোধীদের নৈরাজ্য ঠেকাতে মাঠে নামেন যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় ক্যাডার বাহিনী। শুরু হয় দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ। প্রায় ২ ঘণ্টা সংঘর্ষের পর এ সময় আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেয় মেরাজনগর বি-ব্লক শান্তি নিবাস ১০ তলা ভবনের নিচে।
তখন বিকাল ৫টা। এবার শুরু হয় গোলাগুলির শব্দ। এ সময় শান্তি নিবাস- ২ ভবনের ৮ তলার বারান্দা দিয়ে প্রবেশ করা দুর্বৃত্তদের করা একটি গুলিতে প্রাণ হারান ৪ বছরের ছেলে আহাদ। একই সময় দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয় আসরের নামাজ আদায় করতে যাওয়া এলাকার স্থানীয় যুবক মাসুদ। এলাকাবাসী জানান, সংঘর্ষের সময় মাসুদের মাথায় গুলি করার পরও ক্ষান্ত হয়নি দুর্বৃত্তরা। দ্বিতীয় ধাপে তারা আবার কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
বিআলো/নিউজ