ট্রাম্প-হ্যারিস বিতর্কে কমলার বাজিমাত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: নভেম্বরের নির্বাচনের আগে ঐতিহাসিক ও ভাগ্য নির্ধারণী প্রথম এবং খুব সম্ভবত শেষ বিতর্কে মঞ্চের সব আলো কেড়ে নিয়ে আরও ঝলমলে, আরও দেদীপ্যমান হয়ে উঠলেন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিস। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ৯০ মিনিটের বিতর্কে তিনি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
উত্তেজনাপূর্ণ বিতর্কে কমলা হয়ে ওঠেন আরও উজ্জ্বল। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন অনন্য শৈলীতে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে কুপোকাত করার প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য কমলা তাঁর আইনজীবীর দক্ষতার ঝলকানি দেখান।
মঙ্গলবার রাতে এবিসি নিউজ আয়োজিত এ বিতর্কে তারা গর্ভপাত, অর্থনীতি, অভিবাসন, গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তীব্র বিতণ্ডায় জড়ান। তবে ট্রাম্প এ সময় নিজে রক্ষণাত্মক অবস্থান নিতে বাধ্য হন।
বিতর্কে কমলার পারফরম্যান্স সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, দু’জনের ‘বৈসাদৃশ্য এমনকি নিঃশব্দে স্পষ্ট ছিল। কমলা হাসলেন এবং জ্বলে উঠলেন। তিনি হয়ে ওঠেন বিতর্কের নিয়ন্তা। কমলার পাতা ফাঁদে ট্রাম্প ঝাঁপিয়ে পড়েন।’
প্রায় আড়াই মাস আগে গত ২৭ জুন ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম বিতর্কে নাস্তানাবুদ হয়ে নির্বাচনী দৌড় থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। এবার কমলা তা পুষিয়ে দিয়েছেন। ২০১৬ সালের পর এই প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে দুই প্রার্থী হ্যান্ডশেক করেন। কমলাই হাত বাড়িয়ে দেন ট্রাম্পের দিকে। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার পর এবারই প্রথম ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ ঘটল তাঁর।
ট্রাম্প এ সময় ‘কমলা হ্যারিস’ সম্বোধন করে তাঁকে বলেন, বিতর্কে ‘মজা করুন’, মানে প্রাণবন্ত থাকুন। তবে প্রতিদ্বন্দ্বীকে এমন সুপরামর্শ দিলেও ট্রাম্প নিজে কিন্তু সেই সুযোগ পাননি। তিনি ছিলেন বিচলিত।
বিতর্কে অভিবাসন প্রসঙ্গ এলে ট্রাম্প দাবি করেন, ওহাইও শহরে পোষা প্রাণী খাচ্ছে অভিবাসীরা। এবিসি নিউজ মডারেটরদের একজন তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেন। আর কমলা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে লক্ষ্য করে হেসে দেন এবং বলেন, তিনি ‘চরমপন্থা’ ধরেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলো বলছে, বিতর্কে কমলা জিতেছেন। যদিও কিছু রক্ষণশীল আউটলেট ট্রাম্পের বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য মডারেটরদের সমালোচনা করেছে।
রক্ষণশীল-ঘেঁষা ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল একাধিক মতামত প্রকাশ করেছে। তাতে একজন ভাষ্যকার লিখেছেন, ট্রাম্প ‘নকআউট ধাক্কা দেওয়ার সুযোগটি হাতছাড়া করেছেন।’ আরেকটি রক্ষণশীল প্রকাশনা নিউইয়র্ক পোস্ট বলছে, ট্রাম্পকে বিচলিত করেছেন কমলা। তিনি ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তবে মডারেটররা ‘কমলার চেয়ে ট্রাম্পকে অনেক বেশি কঠিন প্রশ্ন করেছেন বলে’ তিনি মন্তব্য করেছেন।
ট্রাম্পের পছন্দের ফক্স নিউজ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে, কমলা বিতর্কে ‘জিতেছেন’। সিএনএন/এসএসআরএস জরিপে ৬০০ জন নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ৬৩ শতাংশ বলেছেন, কমলা সেরা পারফরমার এবং ৩৭ শতাংশ ট্রাম্পের পক্ষ নিয়েছেন।
বিতর্ক শেষে রিপাবলিকানরা বুঝতে পারেন, ট্রাম্প জিততে পারেননি। এ জন্য অবশ্য তারা দোষ দিয়েছেন ‘মিডিয়াকে’। রিপাবলিকান সিনেটর টম কটন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা তিনজন বনাম একজনের বিতর্ক ছিল। মডারেটররাও ট্রাম্পের তথাকথিত ফ্যাক্ট-চেকিংয়ে নিযুক্ত ছিলেন। তারা কমলা হ্যারিসের ক্ষেত্রে তা করেনি।’ ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের উপদেষ্টা এবং মেরিল্যান্ডের রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির সদস্য ডেভিড বস বলেছেন, ‘সেখানে দুজন মডারেটর কমলার প্রচারণার এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন।’
জাতীয় জনমত জরিপে দেখা যায়, ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে কমলা কিছুটা এগিয়ে রয়েছেন। তবে মূল রণক্ষেত্র রাজ্যগুলোতে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস মিলছে। এ অবস্থায় মঙ্গলবার বিতর্ক শেষে জরিপে অংশ নেওয়া ৪ শতাংশ ভোটার বলেছেন, বিতর্কটি তাদের মন পরিবর্তন করেছে– তারা কাকে ভোট দিতে পারে।
কিছু দোদু্ল্যমান ভোটার বিবিসি নিউজকে বলছেন, তারা কমলাকে ভোট দেবেন। ওহাইওর উইলিয়াম হোয়েকজেমা (৩১) বলেছেন, বিতর্কের পরে তিনি কমলার দিকে ঝুঁকছেন। তিনি বলেন, ট্রাম্পকে অনেক প্রশ্ন করা হয়েছিল। ইমিগ্রেশন এবং গর্ভপাতের মতো ইস্যুতে তাঁর নিখুঁতভাবে উত্তর দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাঁর জবাব সন্তোষজনক ছিল না।
বিতর্ক শেষ হওয়ার পরপরই ৩৪ বছর বয়সী মার্কিন গায়িকা টেলইর সুইফট এবারের নির্বাচনে কমলাকে ভোট দেওয়ার ঘোষণা দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে সুইফট বলেন, তিনি কমলাকে ভোট দেবেন। কারণ, তিনি অধিকারের জন্য লড়াই করেন। আর তিনি (সুইফট) বিশ্বাস করেন, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য একজন যোদ্ধার প্রয়োজন। তিনি মনে করেন, কমলা একজন প্রতিভাধর নেত্রী। পোস্টের শেষে সুইফট নিজের পরিচয় দেন ‘নিঃসন্তান ক্যাট লেডি’ হিসেবে। ট্রাম্পের রানিংমেট নিঃসন্তান কমলাকে বিদ্রুপ করে এ মন্তব্য করে সমালোচিত হয়েছিলেন।
দু’জনের মধ্যে প্রথম এই বিতর্কে যেসব বিষয় এসেছে সেগুলোর মধ্যে আছে– অর্থনীতি, গর্ভপাত, পররাষ্ট্রনীতি, গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ, আফগানিস্তানে তালেবান ইস্যু, ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গাসহ নানা বিষয়।
ডেমোক্র্যাট প্রার্থী এক পর্যায়ে বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমাবেশ শেষ হওয়ার আগেই দর্শক ‘ক্লান্ত হয়ে’ সভাস্থল ত্যাগ করেন। তাঁর মন্তব্যে বিরক্ত হয়ে ট্রাম্পকে গলা চড়িয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দেখা যায়।
কমলার বক্তব্য দিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। তাদের কাছে প্রথম প্রশ্ন ছিল– ‘আপনি কি বিশ্বাস করেন, আমেরিকানরা এখন চার বছর আগের চেয়ে ভালো আছে?’
এ সময় কমলা ‘অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি’ গড়ে তোলার বিষয়ে নিজের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান। তরুণ পরিবারগুলোকে সাহায্য করার জন্য আবাসনের খরচ কমানোর কথা জানান তিনি।
তিনি বলেন, ট্রাম্প গ্রেট ডিপ্রেশনের পর আমাদের জন্য সবচেয়ে খারাপ বেকারত্ব রেখে গেছেন। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের চরম অর্থনৈতিক মন্দার সময়টিকে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বলা হয়। কমলা বলেন, ‘আমরা ট্রাম্পের রেখে যাওয়া জঞ্জাল পরিষ্কার করছি।’
বিতর্কের মডারেটররা মার্কিন ভোটারদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু গর্ভপাত অধিকার তুলে ধরেন। এতে ট্রাম্পের অবস্থান পরিষ্কার করার আহ্বান জানান। কারণ, অতীতে এ বিষয়ে ট্রাম্পের মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল।
ডেমোক্র্যাটরা গর্ভধারণের ‘নবম মাসে’ গর্ভপাতের অনুমতি দিতে চায় দাবি করে ট্রাম্প তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। কিছু রাজ্যে জন্মানোর পর শিশুদের হত্যার বিষয়টি অনুমোদন করেছে ডেমোক্র্যাটরা– ট্রাম্পের এই দাবির পর মডারেটর বলেন, এই দেশে এমন কোনো রাজ্য নেই, যেখানে জন্মানোর পর শিশুকে হত্যা করা বৈধ।
কীভাবে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ পরিচালনা করবেন এবং অচলাবস্থার নিরসন করবেন– কমলাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়। এই ইস্যুতে নিজের আগের কিছু মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে কমলা বলেন, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে, তবে কীভাবে তারা এটা করে, তাও গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধের অবসান হওয়া উচিত। এটা অবিলম্বে শেষ হওয়া উচিত। তিনি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। গাজা পুনর্নির্মাণের জন্য একটি দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের কথাও বলেন।
কীভাবে গাজা যুদ্ধ শেষ করবেন এবং হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া বেসামরিক নাগরিকদের ফেরানো হবে– এ প্রশ্ন ট্রাম্পকেও জিজ্ঞেস করা হয়। জবাবে বলেন, তিনি এখন প্রেসিডেন্ট থাকলে সংঘর্ষ কখনোই শুরু হতো না।
ট্রাম্প বলেন, ‘কমলা ইসরায়েলকে ঘৃণা করেন। তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে আমি বিশ্বাস করি, এখন থেকে দুই বছরের মধ্যে ইসরায়েলের অস্তিত্ব থাকবে না।’
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেন জয়ী হোক, এটা চান কিনা– জানতে চাইলে ট্রাম্প সরাসরি জবাব দেননি। তবে তিনি বলেন, ‘আমি চাই যুদ্ধ বন্ধ হোক।’
বিতর্কে ট্রাম্প দাবি করেন, ‘আমরা একটি ব্যর্থ জাতি। আমরা এমন একটি জাতি, যেটি গুরুতর অধঃপতনের মধ্যে রয়েছে। সারাবিশ্বে আমাদের উপহাস করা হচ্ছে।’ কমলাকে তিনি ‘দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ভাইস প্রেসিডেন্ট’ উল্লেখ করে বলেন, নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে। বিতর্কের এক পর্যায়ে ট্রাম্প কমলার বর্ণ নিয়েও উপহাস করেন।
কমলা বিতর্কে তাঁর বক্তব্য এই বলে শুরু করেন, ‘আমরা পেছনে ফিরে যাচ্ছি না। আমরা একটি নতুন পথে এগিয়ে যেতে পারি।’
দ্বিতীয় বিতর্ক চায় কমলাশিবির-
ট্রাম্পের বিপক্ষে প্রথম মুখোমুখি নির্বাচনী বিতর্কে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের নৈপুণ্যে স্পষ্টতই সন্তুষ্ট তাঁর নির্বাচনী প্রচারশিবির। এবার তারা ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বিতীয় বিতর্ক আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছেন।
কমলার প্রচারশিবিরের মুখপাত্র জেন ও’ম্যালি ডিলন বিবৃতিতে আগামী মাসে ওই বিতর্ক আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছেন। ডিলন লেখেন, ‘ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস দ্বিতীয় বিতর্কের জন্য প্রস্তুত। ডোনাল্ড ট্রাম্প কি রাজি?’ তবে ফক্স নিউজের এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান ট্রাম্প।
আগামী ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে। এর আগে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে আর কোনো বিতর্কের সূচি এখন পর্যন্ত নেই। তবে আগামী ১ অক্টোবর কমলার ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী টিম ওয়ালজ এবং ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জে ডি ভ্যান্সের মধ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
বিআলো/শিলি