নৈরাজ্য ও সিন্ডিকেট, চামড়া শিল্প ধ্বংসের চক্রান্ত
রতন বালো: চলতি বছরের ঈদুল আজহায় দেশে কোরবানি হওয়া পশুর সংখ্যা গত এক দশকে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে সারাদেশে কোরবানি হয়েছে ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৪টি পশু। গত বছরের তুলনায় যা ১২ লাখ ৭২ হাজার ১৮৪টি কম। তাই এ বছর বাজারে চামড়ার তেমন সরবরাহ নেই। এরপরেও সিন্ডিকেট ও অসাধু ব্যবসায়ীরা পিছিয়ে নেই। তারা পাটের পর চামড়া শিল্পকে ধ্বংস করার ছক আটছে।
বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করে চামড়ার ন্যায্য দাম মিলছে না। নৈরাজ্য ও সিন্ডিকেটের কারণে চামড়ার দাম পড়ে গেছে। কেউ সরকারি রেটে চামড়া বিক্রি করতে পারেনি। এ বিষয়ে রাজধানীর শাজাহানপুর রেলওয়ে হাফিজিয়া সুন্নিয়া আলিম মাদ্রারাসার অধ্যক্ষ মাওলানা ইব্রাহীন খলিল বলেন, দেশে এবার বিপুলসংখ্যক পশু জবাই হলেও ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। আবার প্রতিবছরের মতো এবারও বেশির ভাগ ছাগলের চামড়া নষ্ট হয়েছে। বিদেশি চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে অসাধু ট্যানারি মালিকদের ফ্যাসিস্ট সিন্ডিকেট কৌশলে চামড়ার দাম কমিয়ে লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের চামড়াশিল্প।
তিনি বলেন, আমি ২৭০টি চামড়া বিক্রি করেছি। সরকারি রেট পাই নাই। সিটি করপোরেশন এর এক শ্রেণীর কর্মকর্তারা ঈদের পরের দিন ঘোষণা করেন চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে দিলে সরকারি রেটে ১৩০০ টাকা পাওয়া যাবে প্রতিপিস চামড়া। ১ সপ্তাহ থেকে ১০ দিন পরে বিক্রি করতে হবে। ঈদের আগে বলা থাকলে আমার চামড়া প্রক্রিয়াকরণ বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়া যেত। কিন্তু ঈদের পরের দিন বলায় চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করা আমাদের পক্ষ্যে সম্ভব হয় না।
তিনি আরো বলেন, অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এর কারণে আমরা প্রতিপিস চামড়া ৭০০ টাকা করে বিক্রি করতে হয়েছে। সিন্ডিকেটরা আমাদের মাইনকা চিপায় ফেলে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি করতে বাধ্য হই। আবার অনেকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে গেছে। গত বছর চামড়ার দাম কম ছিল, এ রকম ভোগান্তীর শিকার হতে হয়নি। খাশির চামড়া ২০ টাকা করে দিতে হয়েছে। খাশির চামড়া সরকারি রেট ছিল ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। ২০ টাকা করে প্রতি পিস চামড়া অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে দিতে হবে। যথাসময়ে চামড়া না নিলে পচন ধরে যাবে। তখন আপনার টিকতে পারবেন না বলে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা হুমকি দেন। তখন বাধ্য হয়েই ২০ টাকা করে অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে দিতে হয়।
লক্ষপুর জেলার বশিকপুর দারুল উলূম কারীমিয়ার মুহ্তামিম মুফতি ফজলুর রহমান আজম এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ৪৪টি পশুর চামড়া নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছি। ঈদের ৮ দিন হয় এখনও কোনো ব্যাপারী আসেন নাই। বিক্রি করাও সম্ভব হয়নি। লবণ দিয়ে রাখা হয়েছে। এভাবে আর কয়দিন চামড়া রাখা যাবে বলা মুসকিল । বিক্রি করতে না পারলে কি করবেন ? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ফেলে দিতে হবে। এই বাইরে আমাদের আর কিছুই করার নেই বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন। বিপুল অর্থের সংকট সৃষ্টি হবে।
৫৭৪টি গবাদি পশুর চামড়া নিয়ে বিপদের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর খিলগাঁও জামিয়া মাদানিয়ার শিক্ষা সচিব আলহাজ্ব জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, লবণ দিয়ে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করতে আমাদের অনেক খরচ হয়েছে। বিক্রি করতে হয় ৭০০ টাকা পিস। সকালে ৮০০ টাকা করে প্রতিপিস চামড়া কেনা যাবে। বিকেলে বলে ৭০০ টাকা করে দাম দেওয়া যাবে। খিলগাঁও তালতলা মসজিদে সাড়ে ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। সরকারি রেট ছিল সাড়ে ১৩০০ টাকা।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমরা মনে করেছিলাম নতুন সরকারের আমলে চামড়ার ভালো মূল্য পাবো। কিন্তু নতুন সরকারে সময়ই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দাপটে কম দামে চামড়া বিক্রি করতো হলো। গত বছর আমরা সাড়ে ৮০০ টাকা করে পেয়েছি। গত ৪-৫ বছর যাবৎ সিন্ডেকেট ব্যবসায়ীদের দাপটে আমাদের কম মূল্যে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে। নতুন সরকারের সময়ই এই হাল তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার বাইরে প্রতন্ত অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, অনেকে খাশির চামড়া ফেলে দিয়েছে। এখন গরুর চামড়াও অনেকে ফেলে দিয়েছে এবং বিক্রি করতে না পারলে ফেলে দিতে হবে বলে দুঃখ প্রকাশ করেন।
চলতি বছরের ঈদুল আজহায় দেশে কোরবানি হওয়া পশুর সংখ্যা গত এক দশকে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে সারাদেশে কোরবানি হয়েছে ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৪টি পশু। গত বছরের তুলনায় যা ১২ লাখ ৭২ হাজার ১৮৪টি কম। করোনাকালের (২০২০-২১ সাল) পর এটিই সর্বনিম্ন কোরবানি। দেশের চামড়ার সবচেয়ে বড় যোগান ঘটে কোরবানির মাসে। কিন্তু এবার সেখানে অনেকটাই স্থবিরতা দেখা দেওয়ায় বাজারে চামড়ার আমদানিতে হোচট খেয়েছে। তারপরেও সিন্ডিকেট করে চামড়া শিল্পকে পাট শিল্পের মতো ধ্বংস করার চক্রান্ত আটা হচ্ছে এমন অভিযোগ করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার রক্ষা আন্দোলন। এ দিকে চামড়ার প্রসারে কোরবানি বড় ধরনের অনুসঙ্গ। সাধারণত প্রতি বছর কোরবানির পশুর সংখ্যা বাড়ার প্রবণতা দেখা যায়। তবে এ বছর সেই ধারায় ব্যতিক্রম ঘটেছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এবারের কোরবানিতে প্রভাব পড়েছে। এ বছর তুলনামূলকভাবে ছাগল ও ভেড়ার কোরবানি কম হয়েছে। মানুষ প্রতিবছর যারা একা কোরবানি দিতেন, তাদের অনেকেও এবার যৌথভাবে দিয়েছেন। বড় গরুর বিক্রিতেও ধীরগতি ছিল। অবিক্রিত পশুর সংখ্যাও বেশি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার রক্ষা আন্দোলন চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আতা উল্লাহ খান বলেন, প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৬০ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও চামড়া বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্গফুটের হিসাবে চামড়ার দাম আরো কম পড়েছে। কোরবানি দাতাদের থেকে তারা সর্বোচ্চ ৪০০ থেকে ৬৫০ টাকায় গরুর চামড়া কিনেছেন এবং ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করেছেন ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায়। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করে চামড়ার ন্যায্য দাম মিলছে না। সিন্ডিকেটের কারণে চামড়ার দাম পড়ে গেছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরটির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ড. মো. আবু সুফিয়ান বলেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী পলাতক রয়েছেন। তাদের অনেকে আয়হীন অবস্থায় আছেন। ফলে তারা এবার কোরবানি দেননি। কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন-স্বাভাবিকভাবেই তারা দেশে পশু কোরবানি করেননি। এটি কোরবানির মোট সংখ্যায় প্রভাব ফেলেছে।
তিনি আরো বলেন, এ বছর তুলনামূলকভাবে ছাগল ও ভেড়ার কোরবানি কম হয়েছে। মানুষ প্রতিবছর যারা একা কোরবানি দিতেন, তাদের অনেকেও এবার যৌথভাবে দিয়েছেন। বড় গরুর বিক্রিতেও ধীরগতি ছিল। অবিক্রিত পশুর সংখ্যাও বেশি। তিনি বলেন, এ বছর কোরবানি কম হওয়ার পেছনে আর্থিক, সামাজিক কিংবা পরিবর্তিত পরিস্থিতির কোনো প্রভাব আছে কি না, তা আমরা খতিয়ে দেখবো।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দাম নির্ধারণ করা এমনিতেই ঠিক নয়। বাজারকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হয়। সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। ফলে লাভ-লোকসান বিবেচনায় না নিয়ে সরকারি দামে চামড়া কিনতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
এ দিকে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, লবণ ছাড়া চামড়ার দাম নির্ধারণ হয় না। এবারও লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া এক কোটি চামড়ার মধ্যে চট্টগ্রামে ৬২০ পিস চামড়া নষ্ট হয়েছে। সেই গল্প বড় করে দেখানো হচ্ছে। কারণ ট্যানারি মালিকরা চান না তারা বেশি দামে চামড়া কিনুন।
তিনি বলেন, কোরবানির চামড়া সংরক্ষণে এবার এতিমখানা ও মাদরাসায় সরকারের পক্ষ থেকে লবণ সরবরাহ করা হয়েছে। ফলে রাজধানীর বাইরে বিপুল চামড়া সংরক্ষিত হয়েছে। কমপক্ষে আগামী তিন মাস দর-কষাকষির সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর ফলে ন্যায্য দাম নিশ্চিত হবে। ব্যবসায়ীরাও ভালো দাম পাবেন।
১০ জুন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ‘কাঁচা চামড়ার গুণগত মান রক্ষায় লেস-কাট নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক পদ্ধতিতে চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবহন’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ বলেছেন, স্কয়ার ফুটে চামড়ার দাম নির্ধারণ করায় প্রতিবার যে অস্থিরতা তৈরি হতো এবার পিস হিসেবে চামড়ার দাম নির্ধারণ করায় সে অস্থিরতা তৈরি হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, এবার প্রতি পিস গরুর চামড়া ঢাকার ভেতরে ১ হাজার টাকা, ঢাকার বাইরে ১ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করেছি। তবে সেটি সঠিক গুণগত মানের হতে হবে। চামড়া লবণবিহীন হলে সাড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা দাম পড়বে।
শাহীন আহমেদ বলেন, এবার চামড়ার দাম নিয়ে কোনো অস্থিরতা তৈরি হবে না। কারণ, আমরা চামড়ার দর নির্ধারণ করে দিয়েছি। আগে আমরা স্কয়ার ফুটে নির্ধারণ করতাম, এবার পিস হিসেবে নির্ধারণ করেছি।
বিআলো/তুরাগ