প্রতীকী উৎযাপন নয়, চাই কার্যকর উদ্যোগ
প্রতিবছর ৮ ই মার্চ নারীদের অধিকার ও অবদানকে সম্মান জানাতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। তবে প্রশ্ন থেকে যায় সত্যিকার অর্থে নারীর সম্মানকে কি সত্যিই গুরুত্ব দেওয়া হয়? নারী দিবস মানে কেবল ফুল ও শুভেচ্ছা বার্তা নয়; এটি হওয়া উচিত নারীর প্রকৃত অধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের দিন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন অর্থে নারী দিবস পালন করা হয়। কোনো কোনো দেশে নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধা উৎযাপনের মূখ্য বিষয় হয় , আবার কোথাও নারীর আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে অবদানের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। নারী দিবসের মূখ্য উদ্দেশ্য এত সুন্দর ও সম্মানের হলেও বাস্তবতায় এর এটি নিছক একটা প্রথা মাত্র। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় এই দিনটা নারীদের আন্দোলনের ফসল। যা তখন থেকে হয়ে আসছে তাই এখনো চলমান। ইতিহাসে নারী দিবস নিয়ে একটু খোঁজে দেখলেই বিভিন্ন তথ্যসূত্রে সামনে আসে নারীদের কর্মসংস্থানে কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট, মজুরি বৈষম্য, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরোধীতা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিল সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই দিনটিকেই মূলত এই জাতি নারী দিবস হিসেবে পালন করে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এখনো কর্মক্ষেত্রে নারীদের সাথে বৈষম্য করা হয়। বছরে ৩৬৫ দিনের শুধু নারী দিবসের একটি দিন নারীদের প্রতিবাদের কথাটি মাথায় রেখে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। আর বাকি ৩৬৪ দিনই নারীদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, সম্মানে আঘাত করা হয়, গুরুত্বের বদলে অবহেলা করা হয়, আত্মসম্মান নিয়ে খেলা করা হয়। অসম্ভব মনে হচ্ছে? না এটাই বাস্তব। নারীদের যদি প্রকৃত অধিকার দেওয়া হতো তাহলে নারীদের সম্মানে আঘাত করা হতো না। নারীদের কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা হরণ করতো না। আমাদের সমাজের একাংশ নারীদের স্বাধীনতা নিয়ে বিরোধীতা করে। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা নারীদের স্বাধীনতার প্রকৃত সংজ্ঞা জেনে কথা বলবেন। আমি নারীদের পর্দা লঙ্ঘন করে চলাফেরার স্বাধীনতাকে নারী স্বাধীনতা বলছি না বলছি নারীর সম্মানের স্বাধীনতার কথা। আমি সেই সমাজে দাঁড়িয়ে এই স্বাধীনতা কথা উচ্চারণ করছি যেই সমাজে নারীদের ধর্ষণ করে উল্টা নারীর দিকে আঙুল তুলে পর্দার দোহাই দিয়ে। ধর্ষকদের জঘন্যতম অপরাধের সাথে নারীর পর্দাকে গুলিয়ে ঠিকই ভুক্তভোগীর দিকেই এই সমাজ আঙ্গুল তুলে ধরে। গত কয়েকদিনে বাংলাদেশে যে পরিমাণ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে তা এই সমাজে নারী দিবসের প্রকৃত অর্থকে ক্ষুণ্ন করেছে। সেদিন ফেসবুকে নিউজফিডে ঘুরতে ঘুরতে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কোথাও কোনো নিউজ নেই ধর্ষণের নিউজ ছাড়া। আমি পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে থেমে যায় ধর্ষিতার মৃত্যুর গল্প পড়ে, আমি ইউটিউবের ভিডিও দেখতে দেখতে অসহায় হয়ে যায় ধর্ষিতার আর্তনাদে। আমি কোনো এক নিউজে স্পষ্ট দেখতে পাই ” গত ৪৮ ঘন্টায় ১৮ ধর্ষণ!” এমন নিউজ দেখে আমি অবাক হয়। নিজেকে খুব অসহায় লেগেছে। আমি সেই পোস্টটি আমার টাইম লাইনে শেয়ার দিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছিলাম এই সমাজের কাছে। জানতে চেয়েছিলাম কোথায় নারীর অধিকার, কোথায় নারীর নিরাপত্তা। কিছু বিবেকহীন মানুষ সেই প্রশ্নের উত্তরে টেনে এনেছে পর্দা। সেই সমাজকে কিভাবে বোঝায় পর্দা এক জিনিস আর ধর্ষণ আরেক জিনিস। সেই সমাজ কি জানে না পর্দা ইসলামিক বিধান আর ধর্ষণ সমাজের জঘন্যতম অপরাধ। সেই সমাজ কি মানে ধর্ষণের শিকার হয়ে নারী তার সবকিছু হারিয়ে ফেলে। সেই জায়গায় এসে নারী আর বেঁচে থাকার স্বাদ কিংবা সাধ্যের বাহিরে থাকে। নারী সমাজের ভিত্তি। নারী সমাজের সৌন্দর্য।আড়ালেই সুন্দর। তবে পুরুষের উচিত নারীর সৌন্দর্য্যকে সুন্দর হিসেবে গ্রহণ করা। ইতিহাস সাক্ষী নারীর অবদান ছাড়া পুরুষ কখনো এগিয়ে যেতে পারে না। তাই সমাজকে এগিয়ে নিতে নারীর অধিকারকে সম্মান দেওয়া একান্ত জরুরি। সর্বোপরি নারীর প্রতি পশুর মতো আচরণ বন্ধ করতে হবে। নারী কেবল পরিবার বা সমাজ গঠনের অংশ নয়; তারা অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান, গবেষণা, সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। কৃষি থেকে মহাকাশ গবেষণা, চিকিৎসা থেকে প্রযুক্তি, খেলাধুলা থেকে কূটনীতি- প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশে নারীরা গার্মেন্টস শিল্পের বিপ্লব ঘটিয়েছে, উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং প্রসাশন থেকে শুরু করে রাজনীতিতেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। যা একটি দেশ কিংবা বিশ্বের জন্য ইতিবাচক দিক। কিন্তু এই অর্জনগুলো আসলে কতটা নিরাপদ আর মূল্যবান? নারীর অবদানকে গুরুত্ব দিয়ে, উৎসাহিত করে বহুদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাই নারীদের লিঙ্গবৈষম্য থেকে মুক্তি দিয়ে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আসুন নারী দিবসে শুধু প্রতীকী উৎযাপন না করে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করি। সবাই মিলে এগিয়ে যায়, নারী যেন পিছিয়ে না যায়।