বাজেটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বরাদ্দ কমেছে
অ্যাকসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন এর উদ্যোগে ডিজএবিলিটি রাইটস ফান্ডের সহযোগীতায় ১৩ টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনের পক্ষ থেকে ১৩ জুন, বৃহস্পতিবার ২০২৪ “জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থান” শীর্ষক বাজেট পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সভা জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়। সংস্থাগুলো হল প্রতিবন্ধী নারীদের জাতীয় পরিষদ, ডিজএবলড চাইল্ড ফাউন্ডেশন, ন্যাডপো, জয়িতা প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন সংস্থা, সোসাইটি অফ দ্যা ডেফ এন্ড সাইন ল্যাংগুয়েজ ইউজার, বার্ডো, প্রতীক মহিলা ও শিশু সংস্থা, বিপিইউএস, ডিসএবলড ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, বি- স্ক্যান ও ডব্লিউডিডিএফ । অ্যাকসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন এর চেয়ারপারসন মহুয়া পাল এর সভাপতিত্বে আয়োজক সংস্থার পক্ষে অ্যাকসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আলবার্ট মোল্লা বাজেটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বরাদ্দের উপর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেন।
আলবার্ট মোল্লা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে দরিদ্র প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী দরিদ্র প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী ২৯ লাখ থেকে ৩ লাখ ৩৪ হাজার বাড়িয়ে ৩২ লাখ ৩৪ হাজার করায়, প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তির হার উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯৫০ টাকা থেকে ১০৫০ টাকা করায় এবং ন্যাশনাল একাডেমী ফর অটিজম এন্ড নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজএবিলিটি প্রকল্পে ৯৭.৫৮ কোটি টাকা থেকে ১৫০ কোটি টাকার বাজেট করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি প্রতিক্রিয়ায় বলেন, প্রতিবন্ধিতা খাতে বরাদ্দ সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম খাতের মাত্র ২.৮০%( ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ছিল ২.৯৪%) এবং মোট বাজেটের ০.৪৮%(২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ছিল ০.৪৯%)। প্রকৃত পক্ষে এবছর বরাদ্দ কমেছে যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাসিক ভাতা অপরিবর্তিত (৮৫০ টাকা) রয়েছে যা বর্তমান দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি ও জীবন যাত্রার ব্যয় বিবেচনায় খুবই সামান্য। বিগত ৫ বছর ধরে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির সংখ্যা ১ লক্ষই রয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাজেট বরাদ্দ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কেন্দ্রিক। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ধারণায় মন্ত্রণালয় ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ খুবই প্রয়োজন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়ন ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কোন উদ্যোগ বাজেটে নেই। বাজেটে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩, নিউরো ডেভলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন- ২০১৩, নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিফলন নেই।
আলবার্ট মোল্লা তার বিশ্লেষণে বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০১৩ সালের আইন বাস্তবায়ন, জাতীয় সমন্বয় কমিটি কার্যকর, পরিবীক্ষণ জোরদার করা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাসিক সুবিধা তিনহাজার টাকার বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষ বছরের বাজেটেও এর কোন প্রতিফলন নেই। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে কি না তা বোঝা যায় সরকারী ব্যয়ের কত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ, এ বরাদ্দ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পর্যাপ্ত কিনা,সরকারের সকল মন্ত্রণালয়ের ব্যয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তিতে অবদান রাখছে কি না, প্রতিবছর ক্রমান্বয়ে বাজেট বরাদ্দ বাড়ছে কি না, বিদ্যমান অবকাঠামো ও পরিসেবা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রবেশগম্য কি না, বাজেট বরাদ্দ ও অর্থ ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনেকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে কি না। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় বাজেট বিশ্লেষণ করলে এ বিষয়গুলির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
প্রতিক্রিয়া সভায় শারমিন আক্তার দোলন, কর্মসূচী সহ সমন্বয়কারী, ডব্লিউডিডিএফ সরকারের কাছে ১১টি দাবি পুনর্বিবেচনার জন্য তুলে ধরেন যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাসিক ভাতা জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মোতাবেক নির্ধারণ করা, অতি গুরুতর মাত্রার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য কেয়ারগিভারের জন্য ভাতা কার্যক্রম চালু করা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রকল্প গ্রহণ করা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ এবং প্রশিক্ষণ শেষে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ, সরকারি চাকরিতে কোটা বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং বেসরকারি নিয়োগকর্তাদের উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন ধাপে কর রেয়াতের সুবিধা রাখা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চলন ও যোগাযোগ সহজ করতে প্রতিবন্ধিতার ধরন ও চাহিদা মোতাবেক মানসম্পন্ন সহায়ক উপকরণ আমদানির উপর শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং দরিদ্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিনামূল্যে সরবরাহ করার জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা। এছাড়াও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঞ্চয়পত্র, এফডিআর, ডিপিএস এর উপর সকল প্রকার ভ্যাট-ট্যাক্স ও সার চার্জ প্রত্যাহার করা, সকল প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার আওতায় আনতে ও ঝরে পড়া রোধ করতে শতভাগ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে শিক্ষা উপবৃত্তির আওতায় আনা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্যেও আলাদা উপবৃত্তি চালু করা, শিক্ষা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামো ও তথ্যগত প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা সহ শিক্ষা সহায়ক উপকরণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উপযোগী করা, একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কারিকুলামে ইশারা ভাষা ও ব্রেইল পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করা এবং পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপযোগী করতে বাজেট বরাদ্দ রাখা, শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের জন্য বাংলা ইশারা ভাষা ইন্সটিটিউট স্থাপনে বাজেটে বরাদ্দ রাখা, সরকারি ও বেসরকারি সকল ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অবকাঠামোগত ও তথ্যগত প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা, প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য উপযোগী পাওয়ার র্যাম্প বা ম্যানুয়াল র্যাম্পযুক্ত বাস আমদানি এবং তৈরি, প্রবেশগম্য আশ্রয় কেন্দ্র ও গৃহহীনদের আবাসন, সাইনেজ ব্যবহার, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ টার্মিনাল, যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রবেশগম্য করা।
স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে সকল ওয়েবসাইট, সরকারি ই-সার্ভিস, ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্র ইত্যাদির অবকাঠামোগত ও তথ্যগত প্রবেশগম্যতার জন্য বাজেট বরাদ্দ করা, সাধারণ স্বাস্থ্য সেবা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উপযোগী ও প্রবেশগম্য করা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষায়িত স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য মন্ত্রণালয় ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, সহিংসতা ও নির্যাতন হ্রাসকল্পে তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনগুলোর জন্য বাজেট বরাদ্দ, সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের দক্ষতা উন্নয়ন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান কার্যক্রমের বরাদ্দকৃত বাজেট থেকে একটি অংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানে ব্যয় করা, নারীদের দক্ষতা উন্নয়ন, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে যে কর্মসূচী রয়েছে তার প্রত্যেকটিকে উপকারভোগী নির্বাচনে প্রতিবন্ধী নারীদের অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা প্রদান অন্যতম। সভায় বক্তারা সকল দাবির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেন।
সভায় নাজরানা ইয়াসমিন হীরা, কর্মসূচী সমন্বয়কারী, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি তুলে ধরেন।
বদিউল আলম, সভাপতি, ন্যাডপো বলেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা সুবিধা ৮৫০ টাকা, যা দিয়ে একজন মানুষের জীবনধারণ করা কষ্টকর।
আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বেসরকারি সংস্থা, সাংবাদিক, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, সুশীল সমাজ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনের প্রতিনিধি। মহুয়া পালের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে সভার পরিসমাপ্তি ঘটে।
লেখক: আলবার্ট মোল্লা, নির্বাহী পরিচালক, অ্যাকসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন
বিআলো/শিলি