বাস্তুচ্যুতরা কতটা মানবিক সহায়তা পাবে?
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও রাখাইনে আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের তীব্রতা চলমান রয়েছে। সীমান্তের ওপারে রাখাইনের কয়েকটি টাউনশিপে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে এএ’র ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংঘর্ষের তীব্রতায় টিকতে না পেরে রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে পালিয়ে আসছে।
অনেকে মনে করছে, এএ সেসব এলাকায় বসবাসরত রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের ঘরবাড়ি ছাড়া করে দেশত্যাগে বাধ্য করছে; অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে চলমান যুদ্ধে একদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং অন্যদিকে এএ রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসাবে ব্যবহার করে সুপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা নিধন চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা যায়। চলমান সংঘর্ষে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে এএ’র কাছে অনেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে এএ’র সঙ্গে সংঘর্ষের সময় রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক
ধরে তাদের এএ’র সঙ্গে লড়াই করার নির্দেশ দিচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তারা রোহিঙ্গাদের তাদের এলাকায় এএ’র আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষার নামে এএ’র সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে বাধ্য করে আন্তঃসাম্প্রদায়িক সহিংসতা উসকে দিচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাব অনুসারে, ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও এএ-দুপক্ষই তাদের হয়ে লড়াই করতে চাপ দিচ্ছে এবং রোহিঙ্গাদের যুদ্ধক্ষেত্রে মানবঢাল হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
রাখাইন রাজ্যে এখনো প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। বিদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সক্রিয় সংগঠন অভিযোগ করেছে, এএ রাখাইনের বুথিডং শহরে রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করছে। তাদের বাড়িঘর লুটপাট ও সেগুলোয় আগুন লাগানো হয়েছে এবং সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। অনেক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। বুথিডং ও মংডুতে এএ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যকার সংঘর্ষে ১০ হাজার নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। মিয়ানমারের সংঘাতময় পরিস্থিতির বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি দেশ এক যৌথ বিবৃতিতে বেসামরিক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিবদমান সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
এএ জানিয়েছে, তারা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ এলাকায় সরে যেতে সহায়তা করেছে, তবে সেখানে মিয়ানমার জান্তাবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করার অভিযোগ ও সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ জানিয়ে চলমান পরিস্থিতিতে বেসামরিক জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া ও সেখানে মানবিক সহায়তা প্রবেশের সুযোগ দিতে মিয়ানমারের জান্তা ও এএ’র প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক রাখাইন রাজ্যের বুথিডং শহর থেকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গার বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সেখানে অবিলম্বে সংঘাত বন্ধের জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও এএ’কে অনুরোধ জানান। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে বুথিডং শহরে নতুন করে সহিংসতা ও সহায় সম্পত্তি ধ্বংসের ফলে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বেসামরিক লোকজনের সুরক্ষা, অবিলম্বে নিরবচ্ছিন্নভাবে মানবিক সহায়তার অনুমতি দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিধান নিঃশর্তভাবে মেনে চলার জন্য জাতিসংঘ মিয়ানমার সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছে। ফলকার তুর্ক বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশকে নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ রাইটস অফিসের মিয়ানমার টিমের প্রধান জেমস রোডেহেভার চলমান পরিস্থিতিকে ভয়ানক বলে বর্ণনা করেছেন।
জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, রোহিঙ্গা ও রাখাইন একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে আন্তঃসাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আরও বেড়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা জাতিসংঘের। মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরাও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন অন্তত আটটি গ্রাম থেকে রোহিঙ্গাদের জোর করে একটি গ্রামে স্থানান্তরের কথা নিশ্চিত করেছে।
মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল রেপোর্টিয়ার থমাস অ্যান্ড্রুস রাখাইনের চলমান সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে ‘বন্ধ সীমান্ত’ নীতি থেকে সরে আসতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ, দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কাজ করে যাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের উদারতা রোহিঙ্গাদের একমাত্র ভরসা বলে মত প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের স্পেশাল রেপোর্টিয়ার বাংলাদেশের ভেতরের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পরিস্থিতি উন্নয়নে জরুরি তহবিল নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য বিশ্বের সব রাষ্ট্রের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে। থমাস অ্যান্ডুস রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এএ’র ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ ঘটনার অবসানের আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের রাইটস অফিসের মুখপাত্র এলিজাবেথ থ্রোসেল জানিয়েছেন, সংঘাত-বিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার মধ্যে আরাকানের বুথিডাং ও মংডু শহরের কয়েক হাজার বেসামরিক লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। রাখাইন রাজ্য থেকে সম্প্রতি
প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে প্রায় ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা নাফ নদীর তীরে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অপেক্ষা করছে। এলিজাবেথ থ্রোসেল আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য মিয়ানমার সরকার ও এএ’কে আহ্বান জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায়ের জরুরি হস্তক্ষেপ ও সমর্থন ছাড়া এ সংকট মোকাবিলার সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। ত্রাণ সহায়তা হ্রাসের ফলে রেশন কর্তন, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সহিংসতা এবং রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জীবন হুমকির মুখে ফেলেছে।
বাংলাদেশ সীমান্তজুড়ে থাকা মিয়ানমারের সীমান্ত চৌকিগুলো বর্তমানে এএ’র দখলে। এএ পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মিয়ানমারের রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে ভবিষ্যতে আরাকান রাজ্য গড়ে তুলতে চায়। এএ’র মূল শক্তি হলো রাখাইনবাসীদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয়
সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অঙ্গীকার। সংকটময় এ পরিস্থিতিতে এএ’র দূরদর্শিতা তাদের সামনের দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।
সীমান্তের এপারে কক্সবাজার এলাকায় জাতিসংঘ ও অন্যান্য সাহায্য সংস্থা গত সাত বছর ধরে তাদের পেশাগত দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কাজ করছে। তারা রাখাইন পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত রয়েছে। চলমান প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ, ইউএনএইচসিআর, আইওএম এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা এএ’র সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে রাখাইনে বাস্তুচ্যুতদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল ও একটা মানবিক করিডর স্থাপন করে নির্যাতনের শিকার পালিয়ে আসা মিয়ানমারের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে উদ্যোগ নিতে পারে। কক্সবাজারের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থেকে অতি সহজে এ কার্যক্রম তারা পরিচালনা করতে পারবে। এএ-ও এ কাজে তাদের সহযোগিতা করবে; কারণ, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রয়োজন।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার সঙ্গে মিলে এএ এই সহায়তা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে শুধু রাখাইনের জাতিগত সশস্ত্রগোষ্ঠী হিসাবে তাদের পরিচয়ের বাইরে নিজেদের রাখাইনের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে প্রমাণ করতে পারবে। এর পাশাপাশি এএ’র কাছে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রকাশ পেলে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সামনের দিনগুলোয় আন্তর্জাতিক সহায়তা পেতে তা কাজে লাগবে।
বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের সহায়তা প্রদানে দাতা সংস্থাগুলো চাপে রয়েছে; তাই নতুন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মিয়ানমারের নাগরিকদের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ সরকার সীমান্তে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। সীমান্ত দিয়ে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় বান্দরবান সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্ত এলাকায় সীমান্ত চৌকি ও স্থাপনাগুলোয় বিজিবির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং সীমান্ত এলাকায় টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় বসানো সিসি ক্যামেরায় সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে এবং বিজিবির পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান মানবিক বিপর্যয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুততার সঙ্গে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ২০১৭ সালের নৃশংস ঘটনা তাদের পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আগে সতর্ক হতে শিখিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশ নানা সীমাবদ্ধতা থাকার পরও মানবিক দিক বিবেচনায় কতটুকু উদার ছিল, তা বুঝতে পেরেছে। তারা বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের উদারতার অনুপস্থিতি অনুভব করছে। চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাস্তুচ্যুতদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল এবং একটি মানবিক করিডর স্থাপন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। রাখাইনের চলমান মানবিক সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ সংকট মোকাবিলা করতে পারে। রাখাইনের অভ্যন্তরে কাজের এ অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে। রাখাইন রাজ্যের এএ’র নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ সংকটের সমাধানে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো এগিয়ে আসবে- এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন : মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক
বিআলো/শিলি