বিএনপি ও তারেক রহমান: আস্থা, অনাস্থার নানা প্রশ্ন
ঠিক দুই মাস আগেও, বাংলাদেশের মানুষ এভাবে ভাবেনি, এতকিছু ভাবেনি! বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় ঘুরে এখন অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। কিছুদিন আগেও সবাই হাসিনা যা করতো, যা বলতো তাই গোগ্রাসে গিলতো মানুষ। আসলে মানুষকে গেলানো হতো। আমাদের কোনো উপায় ছিল না বলে বলতে পারতাম না। নতুন করে পাওয়া স্বাধীনতা উপভোগ করছে সবাই। এতদিন যে কথাগুলো কেউ বলতে পারেনি, তাই বলতে শুরু করেছে মানুষ। বিগত ১৬ বছরে মানুষ আওয়ামী লীগের সমাবেশের বিপক্ষে কিংবা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নিয়ে কেউ পোস্ট করলে আক্রমণ করার সুযোগ পেতো না, কিন্তু এখন সেই সুযোগটা পেয়েছে। বিএনপির সমাবেশ করা নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করেছে, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে। প্রথম কথা হচ্ছে, বিএনপির এগুলো শুনতে হবে। সমালোচনা শোনার বা হজম করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
বাংলাদেশের ব্যক্তি হিসেবে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে? এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিবর্তন হলেই যে সরকার প্রধানের জায়গায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বসতে যাচ্ছেন, সেটা অনেকটাই নিশ্চিত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলগতভাবে বিএনপিকে এতটাই ভয় পেতো যে বিএনপির ভোট ব্যাংকের সাথে যুদ্ধ করার সাহস তাদের ছিল না। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি যদি কোনো বড়সড় ভুল না করে আর সবকিছু যদি হিসাব মোতাবেক আগায় তাহলে বিএনপিই রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসবে। তারেক রহমান হয়তো আসীন হবেন সর্বোচ্চ পদে। দেশের মানুষ এখন তার দিকে তাকিয়ে। আসলে রাজনৈতিক বাস্তুবতায় একটা তৃতীয় দাঁড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই দেশ তারেক রহমানকেই হয়তো চালাতে হবে। সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে যে তিনি কোন পথে দেশ চালাবেন। দেশের সকলের রাজনীতি করার পথ বন্ধ করে দিয়ে একা রাজনীতি করার পিছনে দৌড়াবেন নাকি সবাইকে নিয়ে একটা সুন্দর রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করবেন!
যদি বিএনপি একা ক্ষমতায় যায়, তাহলে নানাভাবে তাদের ভুলগুলোকে বড় করে দেখার অনেক সুযোগ তৈরি হবে, অনেক গ্রুপ তৈরি হবে। দেশের যা অবস্থা, চাইলেই হুট করে দেশকে বদলে দেওয়া যাবে না। কিন্তু মানুষ সেই সময় নাও দিতে পারে, মানুষের অস্থির হয়ে যাওয়ার প্রবণতা অনেক। এজন্য দেশে গনহত্যা, দুর্নীতি, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার জন্য আইনগতভাবে বা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগকে বাহিরে রাখলেও বিএনপির উচিত হবে, অন্য সবাইকে সাথে নিয়ে কাজ করা। এবং দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যে তারেক রহমান তা বলার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে এটাই যে তারেক রহমান সেই বিষয়টা অনেক ভাবেই ভেবে রেখেছেন। বিএনপির দেওয়া ৩১ দফা কিন্তু সেটারই ইঙ্গিত দেয়। সেখানে জাতীয় সরকার গঠন, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষদের নিয়ে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের ইচ্ছা তারেক রহমান আগেই প্রকাশ করে রেখেছেন।
বর্তমান তরুণ প্রজন্ম অনেক উচ্চ ধারার চিন্তাভাবনা করে। তাদের মনের সাথে মিশে যেতে হলে তাদের মতো করে কথা বলতে হবে। সেই কাজটা একদম সঠিকভাবেই করছেন তিনি। তার প্রত্যেকটা বক্তব্য মানুষের কাছে পছন্দনীয় হয়েছে। বিএনপির অন্য অনেকের কথাবার্তায় বা কাজে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে কিন্তু তারেক রহমানের ক্ষেত্রে সেটা ব্যতিক্রম। তার ইতিবাচক কথাগুলোকে সবাই ইতিবাচক ধরেও যদি আগায়, তারপরও কিছু প্রশ্ন কিন্তু থেকে যায় মানুষের মনে। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হবে আগামী নির্বাচনের আগেই। একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার, হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই একটা দল উঠেপড়ে লেগেছে ভোগ দখল ক্ষমতা হস্তান্তর চাদাবাজি করতে। দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে হুঁশিয়ারি বা বিভিন্ন কাজ করে কমানো গেলেও একদম শেষ কিন্তু করা যাচ্ছে না।
মানুষের মনে একটাই প্রশ্ন দানা বেঁধে উঠেছে, আপনারাও যদি একই কাজ করেন তাহলে আওয়ামী লীগের পতন কেন করলাম? আপনাদের কেন ভোট দিব? মূলত এই মানুষগুলো বিএনপির বিপক্ষে কাজ করছে বলেই মনে হচ্ছে, এদের এসব কর্মের ফলে বিএনপিকেও আওয়ামী লীগের সাথে একই কাতারে আনার সুযোগ পাচ্ছে অনেকেই। অথচ বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার বিএনপি। অগণিত অসংখ্য খুন, গুম, বিচারভির্ভূত হত্যায় জর্জরিত করা হয়েছে দলটিকে। মানুষ সেগুলো জানে, এসবের জন্য মানুষের বিএনপির প্রতি যথেষ্ট মমতা রয়েছে। কিন্তু এই দখলদারিত্বের খেলায় যেন অন্য একটা গ্রুপ সেগুলোকে ঢেকে দেওয়ার যেন সুযোগ না পায়। প্রথমত, যারা এসব কর্মকান্ড করছে তাদেরকে রুখতে হবে। বিএনপি দলগতভাবে বহিষ্কার করছে, এমনকি মামলাও দিচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন এখন পরিপূর্ণভাবে চালু হয়নি, আর বিএনপি এসব করলে প্রশাসনেরই লাভ, প্রশাসনের অনেকেই হাসিনারই দোসর। তাই এদেরকে রুখতে হলে প্রয়োজনে নিজেদেরই একটা টিম গঠন করতে হবে এলাকায় এলাকায়।
বিএনপি তথা তারেক রহমান যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিচ্ছেন সেগুলো ইতিবাচক। কিন্তু মানুষ কথায় কীভাবে বিশ্বাস করবে? মানুষকে তো কাজ দেখাতে হবে। কাজ দেখানোর সময় কি শুধুই সরকারে থাকলে? সরকারে না থাকলে বিএনপি কি কিছুই করতে পারে না? বিএনপির সারাদেশে লাখো লাখো নেতাকর্মী আছে। এত জনবল এই মুহুর্তে কারো নেই। এই জনবল কাজে লাগিয়ে যদি জনমত গঠন না করা যায় তাহলে দল আস্তে আস্তে পিছাতে থাকবে, অন্য কেউ দাঁড়িয়ে যাবে। সভা, সমাবেশ, মিছিল, শো ডাউনের মতো কার্যক্রম কমিয়ে এনে জনহিতৈষীমূলক কর্মকান্ডের দিকে এগিয়ে আসতে হবে। কাজ অনেক আছে, সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে। দেশ সংস্কারের লক্ষ্যে এখনই বিএনপির একটা কর্মসূচী ঘোষণা দেওয়ার সময়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আদর্শকে ধারণ করে এমনই অনেক কাজ আছে যা এই মুহূর্তে বিএনপিকে আমূলে বদলে দিতে পারে। দেশের কৃষি ক্ষেত্র, ক্রীড়া ক্ষেত্র, সামাজিক সংস্কার। সাংস্কৃতিক বিপ্লব সহ অনেক কাজ আছে যা সরকারে না থেকেও করা যায়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের মহাসমাবেশে যে বক্তব্য রেখেছেন তা সর্ব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। বক্তব্যের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিবাচক দিক রয়েছে যা বিএনপির অবস্থান ও উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে: জনাব তারেক রহমানের বক্তৃতা গণতন্ত্রের প্রতি বিএনপির প্রতিশ্রুতিকে পুনর্ব্যক্ত করে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার জনগণের সরকার এবং তা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে দায়বদ্ধ থাকবে। এই মন্তব্যটি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে।
তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা এবং অগ্রাধিকার চিহ্নিত করেছেন। নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন, এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংস্কারের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার গুরুত্ব তিনি তুলে ধরেছেন। এই সংস্কার কার্যক্রমগুলি জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।
তিনি বারবার জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কথা বলেছেন। তিনি বলেন যে, অবাধ, সুষ্ঠু, এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। এর মাধ্যমে একটি কার্যকর এবং সুষ্ঠু সরকার গঠন সম্ভব হবে। তার বক্তব্যে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার গুরুত্বও প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি জনগণের কাছে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার এবং ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করেছেন, যা দেশের ঐক্য ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয়।
তিনি মন্তব্য করেছেন যে, অব্যাহতভাবে কিছু অপশক্তি অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করছে। এই সতর্কবার্তাটি রাজনৈতিক পরিবেশের প্রতি বিএনপির সচেতনতার পরিচায়ক এবং সরকারের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ইঙ্গিত দেয়। তার বক্তব্য প্রমাণ করে যে বিএনপি একটি কার্যকর এবং জনপ্রিয় সরকারের গঠন এবং জনগণের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তার বক্তব্যের মাধ্যমে দলটি সংস্কার কার্যক্রমের গুরুত্ব, জনগণের ক্ষমতায়ন, এবং রাজনৈতিক সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাদের পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করেছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় দেওয়া তার বিভিন্ন বক্তব্য এখন সর্বমহলে আলোচিত হচ্ছে। তার একটি বক্তব্যে ‘ফ্যামিলি কার্ড’ দেওয়ার উদ্যোগে যেভাবে প্রতিটি পরিবারকে স্বাবলম্বী করার পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে, তা অত্যন্ত সময়োপযোগী। বর্তমান আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এ ধরনের পদক্ষেপ মানুষের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
আরেকটি বক্তব্যে তিনি বলেছেন, কৃষি নির্ভর উৎপাদনশীলতা এবং রপ্তানি মুখি পরিকল্পনা সেই সাথে সঠিক ব্যবস্থাপনা একটি দেশের অর্থনীতিকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। রপ্তানিমুখী বাংলাদেশ গড়তে চায় বিএনপি। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তি ও গবেষণার সংমিশ্রণে কৃষকের হাতে আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে তারা অধিক উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। ফলস্বরূপ, কৃষি থেকে প্রাপ্ত পণ্যগুলি দেশের অভ্যন্তরে নয়, আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। রপ্তানি মুখী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমাদের কৃষিপণ্যগুলির মান উন্নয়ন ও বাজার গবেষণা প্রয়োজন। বাংলাদেশের কৃষি পণ্যগুলি যেমন, পাট, চিনি, মাছ এবং সবজি আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটি সহায়ক হবে।
তারেক রহমানের কথায় মানুষ যেমন মুগ্ধতা পাচ্ছে, তেমনি তার নেতাকর্মীদের কার্যক্রমে তার সুন্দর কথাগুলো ফুটে উঠতে হবে। বর্তমান বাংলাদেশের বিএনপি তথা তারেক রহমানের হাতে অনেক দায়। সেই দায়িত্ব পালন করা তার কর্তব্য।
মাহবুব নাহিদ
লেখক, কলামিস্ট
বিআলো/তুরাগ