বিনোদনের নামে অশ্লীলতার বিস্তার : ধর্মীয় ও সামাজিক চেতনার পুনর্জাগরণের প্রয়োজন
কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী: ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি একদিকে যেমন জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করেছে, তেমনি বিনোদনের নামে সমাজে এক অশ্লীলতার জোয়ার বইয়ে দিয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ইত্যাদি মাধ্যমগুলোতে কনটেন্ট ক্রিয়েটররা কখনো জনপ্রিয়তা, কখনো মনোযোগ, আবার কখনো আর্থিক মুনাফার আশায় শালীনতার সীমা অতিক্রম করে চলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো-পৃথিবীর কোনো ধর্ম কি এই নগ্নতার অনুমোদন দেয়? উত্তর হলো-না। বরং প্রতিটি ধর্মই লজ্জাশীলতা ও আত্মসংযমকে মানবিক গুণরূপে চর্চার নির্দেশ দেয়।
ধর্মীয় নির্দেশনা আলোকে আমরা চারটি করণীয় প্রস্তাবনা উপস্থাপন করতে পারি- অশ্লীলতার প্রতিকারে।
১.ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক চর্চার পুনর্জাগরণ-
ধর্মীয় শিক্ষার অভাবই অশ্লীলতা ও অনৈতিকতার শেকড়। প্রতিটি ধর্মই শালীনতা ও সংযমকে মানবিক গুণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ইসলাম ধর্মে : ‘লজ্জাশীলতা ঈমানের একটি শাখা’-সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৫। ‘তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থান রক্ষা করে’-সূরা নূর, আয়াত ৩০-৩১। হিন্দু ধর্মে : ‘লজ্জা নারীকে শোভা দেয়। যে নারী লজ্জাহীন, সে পরিবার ও সমাজকে ধ্বংস করে’-মনু সংহিতা, অধ্যায় ২, শ্লোক ২১৫। খ্রিষ্টান ধর্মে : ‘নারীরা যেন শালীন পোশাকে নিজেদের সাজায়, লজ্জাশীলতা ও আত্মসংযম দিয়ে’- ১ তিমথিয় ২:৯। বৌদ্ধ ধমের্ : ‘হিরি ও ওত্তাপ – লজ্জাবোধ ও ভয়ের চেতনা না থাকলে জীব কুকর্মে লিপ্ত হয়’-ধম্মপদ। ইহুদি ধর্মে : শালীনতা- ইহুদি নারীদের জন্য এটি একটি দৈনন্দিন ধর্মীয় দায়িত্ব। অতএব, পাঠ্যসূচিতে ধর্মীয় নৈতিকতা ও আদর্শ পোশাকচর্চার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য। মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগোপযোগী ধর্মীয় চেতনার পুনর্গঠন প্রয়োজন।
২.সোশ্যাল মিডিয়া নীতিমালা কঠোরকরণ-
আজকের অশ্লীলতার বড় উৎস হলো খোলা ও নিয়ন্ত্রণহীন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটক ইত্যাদির `Reels’ ও `Shorts’ বিভাগে প্রায়শই অর্ধনগ্ন ও উদ্দীপক কনটেন্ট ছড়ায়, যার দর্শকপ্রিয়তা অপ্রতিরোধ্য। অশালীন পোশাকের `Challenge’, `Dance Trend’, `Couple Prank’ইত্যাদি ভিডিওর মাধ্যমে সমাজে কামপ্রবণতা বাড়ছে। প্রস্তাবনা : রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে `Digital Shalinity Regulation Act’ প্রণয়ন ও প্রয়োগ। কনটেন্ট মনিটরিংয়ে ধর্মীয় চিন্তাবিদ ও নৈতিক বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ততা। `Community Reporting’ ব্যবস্থা জোরদার করে অশ্লীল কনটেন্টকে বাদ দেওয়া।
৩.ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও চিন্তাবিদদের সক্রিয় ভূমিকা-
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং আলেম, পুরোহিত, ফাদার, রাব্বিদের উচিত জনগণকে এই অপসংস্কৃতি থেকে ফিরিয়ে আনার কার্যকর ভূমিকা পালন করা। মসজিদে খুতবায়, মন্দিরে পুরাণ শ্রবণে, গির্জায় উপদেশে, বৌদ্ধ বিহারে ধর্মদেশনায় এই বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি। তরুণদের জন্য আন্তঃধর্মীয় ‘নৈতিকতা ও আত্মগঠন বিষয়ক কর্মশালা’ আয়োজন হতে পারে। ধর্মীয় চেতনার জাগরণই হচ্ছে মূল্যবোধ রক্ষার প্রথম প্রহরী।‘যখন লজ্জাশীলতা বিলুপ্ত হয়, তখন যা ইচ্ছা মানুষ তাই করে’-সহীহ বুখারী।
৪.পারিবারিক পরিবেশে শালীনতা চর্চার সংস্কৃতি গঠন-
পিতামাতা ও অভিভাবকেরা সন্তানদেরকে যদি ছোটবেলা থেকেই নৈতিকতা ও শালীনতা শেখান, তাহলে তারা সামাজিক চাপের মুখেও আত্মিক সুরক্ষা বজায় রাখতে পারবে। প্রস্তাবনা : সন্তানদের জন্য ইসলামি/ধর্মীয় গল্প, চরিত্র নির্মাণমূলক সিনেমা দেখানো। অশ্লীল দৃশ্য বা পোশাক দেখে পরামর্শমূলক আলোচনার পরিবেশ তৈরি। পরিবারের মধ্যে ধর্মীয় আচারচর্চার পরিবেশ সুদৃঢ় করা।
মোদ্দা কথা : বিনোদনের নামে নগ্নতা ও উলঙ্গতার বিস্তার শুধুই এক ধরনের দৃষ্টিবিভ্রম নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আত্মপরিচয়হীন, ভোগবাদী ও অসংযমী করে তুলছে। কোনো ধর্ম এ ধরনের উলঙ্গতার অনুমোদন দেয় না। বরং প্রতিটি ধর্মের হৃদয়কেন্দ্রে রয়েছে লজ্জা, সংযম ও মানবিক মর্যাদা। এই অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে আমাদের প্রয়োজন- ধর্মীয় ও পারিবারিক নৈতিক পুনর্জাগরণ, ডিজিটাল নীতিনিয়ন্ত্রণ, এবং বিনোদনের নামে অনাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক জাগরণ।
লেখক : সাহিত্যিক, গবেষক ও আন্তঃধর্মীয় বিশ্লেষক
বিআলো/সবুজ