বিল্ডিং অ্যাক্ট না মেনে ভবন তৈরি: ঢাকায় ৭৪ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, সামনে ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা
রাজউকের উদাসীনতা আইন আছে, প্রয়োগ নেই
মানা হয় না বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড
অপরিকল্পিত নগরায়ণ পুরো ঢাকা শহর
ভবন নির্মাণের পর বাধ্যতামূলক সনদ নিতে আগ্রহী নয় — নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ
ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কি না, আমরা সতর্ক করতে পারি। ভবন ভাঙতে পারি না — প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
রতন বালো: একটি নিরাপদ ও টেকসই ভবন গড়ে তুলতে শুধু ভালো ডিজাইন বা মানসম্মত উপকরণই যথেষ্ট নয়। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইন, নিয়ম ও মানদণ্ড মেনে চলা জরুরি। বাংলাদেশে এই মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)। এটি এমন একটি গাইডলাইন, যা ভবন নির্মাণ, ডিজাইন, সুরক্ষা এবং ব্যবহারে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম মোল্লার গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই।
এসব বিষয়ে যাদের দেখভাল করার কথা তারাই টাকার কাছে করেন আত্মসর্মপণ। তাই দিন দিন শহরে নগরে গড়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। গত শুক্রবার ৫.৭ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প তারই মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে গেল। সেখানে কেবল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ১ হাজার ৬৬টি ভবন ধসে পড়ে। আবার অনেক ভবন হয়ে পড়েছে ঝুঁকিপূর্ণ। তবে কর্তৃপক্ষের কানে জল গিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। তারা এখন মৃদস্বরে বলতে শুরু করেছেন বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
এদিকে রাজধানীতে বিল্ডিং অ্যাক্ট না মেনে কতগুলো ভবন তৈরি হয়েছে তারা কোন সুনির্দিষ্ট তালিকা নগরভবনের কাছে নেই। যদিও ভবন তৈরির আগে তাদের কাছ থেকে অনুমতি নেবার বিধান রয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, পুরো ঢাকা শহরটিই অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ভূমিকম্পের ঝুঁকি এবং নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসন সংকটের কারণে সামগ্রিকভাবে ঝুঁকির মধ্যে আছে।
গত ২১ নভেম্বর ভূমিকম্পে ভবন ধসে পড়ার ঘটনা সেটিকে স্পষ্ট করেছে। এদিকে সামনে বড় ভূমিকম্প হলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিষেশজ্ঞরা। তারা বলেছেন, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই এই শহরে গড়ে উঠেছে লাখ লাখ ভবন। রাজউকের ভাষ্যমতে, শহরের ৭৪ শতাংশ ভবন গড়ে উঠেছে নকশাবহির্ভূতভাবে। বাকি ২৬ শতাংশ ভবনের অবস্থা ঠিকঠাক। নকশাবহির্ভূত এসব ভবনে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি। ফলে রাজধানী পরিণত হয়েছে এক ঝুঁকিপূর্ণ মৃত্যুপুরী।
যা বলেছে ফায়ার সার্ভিস: ফায়ার সার্ভিস বলছে, রাজধানীর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভবনে অগ্নিনির্বাপণের কোনও ব্যবস্থা নেই। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ভবন পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করে। এতে ২ হাজার ৬০৩টি অগ্নিঝুঁকি ভবন চিহ্নিত করা হয়। ৫৮টি বিপণিবিতানের সবকটিই কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৩৫টি, মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ ১৪টি এবং অতিঝুঁকিপূর্ণ পাওয়া যায় ৯টি।
তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে সারা দেশে ২৫২টি সরকারি এবং ৯২৯টি বেসরকারি মিলিয়ে ১ হাজার ১৮১টি বহুতল ভবন (৬ তলার ওপরে) পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। ওই সময় ৩৬৭টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ও ৭৪টিকে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ভবন মালিকসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সুপারিশ পাঠানো হলেও কেউ বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয় না।
এদিকে গত বছরের ২১ এপ্রিল ‘আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্প: রাজউক অংশ’ নামে একটি প্রকল্পের আওতায় ঢাকা অঞ্চলের ২১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩০টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে। আবার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করেছে। এসব ভবনের সামনে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ লেখা সাইনবোর্ড টানানোর নির্দেশ দিয়েছিল সরকার। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলার সুপারিশও করা হয়েছিল। কিন্তু শ্রেণিকক্ষ সংকট ও পাঠদানে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ার অজুহাতে বেশির ভাগ ভবন এখন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। আর সরকারের দপ্তর ঘোষণা দিয়েই তাদের দায় শেষ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজউক গত এক দশকে যতগুলো ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে এবং ভবন ভাঙার নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দিয়েছে তার ৪ ভাগের একভাগ ভবনও অপসারণ বা ভাঙা হয়নি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, আরবান রিজিলিয়েন্স প্রকল্পের (ইউআরপি) আওতাধীন ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত হওয়া কবি নজরুল কলেজের একটি ছয়তলা ভবন এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি ভবন।
এছাড়া পুরান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী কলেজের পাশে একটি দোতলা ভবনসহ পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে রাজউক চিঠি দিয়েছিল। তবে বছর পার হলেও তার কোনও সুরাহা হয়নি। এভাবে রাজধানীতে হাজারো ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত ভবনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন লাখো মানুষ।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের গাফিলতি : রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণে রাজউক এবং সিটি করপোরেশনের গাফিলতি স্পষ্ট। বছরের পর বছর নানান ধরনের উদ্যোগের কথা বললেও আদতে তার কানাকড়িও বাস্তবায়ন করতে পারে না কর্তৃপক্ষ। ফলে দিন দিন ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। নগরবাসীও এ নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কায় আছেন।
যা বলছেন নগরবিদরা: ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করেও অপসারণ করতে না পারা রাজউক এবং সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতা। এ ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকির শঙ্কা রয়েছে। বলে মনে করেন নগরবিদরা। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (অ.দা.) হাছিবা খান বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন বা কোনও প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ভবনের বিষয়ে তো আমাদের কিছু করার থাকে না। আমরা কেবল ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কি না, সে বিষয়ে সতর্ক করতে পারি। কিন্তু ভবন ভাঙতে পারি না। সেই সক্ষমতা একমাত্র রাজউকের আছে, আমাদের নয়।
উদাহরণস্বরূপ এই কর্মকর্তা বলেন, কিছু দিন আগে ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি ভবন হেলে পড়েছে। আমরা সেখানেও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংবলিত ব্যানার টানিয়েছি। এখন সেই ভবন কীভাবে অপসারণ করা হবে বা কবে নাগাদ করা হবে এটা সম্পূর্ণ রাজউকের ওপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণে রাজউক ও সিটি করপোরেশনের টালবাহানা স্পষ্ট। এ নিয়ে সবসময় এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়। রাজউক বিগত সময়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার বিন্দুমাত্র পূরণ করতে পারেনি। চেয়ারম্যান এসেছেন আর গিয়েছেন। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণ হয়নি।
রাজউক ও তার হবুচন্দ্রের আইন: রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী এবং মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার (অব.)। বারবার রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন উচ্ছেদ করার কথা বলছেন। কিন্তু কাজের কাজ আর কিছুই হয়নি। কেবল নোটিশেই তাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ ছিল। দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি বলেছিলেন, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে সাড়ে ৩ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙতে মাঠে নামছে রাজউক। পুরান ঢাকার সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। তবে তৎকালীন এই চেয়ারম্যানের কথার ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়ন হয়নি।
বর্তমান রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম- এর সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগ করা হলে তার কোন সাড়া নেই।
তবে রাজউকের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার (অব.) রাজধানীতে চিহ্নিত অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবন মালিককে নোটিশ দিলেও আদতে সেই নোটিশেই সীমাবদ্ধ ছিল কার্যক্রম। ভবন ভাঙার বিষয়ে আর কোনও পদক্ষেপ নেননি তিনি।
এদিকে রাজধানীর বেইলি রোডের একটি বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর ভবন ব্যবহারে বহু ধরনের অনিয়ম ও গাফিলতির তথ্য উন্মোচিত হচ্ছে। রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমোদন না থাকার পরও অগ্নিনিরাপত্তাহীন এই ভবনে আটটি রেস্তোরাঁ চলছিল বছরের পর বছর ধরে।
অথচ বিধি অনুসারে নির্মাণ শেষে ওই ভবনটি ব্যবহার শুরুর আগে রাজউক থেকে বাধ্যতামূলক সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) নেওয়ার কথা ছিল মালিকের। সেটা হলে ভবনটি কী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে কিংবা এর নকশা অথবা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না, তা রাজউকের নজরে আসত। এতে হয়তো মর্মান্তিক, প্রাণঘাতী এই দুর্ঘটনাটি এড়ানো যেত।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ এবং নগর গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, রাজউককে মানুষ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা হিসেবে চেনে। এখানে নকশা অনুমোদন থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে যে ভোগান্তির ভেতর দিয়ে যেতে হয় গ্রাহককে, তাতে ভবন নির্মাণের পর অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিতে তারা আগ্রহী হন না। আবার নানা কারণে রাজউকের দিক থেকেও এটা নজরদারি করা হয় না।
এদিকে ২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ নির্মাণ শেষের পরে তা ব্যবহার বা বসবাসের জন্য সনদ নিতে হবে। এই সনদ পাওয়ার আগে ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। এই ব্যবহার বা বসবাস সনদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। পাঁচ বছর পরপর এটি নবায়নও বাধ্যতামূলক।
এ বিষয়ে নগরপরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বিআইপি সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ভবনের কাজ শেষ হলে রাজউক দেখবে সেটা নকশা অনুসারে নির্মিত হয়েছে কি না। সেটা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট পাওয়ার প্রথম শর্ত। কিন্তু এটা পাওয়ার পর কেউ কেউ তো সেটা পরিবর্তন করে ফেলতে পারেন।
বিআলো/তুরাগ



