বিশ্ব জলবায়ু প্রভাব নিয়ন্ত্রণ ও কপ সম্মেলনের অবদান, বিশ্ব জলবায়ু প্রভাব নিয়ন্ত্রণ
কাঞ্চন কুমার দে: জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের জন্য একটি গুরুতর হুমকি। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে। এই প্রভাবগুলো মোকাবেলায় জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:
কার্বন নিঃসরণ হ্রাস : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হলো কার্বন নিঃসরণ। তাই কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এজন্য, আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে পারি।
বনায়ন করা : বনায়ন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং বায়ুমণ্ডল থেকে তা সরিয়ে দেয়। তাই বনায়ন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা : জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য আমরা বিভিন্ন প্রচারণা ও কর্মসূচি পরিচালনা করতে পারি।
কপ সম্পেলন : জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতিসংঘের আওতায় কপ (ঈড়হভবৎবহপব ড়ভ ঃযব চধৎঃরবং) নামে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন।
কপ সম্মেলন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও, কপ সম্পেলনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের জন্য কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কপ সম্মেলনের কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন কপ ১৫ (প্যারিস, ২০১৫) : এই সম্মেলনে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
কপ ২৬ (গ্লাসগো, ২০২১) : এই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এছাড়াও, এই সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা করার জন্য একটি ফান্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কপ সম্পেলনের চ্যালেঞ্জ : কপ সম্পেলন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তবে, এই চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অনেক দেশের অগ্রগতি যথেষ্ট নয়। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা করার জন্য গঠিত ফান্ডের পরিমাণ যথেষ্ট নয়।
কপ সম্মেলনের ভবিষ্যৎ : কপ সম্মেলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব বুঝতে পারছে এবং তারা এই সমস্যা মোকাবেলায় আরও বেশি পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
কপ সম্পেলন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের জন্য কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এবং এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো হয়।
কপ সম্পেলনের ভবিষ্যতে আরও বেশি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা আরও কঠোর করা। ক্ষতিগ্রস্ত দেশকে সহায়তা করার জন্য গঠিত ফান্ডের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো। এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে কপ সম্পেলনের ভূমিকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে।
কপ সম্পেলনের ভবিষ্যতের কিছু সম্ভাব্য সুফল
বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হবে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে। এই সুফলগুলো বাস্তবায়িত হলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলো মোকাবেলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে সহায়তা করবে।
বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হবে কিনা তা নির্ভর করে বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর।
প্রথমত, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারকে তাদের কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রাগুলো পূরণ করতে হবে। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে, বিশ্বের দেশগুলো ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমাবদ্ধ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলো। কিন্তু ২০২২ সালের হিসাবে বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ এখনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে তাহলে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে।
দ্বিতীয়ত, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো দরকার। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, যেমন সৌর এবং বায়ুশক্তি, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে সাহায্য করে। ২০২২ সালে, বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে এটি এখনও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের তুলনায় অনেক কম। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার আরও বাড়াতে পারলে বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করা সম্ভব হবে।
তৃতীয়ত, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা করা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো সবচেয়ে বেশি অনুভব করে এমন দেশের মধ্যে রয়েছে নিম্ন আয়ের দেশ। এই দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা দরকার।
এই বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিলে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হবে। তবে, এটি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে, এবং এটি সময়, প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন হবে।
কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা আরও কঠোর করা
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারকে তাদের কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা আরও কঠোর করতে হবে। ২০২৩ সালের হিসাবে, বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ এখনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে।
কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা আরও কঠোর করার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো : জীবাশ্ম জ্বালানি। যেমন কয়লা, তেল এবং গ্যাস, কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রধান উৎস। তাই, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করা সম্ভব।
জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তি দক্ষতা উন্নত করা : শক্তি দক্ষতা উন্নত করলে একই পরিমাণ কাজের জন্য কম শক্তির প্রয়োজন হয়। তাই, শক্তি দক্ষতা উন্নত করার মাধ্যমেও কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করা সম্ভব।
শক্তি দক্ষতা : কার্বন ক্যাপচার এবং সঞ্চয় (ঈঈঝ) প্রযুক্তি ব্যবহার করা : ঈঈঝ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডল থেকে সরিয়ে নেওয়া এবং সংরক্ষণ করা সম্ভব। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করা সম্ভব।
কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা আরও কঠোর করা :
কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা আরও কঠোর করা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।
লেখক : জলবায়ু গবেষক ও সাংবাদিক
বিআলো/তুরাগ