বেসামাল ময়লার গাড়ি, নিয়ন্ত্রণহীনতায় ঘটছে দুর্ঘটনা
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ সম্প্রতি গত বৃহস্পতিবার মতিঝিল সরকারি আইডিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মাহিন আহমেদ (১৩) গাড়িচাপায় নিহত হয়। এ নিয়ে গত তিন বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় অন্তত ১৩ জনের প্রাণ গেছে। এর কারণ সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়িগুলোর চালকরা বেপরোয়া। সড়কে চলা মানুষ ও যানবাহনকে কিছুই মনে করেন না তারা। কোনো নিয়মকানুনের ধার ধারেন না। মানেন না ট্রাফিক আইন। ইচ্ছামতো গাড়ি চালান। চালকদের এমন বেপরোয়া ও উগ্রতার কারণে সংস্থার গাড়িগুলো প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। মারা যাচ্ছে মানুষ। বিভিন্ন সময় মেয়র দক্ষ চালক নিয়োগে আশ্বাস দিলেও সংকটের সমাধান হয়নি।
পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, বিশেষজ্ঞ ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের মতে, এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মূলত সিটি করপোরেশনের বর্জ্য পরিবহন ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা। অতীতে একাধিক দুর্ঘটনার তদন্তে গাড়িচালকদের গাফিলতি পাওয়া গেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও সংস্থাটির পরিবহন বিভাগের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। একই সঙ্গে সরকারি সংস্থার গাড়ি হওয়ায় ট্রাফিক পুলিশও তাদের কিছু বলছে না। ট্রাফিক আইন অমান্য করলেও তাদের কোনো শাস্তি বা মামলা হচ্ছে না। প্রায়ই ময়লার গাড়িগুলো উল্টোপথে বেপরোয়া গতিতে চলাচল করলেও ট্রাফিক পুলিশ আটকায় না। সিটি করপোরেশনের গাড়িচালকদের নিজেদের অনুকূলে বরাদ্দ থাকা গাড়ি বহিরাগত লোকদের দিয়ে চালানোরও অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ সাধারণ নাগরিকের গাড়ি সড়কে দাঁড় করিয়ে কাগজপত্র দেখে, ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করে, অপরাধ করলে মামলা দেয়। কিন্তু সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িগুলো কখনই চেক করে না। সরকারি সংস্থার গাড়ি হওয়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এ ছাড়া করপোরেশনের দক্ষ গাড়িচালক থাকে না। মশক কর্মী, হেলপার ও বহিরাগত কর্মী দিয়ে গাড়ি চালাতে দেখা যায়। সিটি করপোরেশনও এসব চালককে মনিটরিং করে না। এ অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। সবার জন্য সমান নিয়ম থাকতে হবে। তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা গেলে বেপরোয়া গতি, আচরণ অনেকটাই কমে আসবে। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশনের মনিটরিং সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে হবে। গাড়ির ভিতর ড্যাশ ক্যামেরা ও স্পিড ক্যামেরা বসিয়ে করপোরেশন থেকে মনিটরিং করলে এসব দুর্ঘটনা কমানো যেত।’ এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘নির্ধারিত গাড়িচালক গাড়ি না চালিয়ে অন্যকে দিয়ে ভাড়া খাটিয়ে গাড়িটি চালানো হয়েছে। এ ধরনের অনিয়ম কোনোভাবে বরদাশত করা হবে না। এ ঘটনায় কঠোরতর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ রকম কার্যক্রমে যারা জড়িত সবার বিরুদ্ধে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কঠোর ব্যবস্থা নেবে। এ ধরনের ঘটনায় আগেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জড়িতদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।’
তিন বছরে ১৩ প্রাণহানি : সর্বশেষ বৃহস্পতিবার মতিঝিল সরকারি আইডিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মাহিন আহমেদ (১৩) গাড়িচাপায় নিহত হয়। এ নিয়ে গত তিন বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় অন্তত ১৩ জনের প্রাণ গেছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গাড়িচাপায় ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর গুলিস্তানে প্রাণ হারান নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসান। পরদিন দুপুরে পান্থপথ এলাকায় সংবাদকর্মী আহসান কবির খানের মৃত্যু হয়। সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নাঈমের মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লাবাহী গাড়িচাপায় ২০২৩ সালের ৬ মার্চ মারা যান আবু তৈয়ব (২৬) নামে একজন কাপড় ব্যবসায়ী। ২০২২ সালে ময়লার গাড়ি দুর্ঘটনায় অন্তত চারজন মারা যান। ওই বছরের ২ এপ্রিল খিলগাঁওয়ে ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নাসরিন খানম নামে এক নারী নিহত হন। ২৩ জানুয়ারি মহাখালীর উড়ালসড়কের কাছে ময়লার গাড়ির ধাক্কায় শিখা রানী ঘরামির মৃত্যু হয়। তিনি ডিএনসিসির পরিচ্ছন্নতা কর্মী ছিলেন। একই বছরের জুলাইয়ে মিরপুরে পুলিশ স্টাফ কলেজের সামনে ময়লার গাড়ির চাপায় সাব্বির আহমেদ নামে এক তরুণ নিহত হন। ওই বছরের ৩১ মে রাতে মুগদার টিটিপাড়া মোড়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী গাড়ির ধাক্কায় নাজমা বেগম নামে এক পথচারী নারী নিহত হন। ২০২১ সালে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় সাতজন নিহত হওয়ার তথ্য জানা গেছে।
বিআলো/তুরাগ