বৈষম্যের বেড়াজালে এমপিওভূক্ত শিক্ষা: উপসম্পাদকীয়
মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর গত হলেও এখনও শিক্ষাব্যবস্হা বেসরকারি খাতে এবং প্রাইভেট খাতে রয়ে গেছে। শিক্ষাটা এখন পর্যন্ত সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। ফলে দেশের শিক্ষা খাতের বেশিরভাগই বাণিজ্যের উপকরণ হয়ে আছে। তন্মধ্যে অন্যতম খাত হচ্ছে এমপিওভূক্ত শিক্ষাখাত। এ খাতে বাণিজ্য হলেও এর সুফল সাধারণ শিক্ষক-কমচারীরা পায়না। কিন্তু এর দুর্নাম বহন করতে হয় সাধারণ শিক্ষকদেরই। এর রসদ ভোগ করে ম্যানেজিং কমিটিসহ প্রতিষ্ঠানপ্রধান।
দেশের ৩১ হাজারের অধিক এমপিওভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীদের সংখ্যা ৫ লক্ষাধিক। দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ৯৭ ভাগ শিক্ষার ভূমিকা পালন করছে এমপিওভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি শিক্ষকদের ন্যায় একই পাঠ্যক্রমে আছে এমপিওভূক্ত শিক্ষকগণ। বিশেষ করে বলতে হয় সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকগণ নিয়োগ কমিশনের মাধ্যমে এমসিকিউ এবং লিখিত পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষকতায় আসেন। কিন্তু এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের আরও বেশি পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় শিক্ষক হিসেবে যোগ্য হতে। প্রথমে এমসিকিও, পরে লিখিত পরীক্ষা, এরপর ভাইভা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। যোগ্যতার বিচারে ঠিক হলেও বৈষম্যেরর বেড়াজালে আটকা আছে এমপিওভূক্ত শিক্ষকগণ। বৈষম্যের মহীরুহ এ খাতের উপর চেপে আছে। ফলে সবমিলে তথৈবচ শিক্ষাব্যবস্হা। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণে মরিয়া দেশের এমপিওভূক্ত শিক্ষক সমাজ। বিশেষ করে গ্রামীণ পর্যায়ের বে-সরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষকরা এ আন্দোলনের বোটম লাইনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অপরদিকে আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য না বুঝে সাধারণ মানুষের মধ্যে কেউ কেউ মনে করছেন শিক্ষকরা কেবল তাদের বেতন-ভাতা সুবিধাদির জন্য আন্দোলন করছে। বেসরকারি শিক্ষার অর্থনৈতিক বৈষম্য অবসানে শিক্ষকরা মাঠে থাকলেও ছাত্রদেরকে উল্লেখযোগ্যভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। এ জায়গায় ছাত্র সংগঠনগুলোর নির্লিপ্ত হয়ে আছে।
শিক্ষা উন্নয়নের জন্য এখন শিক্ষকরাই কথা বলছে বেশি। তবে শিক্ষার মানের চেয়ে অর্থনৈতিক মুক্তিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন শিক্ষকরা। কারণ বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে সংসারের খরচ নির্বাহ করা দুঃসাধ্য বৈ কিছু নয়। ফলে আদর্শ, চেতনার চেয়ে জীবন-জীবিকা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক সংকট মোকাবেলায় শিক্ষকরা রাজপথে থেকে লড়াই করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের একাংশ মনে করছেএটা একান্তই শিক্ষকদের দাবি । আদতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা – এটা কিন্তু তাদের বোধগম্য নয়। শিক্ষার্থীরা যে এর সুফল অবধারিতভাবে পেয়ে যাবে এটা অভিভাবকদের অজ্ঞেয়ই থেকে যাচ্ছে।
বলাবাহুল্য নয় যে, এমপিওভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এন্ট্টি লেভেলের একজন শিক্ষক ১২৫০০/ টাকা বেতনে চাকরিতে যোগদান করছে।আর একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পান ৮২৫০ টাকা। ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া, ৫’শ টাকা চিকিৎসা ভাতা এটা শিক্ষক-কর্মচারী সকলের জন্য। উৎসব বোনাস দেয়া হয় ২৫%। কর্মচারীদেরকে দেয়া হয় ৫০%। আর বৈশাখী ভাতা দেয়া হয় ২০%। বৈশাখী ভাতায় সরকারি-বেসরকারি কোন বৈষম্য নেই। উৎসব বোনাস ব্যতিত বেতন-ভাতাদি থেকে গ্রাচ্যুইটির জন্য সরকার আবার ১০% কেটে নিচ্ছে। এমন নির্মম সিদ্ধান্ত সরকারি চাকুরিজীবীদের ক্ষেত্রেও নেই। অথচ পরিমিত ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি না করেই কেটে নিচ্ছে ১০%। এটা চরম নির্মমতা ছাড়া আর কিছুই না। আর এদিকে ২০১৮ সাল থেকে ৫% ইনক্রিমেন্টে যুক্ত হয়েছে শিক্ষকরা । তবে একজন এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষক প্রথম বছরে কর্তনের পর বেতন পাচ্ছেন ১২৪০০ টাকা । এখনকার অধিকাংশ তরুন শিক্ষক অনার্স-মাস্টার্স পাশ করা। এনটিআরসিএ এর মাধ্যমে যোগ্যতায় অবতীর্ণ এসব শিক্ষক। এভাবেই গত ১৮ বছর ধরে এ তরুণ শিক্ষকরাই বেসরকারি শিক্ষার চালকের আসনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এসব শিক্ষক অনেক যোগ্য অথচ যোগ্যতার মূল্য নাই। ফলশ্রুতিতে কয়েক হাজার পদ এখনও শুন্য রয়েছে। কারণ এ পেশার প্রতি অনীহা। গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেও যোগদান করেনি অন্তত ৯০ হাজার শিক্ষক। ফলে শিক্ষক সংকটও চরমে। এ রকম নামমাত্র বেতনে একজন শিক্ষকেরই জীবন যাপন পরিচালনা করা যদি হুমকি হয় তাহলে মেধাবীরা কেন এ পেশায় আসবে। অল্প বেতনে একজন শিক্ষকেরইতো জীবন চলেনা, পরিবারের অন্য সদস্যদের জীবিকা নির্বাহ করাতো কোনোভাবেই সম্ভব না। দেখা গেছে অধিকাংশ শিক্ষকের কর্মস্হল নিজ বসত থেকে অনেক দূরে। কিংবা নিজ জেলা থেকে অন্য জেলা। পরিবার-পরিজন ছেড়ে থাকতে হয় বাসাভাড়া। আর যারা স্হানীয় তাদের তুলনাটাই দেয়া যাক, একজন শিক্ষক বাসা থেকে কর্মস্হলে যেতে প্রতিদিন যদি ১’শ টাকা ভাড়া গুনতে হয় তাহলে মাসে ২২ দিন আসা-যাওয়া করলে ২২’শ টাকা যাতায়াতে খরচ হয়। কর্মস্হলে দুপুরের খাবারও রয়েছে। গড়ে প্রতিদিন ১’শ টাকা খরচ হলে এখানেও গুনতে হয় ২২’শ টাকা। যাতায়াত ভাড়া ও দুপুরের খাওয়া বাবদ ৪ হাজার ৪’শ টাকা ব্যয় হয় থাকে। ওই শিক্ষক মাস শেষে পরিবারের জন্য কিই-বা খরচ মেটাতে পারবে? ফলে সংসারের টানাপোড়নে পড়তে হয় শিক্ষককে। স্ত্রী-সন্তান এবং বাবা-মা ‘র ন্যুনতম চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব। এর দরুণ সংসারে লেগে থাকে বিবাদ। যৌথ পরিবারে বিচ্ছিন্নতা আসে। সম্পর্কের অবনতি হেতু সংসার ভাঙ্গারও উপক্রম হয়। এন্ট্রিলেভেল অর্থ্যাৎ ১১তম গ্রেডের শিক্ষকের ২৫% উৎসব বোনাসে আসে ৩হাজার ১’শ টাকা। এ টাকা দিয়ে একজনেরই ঈদের পোশাক কেনা সম্ভব না।পরিবারের অন্য সদস্যদের পরিণতি তাহলে কি? ঈদের মুদি বাজার কেনাতো সুূদূর পরাহত। শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূর হলে অর্থনৈতিক সংকট মিটে যেত অনায়াসেই। আর শিক্ষার্থীরাও ভালো পাঠদান পেতেন এবং বৈষম্য থেকে পরিত্রাণ পেতেন।
উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, মফস্বলে একজন শিক্ষার্থী ন্যুনতাম ২’শ টাকা করে প্রতিমাসে বেতন দিচ্ছে। কোন কোন মফস্বল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫’শ থেকে হাজার টাকাও বেতন নিচ্ছে। জাতীয়রকণ হলে শিক্ষার্থীরা মাসিক বেতন নাম মাত্র হারে দেবে। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১ হাজার টাকা থেকে কয়েক হাজার পর্যন্ত সেশন ফি নেয়া হয়। পরীক্ষার ফি নেয়া হয় ন্যুনতম ৫’শ টাকা। শিক্ষাব্যবস্হা জাতীয়করণ হলে অতিরিক্ত বেতন ও ফি পরিশোধ থেকে শিক্ষার্থীরা রেহাই পাবে। দেখা গেছে বছর ঘুরে একজন শিক্ষার্থীর বেতন,পরীক্ষার ফিসহ অন্তত ৪ হাজার টাকা থেকে ১২/১৩ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হয়। বিভাগীয় শহরগুলোতে আরও কয়েকগুন। এ পরিমাণ বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। জাতীয়করণ হলে এ থেকে নিস্তার পাবে শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনকারী শিক্ষকরা প্রস্তাব করেন, দেশের ৩১ হাজার এমপিওভূক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সকল আয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা নিয়ে শিক্ষাব্যবস্হা জাতীয়করণ করা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন এমব প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে দিয়েছেন। তারা প্রমাণকসহ দেখান যে, প্রচলিত অবস্হায় প্রতিষ্ঠানের সকল আয় নিয়ে গেলে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কোন অর্থ ব্যয় করতে হবে না। আর যদি শিক্ষার্থীদের বেতন ৫০ টাকা হারে ধরা হয় তাহলে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কিছু পরিমাণ টাকা লাগবে যা রাষ্ট্রের জন্য ন্যুনতম বোঝাও হবেনা। এ বিষয়ে বিস্তারিত ফিরিস্তি তুলে ইতোমধ্যে কয়েকটি শিক্ষক সংগঠন প্রতিবেদনও মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে বিগত সরকার নীতিগতভাবে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নিয়ে অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছে।যে পদক্ষেপটি ছিল খুবই মন্হর। এতে করে শিক্ষক সমাজ বিগত সরকারের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে জোড়ালোভাবে। ধাপে ধাপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণের তকমা শিক্ষক সমাজ তখন মেনে নেয়নি।
শিক্ষক সমাজ আস্হা রাখছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্দ্ধিধায় শিক্ষাব্যবস্হা জাতীয়করণের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়ে শিক্ষা উন্নয়নের গতিকে আরও বাড়িয়ে তুলবেন। প্রসঙ্গত যে, বৈষম্যহীন স্লোগানে উদ্দীপ্ত হয়ে ছাত্র-জনতা গণঅভ্যত্থান করলো। সবাই প্রত্যাশা করতেই আর কোন বৈষম্য হয়তো থাকছেনা। কারণ অতীতে শিক্ষকরা অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন। এবার বৈষম্যর অন্তর্জাল থেকে অবমুক্তি পাবেন।
বিগত আমলে আন্দোলনকারী শিক্ষকগণ জাতীয়করণের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আমলা, বড় বড় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সভাপতি, এমপি, মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক নেতাদেরকে দায়ী করছেন। বড় বড় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপকমাত্রায় শিক্ষাব্যবসা হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা বেতন ও সেশান ফি নিচ্ছে এবং সে টাকা স্হানীয় কমিটি ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানসহ আত্নসাৎ করার ব্যাপক অভিযোগও আছে ।
নিবিড় পর্যালোচনায় উঠে এসেছে শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানরাই বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের কেন্দ্র হতে মহানগর,জেলা, উপজেলায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। এসব নেতা কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলছেন না। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বড় অঙ্কের বেতনসহ বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করছেন। এমনকি নামে-বেনামে ব্যয়ের ভাউচার সন্নিবেশন করে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাট করছেন। এর সাথে জড়িত থাকেন ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা। কার্যত: এসব প্রতিষ্ঠান প্রধানরা আন্দোলনে আগ্রহী নন এবং পদও কুক্ষিগত করে রাখেন কিংবা তার অধীনস্হ শিক্ষকদেরকে আন্দোলনে আসতে উৎসাহিত করছেন না।
প্রসঙ্গত: একটি স্বাধীন দেশে শিক্ষাব্যবস্হা জাতীয়করণের জন্য আন্দোলন কেন অনিবার্য হয়ে উঠবে? কেন শিক্ষকদেরই আন্দোলন করতে হবে? শিক্ষকদের প্রত্যাশা দেশকে এগিয়ে নিতে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরাইতো এটা উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্হাগ্রহণ করবেন। তবেইতো বৈষম্যের অবনমন ঘটবে। শিক্ষার্থীরাও বৈষম্যের অনাচার থেকে মুক্তি পাবে। প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হলে একজন শিক্ষার্থীও চরিত্রগতভাবে বৈষম্যের মেজাজ নিয়ে বেড়ে ওঠে। কালপরিক্রমায় বৈষম্যকেই পাথেয় হিসেবে নেয় এবং এটা একপ্রকার মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় নির্বিঘ্নে। মানুষ নিপতিত হয় মূলধারাবিহীন। দিকভ্রান্ত হয় জাতি।
লেখক: জাহাঙ্গীর হোসেনস
সভাপতি, বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি, কেন্দ্রীয় কমিটি
বিআলো/তুরাগ