ভূমিকম্পের নেই আগাম পূর্বাভাস: প্রস্তুতিই কমাতে পারে প্রাণহানি
টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের কারণে ভূমিকম্প
- ভূগর্ভস্থ পদার্থের চাপে প্লেটগুলো’র সঙ্গে ধাক্কা
- ভূকম্পন অনুভূত হলে শান্ত থাকতে হবে
৭ মাত্রার ভূমিকম্পনগুলো ১০০ থেকে ১২৫ বছর এবং ৮ মাত্রারগুলো ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পরপর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে: মেহেদী আহমেদ আনসারী, অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ বুয়েট
রতন বালো: মহাআতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে ভূমিকম্প। বিশেষ করে ২১ নভেম্বর হয়ে গেছে শতবর্ষের ভিতরে সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৫.৭। এই বড় ধরনের ভূমিকম্প স্পট করছে আমরা এখন রেড জোনে বাংলাদেশ। ভূমিকম্পে নেই আগাম পূর্বাভাসের কোন সুযোগ। হঠাৎ করেই ভূমিকম্প আঘাত হানে বলে কোন পূর্ব প্রস্তুতি সুযোগ মেলে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। তাদের এই বিষয়ে সচেতনতা রয়েছে। বিশেষ করে ঘরবাড়ি নির্মাণে তারা ভূমিকম্পের বিষয়টি মাথায় রেখে সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো তাদের স্থাপনা তৈরি করে।
মার্কিন মুল্লুকে একটি শহরে সব বাড়ি একই ডিজাইন বা একই নকশায় তৈরি করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই আইন মানা হয় না বা মানতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য করে না। তারা আইন পাস করে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে আর যারা গৃহনির্মাণ করেন তারা তাদের নিজস্ব খেয়ালখুশিমত তাদের বাড়িঘর নির্মাণ করেন। এদিকে তাদের নিয়ন্ত্রণে সরকার কোন পদক্ষেপ নেয় না বা বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে কি না সে বিষয়ে কোন নজরদারি করে না। দেশের মফস্বল অঞ্চলেই নয় এই মানসিকতায় রাজধানীতে গড়ে উঠেছে অনেক আলীশান ভবন। আধুনিক স্থাপত্য ব্যবহারের নামে গড়ে ওঠা এসব প্রাসাদ মূলত নগরবাসীর জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা এই ভূমিকম্পের মাত্রা যদি রিখটার স্কেলে ৬ হতো তাহলে মহাবিপর্যয় ঘটে যেতে পারত। তারা ভূমিকম্পের কারণে এই সব স্থাপনা এখন মানুষের জীবনহানির কারণ হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেছেন। এদিকে ভূমিকম্পের সময়ে আমাদের করণীয় কি সে বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে বলে তারা যোগ করেন। আমরা ঝড় বন্যার প্রস্তুতি কইলে বিষয়ে ধারণা রাখলেও ভূমিকম্প থেকে নিরাপদ থাকার বিষয়টি আমাদের কাছে একেবারেই অজানা। তাই প্রাকৃতিক এই খেয়ালি আচরণে আমাদের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনার হুমকি সৃষ্টি করছে। এখনই আমাদের জাতীয় স্বার্থে নতুন এই প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
বড় ভূমিকম্পনের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষক কেন্দ্রের সহকারী আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা বলেন, একটি ভূমিকম্প হলে সেটা বড় ভূমিকম্পের আফটার শক হয়। আবার বড় ভূমিকম্পের আগেও ছোট ভূমিকম্প হতে পারে। কতদিন পর হবে বা কতবার হবে তার কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। গত শুক্রবার মাধবদীর ভূকম্পনটি মাঝারি ধরনের ছিল উল্লেখ করে তিনি জানান, ১৯১৮ সালের পর দেশের ভেতরে এটা সবচেয়ে বড় শক হলো। সে সময় শ্রীমঙ্গলে ওই ভূকম্পনটি ছিল ৭ দশমিক ৬ মাত্রা। সে সময় বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
তিনি বলেন, ১০০ বা ১৫০ বছর পরপর বড় ভূমিকম্প হয়। সেটার দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছি আমরা। যেহেতু শত বছর আগে ডাউকি ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ভূমিকম্পের আগাম বার্তা পাওয়ার কোনো প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কার হয়নি।
ভূমিকম্প কি কারণে হয়:
পৃথিবীর উপরিভাগ অনমনীয় প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত। এগুলো আগে একত্রে থাকলেও এখন আলাদা হয়ে গেছে। এই পৃথক পৃথক অংশগুলোকে টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। ভূগর্ভস্থ নানা পদার্থের কারণে চাপ সৃষ্টি হলে প্লেটগুলো একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়। ফলে ওয়েভ (তরঙ্গ) সৃষ্টি হয়। সেই তরঙ্গের শক্তির ওপরই আসলে নির্ভর করে ভূমিকম্পের মাত্রা, যা পৃথিবীর উপরিভাগেও অনুভূত হয়। এর ফলে যে ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়, সেটা আসলে ভূমিকম্প। গত ২১ নভেম্বর শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে মাধবদীর ভূমিকম্পও হয়েছে টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের কারণে।
ভূমিকম্প পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট কিছু ভূকম্পন হয়। আবার ছোট ছোট ভূকম্পনের ফলে ভূগর্ভের জমে থাকা শক্তিও কমে যায়। রংপুরসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলকে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে আগেই ঘোষণা করেছে আবহাওয়া অফিস। সেই দিক থেকে ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বাইরে মেঘালয়ের ডাউকি ফল্টের কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলও ঝুঁকিপূর্ণ।
ভূমিকম্পের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, আমাদের যতদূর জানা, সম্ভবত ১৮৯৭ সালের দিকে সিলেট অঞ্চলে একটা বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ভূমিকম্পের একটা ধরন হচ্ছে, পিরিয়ডোক্যালি (নির্দিষ্ট সময় পরপর) বড় ভূমিকম্প হয়। সেগুলো সাধারণত একশ বছর পরপর ঘুরে আসে ভূমিকম্প।
বাংলাদেশকে তিনটা জোনে ভাগ করা হয়েছে। একটা হলো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ, একটা হলো মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ ও আরেকটা হলো কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুরের কিছু অংশ ও চট্টগ্রাম অঞ্চল অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে পড়েছে। তাই এসব অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস নেই। সুতরাং বড় ভূমিকম্প হতেই পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফল্ট লাইনে বড় ভূমিকম্প হয়। আর বাংলাদেশ ফল্ট লাইনের আশপাশের দেশ। সেই হিসেবে বড় ভূমিকম্পনে বড় প্রভাব পড়বে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে উৎপন্ন হওয়া প্রত্যেকটা বড় ভূমিকম্পের প্রভাবই দেশে বড় করেই এসেছে। ১৮৬৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৪টি বড় ভূমিকম্প হয়েছে। এগুলোর মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৬ থেকে ৮ দশমিক ৬ মাত্রার। ৮ দশমিক ১ মাত্রার হয়েছে ১৮৯৭ সালে, যার উৎপত্তি ছিল ভারতে। এরপর ১৯৫০ সালের ৮ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিও ভারতের আসামে। এ ছাড়া মিয়ানমার, ভুটান, নেপালের ভূকম্পনের ঢেউও এসে পড়ে বাংলাদেশে।
ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল:
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা, কুমিল্লা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু অংশ উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ঢাকার একটি অংশ, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিছু অংশ মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে। অন্যদিকে খুলনা ও বরিশাল বিভাগকে কম ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে।
ব্যতিক্রম জাপান, প্রয়োজন উদ্যোগ:
পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্প বেশি যে দেশগুলোতে হয় তার মধ্যে অন্যতম জাপান। তাই জাতিগতভাবে তারা এটি অন্যদের চেয়ে ক্ষতি বেশি কমাতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। সে ব্যবস্থা অন্যরাও অনুকরণ করতে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী আহমেদ আনসারী এ বিষয়ে বলেন, ৭ মাত্রার ভূমিকম্পনগুলো ১০০ থেকে ১২৫ বছর পরপর হয়। আর ৮ মাত্রারগুলো ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পরপর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মাধবদীর ভূমিকম্পনে ঢাকার অনেক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিল্ডিং কোড না মানায় এমন হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবায়েত কবীর বলেন, ১০০ বছরের মধ্যে দেশের ভেতরে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পনগুলোর মধ্যে সব বেশি মাত্রার ভূকম্পন হলো মাধবদীতে। এটাই সর্বোচ্চ। কাজেই এখনই সতর্ক হওয়া উচিত।
সচেতনতা ও প্রস্তুতি ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে:
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে ভূমিকম্পের দিক থেকে ঝুঁকিপ্রবণ এক জনপদ বাংলাদেশ। ভূমিকম্প জীবন নেয় না, জীবন নেয় পারিপার্শ্বিক অবস্থা। ভূমিকম্পে ঘরের দেয়াল কিংবা ছাদ ধসে পড়ে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস হয়, আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভূমিকম্পে করণীয় সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে জীবনহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি আরো বেড়ে যায়। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর ব্যবস্থা তাই নিজেদেরই গ্রহণ করতে হবে।
ভূমিকম্পনের সময় করণীয়:
ভূকম্পন অনুভূত হলে শান্ত থাকতে হবে। আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করা যাবে না কিংবা তাৎক্ষণিকভাবে বাড়ি থেকে বের হওয়া যাবে না। ভূমিকম্পের সময় বিছানায় থাকলে, বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে নিতে অতঃপর টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোনো আসবাবের নিচে আশ্রয় নিতে হবে এবং তা এমনভাবে ধরে থাকতে হবে যেন মাথার ওপর থেকে সরে না যায়। এ ছাড়া শক্ত দরজার চৌকাঠের নিচে ও পিলারের পাশে আশ্রয় নিতে হবে। বারান্দা, ব্যালকনি, জানালা, বুকশেলফ, আলমারি, কাঠের আসবাবপত্র, বাঁধানো ছবি বা অন্য কোনো ঝুলন্ত ভারি বস্তু থেকে দূরে থাকতে হবে। রান্নাঘরে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব বের হয়ে আসতে হবে। বন্ধ করতে হবে বাড়ির গ্যাস, বিদ্যুতের মূল সংযোগ। লিফট ব্যবহার করা যাবে না।
ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বিদ্যুতের খুঁটি থেকে দূরে খোলাস্থানে আশ্রয় নিতে হবে। জনাকীর্ণ ঘরে ( যেমন- গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল, সিনেমা হল, মার্কেট) থাকলে বাইরে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে ভিড় কিংবা ধাক্কাধাক্কি করা যাবে না।
ভূমিকম্প মোকাবিলায় নিজেকেই প্রস্তুতি রাখতে হবে:
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাড়ি নির্মাণের সময় বিল্ডিং কোড মেনে চলতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের সংযোগ ঝুঁকিমুক্ত কি না তা নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে এবং তা কীভাবে বন্ধ করতে হয় তা সবাইকে জানিয়ে রাখতে হবে। ঘরের ভারি আসবাবপত্র (যেমন- আলমারি, শেলফ, ফুলের টব, ছবির ফ্রেম ইত্যাদি) যাতে ভূমিকম্পে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা না ঘটাতে পারে, সেজন্য যথাসম্ভব পেছন থেকে আংটা লাগিয়ে দেয়ালের সঙ্গে আটকিয়ে রাখলে ক্ষতি কম হবে।
বহুতল ভবন, মার্কেট, হোটেল, বিদ্যালয়ের সিঁড়ি প্রশস্তকরণ ও ব্যবস্থা রাখতে হবে জরুরি দরজা ও সিঁড়ির। ভূমিকম্পকালীন আত্মরক্ষার স্বার্থে ঘরে সবসময়ের জন্য রেডিও, টর্চ লাইট, হাতুড়ি, হেলমেট, কুড়াল ও প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জামসমূহ একটি ব্যাগে মজুত রাখতে হবে।
বিআলো/তুরাগ



