মধ্যযুগীয় কবি-সাহিত্যিক ও শায়খুত তরিকত আলী রজা কানু শাহ্ (রহ.)-র অনবদ্য জীবন ও কর্ম
হজরতুল্লামা সুফি আলী রজা কানু শাহ্ (র.) বাংলাদেশের একজন মধ্যযুগীয় কবি-সাহিত্যিক ওশায়খুত তরিকত। এ মহান জ্ঞান তাপসকুলের সাহিত্যকর্ম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি ও কলকাতা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে এখনো সংরক্ষিত রয়েছে। বহুমাত্রিক পরিচয় বহনকারী এ মহান গুণীজন চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ওষখাইন গ্রামে। হজরত কানু শাহ্ (র.) ১৭৫৯ সালে আনোয়ারা উপজেলার ওষখাইন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মুহাম্মদ সাঁছি/সাঁছি মুহাম্মদ এবং মায়ের নাম পরাণ বিবি, পিতামহের নাম মনোহর, প্রপিতামহের নাম মুহাম্মদ আকবর। পিতার দিক দিয়ে খলিফাতুল মুসলেমিন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাদ্বি.)- র বংশধর। বাল্যকাল থেকে তিনি ছিলেন পরহেজগার, খোদাপ্রেমী, অল্পাহারী ও অল্পভাষী। আদবে, ইবাদতে, আখলাকে, চলাফেরায়, লেনদেনে, কাজকর্মে, রিয়াজতে তিনি ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। প্রায় সময় কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন। ফরজ নামাজের পাশাপাশি অত্যধিক নফল ইবাদতে মশগুল থাকতেন। বছরে প্রায় সময় রোজা রাখতেন। অধিকহারে তজবীহ ও তাহলীল আদায় করতেন। কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী জীবনযাপন করতেন। প্রায় সময় মুরাক্বাবা ও মুশাহাদায় মগ্ন থাকতেন। সর্বাবস্থায় আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল (দ.)-র জিকিরে অবিশ্রান্ত ও জাগ্রত থাকত তার জবান ও ক্বলব। এক ওয়াক্ত নামাজ অন্তে অন্য ওয়াক্ত নামাজের জন্য অপেক্ষমাণ থাকতেন এবং ভক্ত ও মুরিদানদের নসিহতমূলক বয়ান, শরিয়ত ও তরীকৃত শিক্ষা দিতেন। হজরত কানু শাহ্ (র.)-র শিক্ষার হাতেখড়ি হয় পারিবারিক পরিবেশে। ইলমে তফসির, ইলমে হাদিস, ইলমে ফেকাহ এবং ইলমে তাসাউফ শিক্ষা নেন খলিফাতুল মুসলেমিন হজরত ওমর ফারুক (রাদ্বি.)-র বংশধর, মুফাচ্ছিরে কুরআন, শায়খুল হাদিস, ফকিহুল আরব ওয়াল আজম, সুফি মাওলানা কেয়ামুদ্দীন (রহ.)-র কাছ থেকে। হজরত কেয়ামুদ্দিন (র.)-র জন্মস্থান পবিত্র মক্কা নগরীতে। মক্কা ও মদীনার বুযুর্গ আলেমদের থেকে তিনি কুরআন, হাদিস ও ফেকাহের জ্ঞান লাভ করে ইসলাম প্রচারার্থে পবিত্র মক্কা হতে সুদূর ভারতের বিহার রাজ্যে হিজরত করেন। তৎকালীন সময়ে সুফিয়ানে কেরামের নিরাপদ স্থান ছিল ভারতের কাশ্মীর, পাটনা, লক্ষ্ণৌ, মুর্শিদাবাদ, বিহার। বহু সুফি- দরবেশ বিহারে খানকা প্রতিষ্ঠা করে ইসলামের সুবিশাল খেদমতের আঞ্জাম দিয়েছেন। সমকালীন সময়ে সেখানে বিহারে বসবাস করতেন- চট্টগ্রামের শহর কুতুব, হজরত শাহসুফি সৈয়দ আমানত শাহ্ (র.)। মাওলানা কেয়ামুদ্দীন (র.)- শায়খুল মাশায়েখ হজরত শাহ্ আমানত (র.)-র কারামত, শরাফত, আখলাক, দ্বীনদার, খোদাভীরুতা ও এখলাছে আকৃষ্ট হয়ে তরিকৃতের বায়’আত নেন। কঠোর রিয়াজতের মাধ্যমে ইলমে মারিফতের চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করে মোজাদ্দেদিয়া, নক্সবন্দিয়া ও চিশতিয়া তরীক্বার খেলাফত লাভ করে পীরের আসনে সমাসীন হন। অনুরূপে আলী রজা কানু শাহ্ (র.)-ও আপন পীর ও মুর্শিদ মাওলানা কেয়ামুদ্দীন (র.) থেকে শরিয়ত ও তরিকৃতের জ্ঞান শিক্ষা নিয়ে খেলাফত লাভ করে পীরের আসনে সমাসীন হন। হজরত মাওলানা কেয়ামুদ্দীন (রহ.)’র ইন্তেকালের পর হজরত কানু শাহ্ (র.) কাদেরিয়া তরিকার পীর হজরত জিয়াউদ্দীন আহমদ বাগদাদী (রহ.) থেকে ক্বাদেরীয়া মোনয়েমীয়া তরিক্বার খেলাফত লাভ করেন।
হজরত কানু শাহ্ (র.)-র বর্তমান বংশধরদের তথ্যমতে, হজরত জিয়াউদ্দীন আহমদ (রহ.) ছিলেন ঢাকা আজিমপুর দায়রা শরীফের পীর সুফি সৈয়দ মুহাম্মদ দায়েম (রহ)-র জামাতা শাহসুফি পীর রওশন আলী (রহ.)-র একজন বিশিষ্ট খলিফা। হজরত পীর জিয়াউদ্দীন আহমদ বাগদাদী (র.) সর্ম্পকে আজিমপুর বড়-ছোট দায়রা শরীফের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, হজরত জিয়াউদ্দীন আহমদ (র.) সর্ম্পকে আমরা অবগত নই। তাদের ভাষ্যমতে সুফি রওশন আলীর একমাত্র খলিফা ছিলেন বড়পীরের বংশধর হজরত যাকী উদ্দীন হোসাঈনী (রহ.)। আজিমপুর দায়রা শরীফ বইয়ের গ্রন্থ প্রণেতা শাহ সুফি সাইয়্যেদ আহমাদুল্লাহ্ (র.) জিয়াউদ্দীন আহমদ বোগদাদী (র.) সর্ম্পকে কোনো তথ্য দেননি তার লিখিত গ্রন্থাবলিতে। আলী রজা কানু শাহ্ (র.) বাংলাদেশ, ভারত ও বার্মার গহীন বন-জঙ্গলে বনবাসী ছিলেন ২৪ বছর এবং নিজগৃহে সাধনাময় মগ্ন ছিলেন ১২ বছর। অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনার বদৌলতে আল্লাহ তা’য়ালা তাকে দান করেছেন অজস্র খোদায়ি নিয়ামত ও বেলায়াতের সুউচ্চ মকাম।
হজরত কানু শাহ্ (র.) শুধু পীর-মুরিদীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। সাহিত্য জগতে তার অবাধ বিচরণ ছিল। তিনি একাধিক ভাষায় পারদর্শী ছিলেন- (১) বাংলা, (২) আরবি, (৩) ফার্সী, (৪) উর্দু, (৫) সংস্কৃতি, (৬) হিন্দি, (৭) দেবনাগরী (দেবনাগরী লিপি উত্তর ভারতীয় ভাষায় যেমন সংস্কৃত, হিন্দি, মারাঠি, সিন্ধি, বিহারি, ভিলি, মারওয়াড়ি, কোংকতী, ভোজপুরি, নেপালি, নেপাল ভাষা ও মাঝেমাঝে কাশ্মিরি ও রোমানি ভাষায় ব্যবহৃত হয়)। তার সাহিত্যের গুণগত মান, ভাষাগত দক্ষতা, ছন্দময় শব্দগঠন, শব্দশৈলী, শব্দচয়ন ও শব্দ বিন্যাস ছিল অপূর্ব ও শ্রুতিমধুর। তিনি অসংখ্য মারফতি গান, সংগীত, কবিতা লিখেছেন স্বহস্তে। তার হাতের লেখা ছাপা অক্ষরের ন্যায় সুন্দর ছিল। তিনি ফারসি ভাষায় বেশ পারদর্শী ছিলেন। এ মহান অলিকুল শিরোমণির অন্তরে ছিল ইলমে লাদুন্নীতে ভরপুর, পাশাপাশি তীক্ষ্ণ বেলায়াতি শক্তি ও কাল্ফ। এ সমস্ত জ্ঞান অত্যন্ত দুর্লভ ও অদৃষ্টপূর্ব। আঠার শতকের প্রতিভাবান ও শক্তিমান কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার রচনাবলির মধ্যে রয়েছে পুরাণ শাস্ত্র, আগম শাস্ত্র, জ্যোতিষ শাস্ত্র, শরহুল বেকায়া, ফার্সী জ্ঞানসাগর, (র.)-র চিকিৎসা শাস্ত্র ও কবিরাজী শাস্ত্র। হজরত আলী রজা কানু শাহ্ গ্রন্থসমূহের মধ্যে (১) জ্ঞানসাগর (সুফিতত্ত্ব), (২) আগম, (৩) ষটচক্রভেদ, (৪) শাহনামা (প্রথম খাবনামা, (১১) এজাম, (১৪) রফিকুচ্ছালেকীন, তাকদ্বীন, (১৯) রাসুল, (২১) ধ্যানমালা, (৫) সিরাজ কুলুপ, (৬) যোগকালন্দর, (৭) ও দ্বিতীয় খণ্ড), (৮) রাগতাল নামা, (৯) ইসলাম নামা, (১০) সৃষ্টিপত্তন, (১২) হাতেম তাঈ, (১৩) তাওফায়ে হেদায়তুল আওরাদে আছানি, (১৫) ছালাতুল মোক্তাদি, (১৬) (১৭) কিতাবে জরুরে মুকাল্লেদ, (১৮) কিতাবে তাজহিজে আহকামুচ্ছালাত, (২০) তাওফায়ে মকবুল ও ফজায়েলে কিতাবে চেহেল হাদিছ ও মছায়েল, (২২) খোতবায়ে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা, (২৩) বয়ানে শবে বরাত ও শবে কদর, (২৪) রাহাতুর রুহ্, (২৫) তারিফে রাসুল, (২৬) যোগ সাধন, (২৭) তনের বিচার, (২৮) জ্যোতিষ নামা, (২৯) রাগনামা, (৩০) অমরসিং।
এ মহান মনীষীর লিখিত গ্রন্থ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গবেষণা চলমান রয়েছে। ‘জ্ঞানসাগর’ ও ‘আগম’ শাস্ত্রের উপর গবষেণা করেছেন ডেভিড জি ক্যাশিন (সুইডিশ নাগরিক), এ গ্রন্থটি ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত হয়। তাজুল আউলিয়া হজরত আলী রজা কানু শাহ্ (রহ.)- র অসংখ্য অনুসারী ও ভক্ত মুরিদান সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। হজরত কানু শাহ্ (র.)-র তরিক্বতের সিলসিলার জংশন বাংলাদেশ পেরিয়ে ভারত ও বার্মায় এখনো চালু রয়েছে। তিনি সর্বপ্রথম বঙ্গদেশে ছেমা মাহফিলের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের পীর সাহেব, হজরত সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী (র.) সত্যায়িত করে একদা বলেছিলেন, ‘এ বঙ্গে সর্বপ্রথম ছেমা মাহফিলের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন হজরত আলী রজা কানু শাহ্।’ এ মহান মনীষী একাধারে ছিলেন ভাষাবিদ, ধর্মতত্তবিদ আধ্যাতাবিদ, চিকিৎসাবিদ, যোগশাস্ত্রবিদ, জ্যোতিষবিদ, দার্শনিক, গবেষক, গ্রন্থ প্রণেতা, কবি- সাহিত্যিক। মানবকুল এখনো তার রুহানি ফয়েজের প্রভাবে প্রাণবন্ত হচ্ছে। বহু কারামত এখনো লোকমুখে শুনা যায়। আউলিয়ায়ে কেরামদের কারামত সর্ম্পকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের রায় হচ্ছে কারামাতুল আউলিয়ায়ে হাক্কুন (আল্লাহর অলিদের কারামত সত্য)। কানু শাহ্ (র.)-র জীবনাদর্শন ছিল ধর্মপ্রচার, মানবসেবা ও তরীকৃত প্রচার। তার লেখনীর প্রভাবে কত সাধু, কত সন্ন্যাসী, কত পাপী-তাপী, কত পথহারা পথিক, কত অমানুষ, কত জ্ঞানী-গুণী, কত মূর্খ পেয়েছে সিরাতুল মুস্তাকিমের সন্ধান। হজরত কানু শাহ্ (র.) ১৮৩৭ সালে প্রথম স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের ডেকে বলেছিলেন, ‘অচিরে আমার বিবাহের দিন আসিতেছে’। এ কথা বলার কিছুদিন পরেই এ মহান আধ্যাত্মবিদ অগণিত ভক্তকুল রেখে ১৮৩৭ সালের বুধবারে ইন্তেকাল করেন। তরীকৃত জগতে কানু শাহ্ (র.)-র মতো অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সংখ্যা খুবই নগণ্য। কারণ তিনি একদিকে ছিলেন সাহিত্য বিশারদ অন্যদিকে ছিলেন শায়খুত তরীকৃত। আল্লাহ তা’য়ালা তাকে অজস্র নিয়ামত দিয়ে উভয় জাহানে সম্মানিত করেছেন। হে আল্লাহ! আপনার প্রিয় বান্দার মতো জীবন গড়ার তৌফিক দানে ধন্য করুন।
কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী
লেখক: (গবেষক, বিশ্লেষক ও সাহিত্যিক)
বিআলো/তুরাগ