মাওলানা খাজা ছাইফুদ্দীন শম্ভূগঞ্জীর (র.) সাহিত্যকর্ম
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, বিংশ শতাব্দীর আধ্যাত্ম জগতের নব আকাশের এক দীপ্তমান সূর্যসন্তান সর্ম্পকে। যিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ময়মনসিংহ সদরের অদূর শম্ভূগঞ্জ লালকুঠি পাক দরবার শরীফে। তৎসময়ে এ লালকুঠি ছিল ব্রিটিশ ঐতিহ্যের প্রতীক। ব্রিটিশ আমলে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরঘেঁষে গড়ে উঠেছিল পাট শিল্প বাণিজ্যের রাজধানী হিসেবে। আর এ পাট শিল্পের প্রধান কার্যালয় ছিল লালকুঠি। এটি ১৯২২ সালে ব্রিটিশ ডেভিড কোম্পানি কর্তৃক নির্মিত একটি দালান। এ দালানটি প্রায় একচল্লিশ বছরের মাথায় রূপ নেয়, আধ্যাত্মিক শরাফতের রাজধানীতে। পরবর্তীতে এ লালকুঠি থেকে আল্লাহ তাআলার দ্বীনের অমীয় বাণী এবং খোদা তায়ালার নূরের নূরানিয়াত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। যে এ মহামানবের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় এ অসাধারণ কাজটি নিপুণতার সঙ্গে সমাধা হয়েছে তিনি হলেন, মাওলানা খাজা ছাইফুদ্দীন শম্ভূগঞ্জী-এনায়েতপুরী (র.)। একাধারে ছিলেন, চিন্তক, গবেষক, গ্রন্থ প্রণেতা, দার্শনিক, বিশ্লেষক, প্রবন্ধকার, কলামিস্ট এবং নক্সবন্দিয়া ও মুজাদ্দেদিয়া তরিক্বার ধারক ও বাহক। এ মহাত্মা শুধু খোদা তায়ালার নৈকট্যার্জনমূলক জ্ঞান শিক্ষাদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। ধর্মতত্ত্ব, আত্মদর্শন এবং ইসলামি ভাবধারার ইতিহাস, ঐতিহ্য, গৌরব, স্বকীয়তা এবং ভাবাদর্শনের উপর বিশটির অধিক গ্রন্থ রচনা করে বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদান রেখে বাঙালির কাছে অমর হয়ে আছেন। তার এ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৪ সালের ১৯ অক্টোবর ‘বাংলাদেশ লেখক সমিতি’ এবং ‘আন্তজার্তিক সাহিত্য সমাজ’ তাকে বিশেষ সংবর্ধনা ও স্বর্ণপদক সম্মাননায় ভূষিত করেন। এ জ্ঞানতাপসের জন্ম ১৯২০ সালে। জন্মস্থান সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর গ্রামে। খাজা মাওলানা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (র.) ও হজরত গোলেনূর (মহিলা কবি) তার সম্মানিত পিতামাতা। শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের প্রথম সময় কাটান নিজ গ্রামে। তবে মাঝে মধ্যে কলকাতার নিজ বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। প্রাথমিক ধর্মশিক্ষা নেন, পারিবারিক পরিবেশে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা নেন, জুনিয়র মাদরাসা থেকে। এন্ট্রান্স (এস.এস.সি সমমান) পাশ করেন, সিরাজগঞ্জ স্থল পাকড়াশী ইনস্টিটিউশন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। উচ্চ মাধ্যমিক (এইচ.এস.সি সমমান) এবং বি.এ অনার্স (দর্শন) পাশ করেন, সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে। নাহু, ছরফ, বালাগাত, মানতিক, কুরআন, হাদিস, তফসির ও ফিকাহের জ্ঞানসহ ইসলামের নানাবিধ জ্ঞান অর্জন করেন, তৎকালীন সময়ের মুহাক্কিক আলেমে দ্বীন, মাওলানা নেয়ামত উল্লাহর (রহ.) কাছ থেকে। অবসর সময়ে পারিবারিক পাঠাগারে মূল্যবান কিতাবাদি অধ্যয়ন করে সুগভীর জ্ঞানার্জন করেন। ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিলেন। ছোটবেলা থেকে লেখালেখির প্রতি তার প্রবল ঝোঁক ছিল। ক্ষুরধার লেখনি এবং অনুধাবনমূলক বক্তব্য উপস্থাপনের কারণে পাঠক সমাজের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল আকাশচুম্বী। নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ‘আদর্শ মুর্শিদ’ নামে তাসাউফ সাহিত্য ও পীর-আউলিয়ার জীবন দর্শনের উপর একটি অমূল্য গ্রন্থ রচনা করে পাঠক সমাজের কাছে সমাদৃত হয়েছিলেন। বইটি দেখে পিতা- খাজা ইউনুস আলী (র.) বলেছিলেন, ‘খাজা ছাইফুদ্দীন; ইলমে মারিফতের দরিয়া মন্থন করে আউলিয়া হয়ে গেছে; তার আত্মা আর রাসুলুল্লাহ (দ.) আত্মা একাত্মা হয়ে মিশে গেছে।’ এ মহান খোদায়ি রত্ন অনার্স পাশ করে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন, সিরাজগঞ্জ হাই স্কুলে। ফুড ইন্সপেক্টর হিসেবে সরকারি চাকরি করেন, চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রামে চাকরিকালীন নন্দনকানন নিজ বাসায় থাকতেন। চাকরি ছেড়ে তিনি আবার সুতার ব্যবসাও করেছিলেন। সুতার ব্যবসা ছিল পারিবারিক ব্যবসা। সুতার ব্যবসাকালীন সময়ে নারায়ণগঞ্জ ভাগ্যকুল জমিদারের ১৪, এস.এম রায় রোডস্থ শীতলক্ষ্যা নদীর তীরঘেঁষা খাজা মঞ্জিলে বসবাস করতেন। প্রখ্যাত এ সুফিতত্ত্ববিদ শুধু পীর-মুরিদী, ধর্মপ্রচার এবং মানবসেবামূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। তার চিন্তা ও দর্শন ছিল অচিন্তনীয় ও অকল্পনীয়। তার রচনা সমগ্র- (১) আদর্শ মুর্শিদ, (২) ঈদ-ই মিলাদুন্নবী (দ.) আ মৌলুদে খায়রুল বারিয়াহ, (৩) সুফি দর্শন ও সূফী দার্শনিক, (৪) তাছাউফের ওজিফা বা মারেফাতের তত্ত্ব, (৫) রাজনৈতিক কোন্দলের আবর্তে নির্যাতিত নবী বংশ, (৬) গায়েবী এলম ওয়াছিলা অন্বেষণ, (৭) ইসলামে তাছাওউফ বা মারেফাত তত্ত্ব, (৮) আহলে বাইত ও শহীদে কারবালা, (৯) সেজরায়ে মোবারক, (১০) হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানীর (রহ.) জীবনী গ্রন্থ, (১১) ফাজায়েলে জেয়ারতে মাযার, (১২) ওরছ প্রসঙ্গ। আল্লাহর এ মহান অলিয়ে কামেল ১৯৯৫ সালের ১৫ অক্টোবর, রবিবার ১-৪৫ মিনিটে বেছালে হক্ব লাভ করেন। ইন্তেকালের সময়ে দরবারের সমস্ত পশু-পাখি কিচিরমিচির শব্দের সুরে কান্নার রোল তুলেছিল। এ ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, তার হৃদয়ে কতই না প্রেম ছিল জীবাত্মার প্রতি। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন,
‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’
বিশ্বের বহু জ্ঞানীগুণী, রাজনীতিবিদ, অধ্যাত্মবিদ নানা প্রান্ত থেকে শোকবার্তা জ্ঞাপন করেছেন। বেছারে হক্বের পরে শরীর তুলতুলে নরম ও গরম ছিল। চেহারা ছিল পূর্ণিমার চাঁদের মতো সমুজ্জ্বল। হে আল্লাহ! আপনার এ মহান অলিয়ে কামেলে পদাঙ্ক অনুসরণ ও অনুকরণের তৌফিক দিও। আমিন।
লেখক: কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী
(গবেষক ও ব্যাংকার)
বিআলো/তুরাগ