মাগুরা এক আসনে নির্বাচনী উত্তাপ, প্রচারে সবচেয়ে এগিয়ে বিএনপি ও জামায়াত
এস এম শিমুল রানা, মাগুরা: আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মাগুরা জেলায় বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী হাওয়া। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাব্য ঘোষণা আসার পর থেকেই জেলার চারটি উপজেলায় সরব হয়ে উঠেছেন প্রার্থী ও সম্ভাব্য প্রার্থীরা। বিশেষ করে মাগুরা–১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঠে বর্তমানে সবচেয়ে সক্রিয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের মনোনীত প্রার্থীরা। তবে মাঠে নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল।
মাগুরা জেলার চারটি উপজেলায় মোট দুইটি সংসদীয় আসন থাকলেও সবচেয়ে আলোচনায় রয়েছে মাগুরা–১ আসন, যেখানে দীর্ঘদিন পর ফের মুখোমুখি হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। সামাজিক-ধর্মীয় অনুষ্ঠান, শুভেচ্ছা বিনিময়, দরিদ্র সহায়তা, ক্ষুদ্র গণসংযোগ, লিফলেট বিতরণসহ বিভিন্ন কৌশলে দলগুলো ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টায় ব্যস্ত সময় পার করছে।
মাগুরা–১ বিএনপির ঘাঁটি ফিরে পাওয়ার লড়াই
মাগুরা সদর ও শ্রীপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত মাগুরা–১ আসনকে একসময় বিএনপির শক্ত ঘাঁটি বলা হতো। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই আসনে বিএনপি ধারাবাহিকভাবে শক্ত অবস্থান ধরে রাখলেও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একতরফা আধিপত্য বজায় রেখেছে। দীর্ঘদিন পর এবার মাঠে নেমেই সরব হয়েছেন বিএনপি। দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মো. মনোয়ার হোসেন খান। ২০১৮ সালে কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি এ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন।
মো. মনোয়ার হোসেন খানের বিস্তৃত প্রচার নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মাসজুড়ে মাঠে চলছে। বিভিন্ন ইউনিয়ন, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গ্রামীণ জনপদে গণসংযোগ চালিয়ে ভোটারদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন তিনি। এছাড়া জেলা বিএনপির সদস্য আহ্বায়ক কমিটি, সাবেক সহ-সভাপতি, এবং সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন।
ছাত্রজীবনে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য (১৯৮৬–১৯৯০) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক (১৯৮৫–১৯৯০) ছিলেন। ছাত্ররাজনীতি থেকেই তাঁর নেতৃত্বগুণের প্রকাশ ঘটে এবং পরবর্তীতে জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে পৌঁছে যান। তিনি বহু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে মাগুরা ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় চার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সামাজিক উন্নয়নেও অত্যন্ত সক্রিয়। তিনি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসেবা ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তাঁর অবদান সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিবেচিত হচ্ছে।
নির্বাচনী মাঠে গতি ফিরেছে
এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণার পর থেকেই মাগুরা–১ আসনে নতুন করে উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা তাঁর নেতৃত্বে নির্বাচনী মাঠকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলছেন।
মো. মনোয়ার হোসেন খান বলেন, “১৯৮৫ সাল থেকে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় আছি। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে ১৬ বছর সামনের সারিতে ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে ৫টি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। দল আবারও আস্থা রেখে আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে। আমি জনগণের কল্যাণে কাজ করতে চাই।”
উন্নয়ন প্রতিশ্রুতিতে তিনি উল্লেখ করেন, মাগুরা পৌরসভা প্রথম শ্রেণির হলেও এখানকার নাগরিকসেবা ও অবকাঠামো এখনও পিছিয়ে। নির্বাচিত হলে তিনি রাস্তাঘাট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পিছিয়ে থাকা সেবা কার্যক্রম সচলকরণ, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আম ও ধান ব্যবসা পুনরুজ্জীবন, গার্মেন্টস ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন এই পাঁচটি বৃহৎ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্ব দেবেন।
মাঠে শক্ত অবস্থান জামায়াতের
মাগুরা–১ আসনে বিএনপির পাশাপাশি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবস্থানে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচনের প্রস্তুতি অনেক আগেই শেষ করে রেখেছে দলটি। মনোনীত প্রার্থী মো. আব্দুল মতিন ইতোমধ্যে টেকসই গণসংযোগ, উঠান বৈঠক, বিভিন্ন ইউনিয়নে সভা-সমাবেশ করে চলেছেন।
জামায়াত ইসলামী মাগুরা–১ আসনে প্রার্থী মো. আব্দুল মতিন বলেন, “আমি জামায়াতে ইসলামী রাজনীতির সাথে যুক্ত ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত। জামায়াতে ইসলামীর মাগুরা জেলা আমীরের দায়িত্ব পালন করেছি। এর পর আমি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে আছি, এবং যশোর–কুষ্টিয়া অঞ্চলের সদস্য টিম লিডার হিসেবে দায়িত্বে আছি। গত ১৬ বছরে চারটি মামলা হয়েছে এবং আমাকে ক্রাশ ফায়ার আদর্শ দিয়ে ছিল আওয়ামী লীগ সরকার ও অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। জনগণের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা, দরিদ্রবান্ধব রাজনীতি প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্যহীন মাগুরা–১ গড়াই আমার লক্ষ্য। মানুষের সঙ্গে মানুষের রাজনীতি করেই আমি মাঠে আছি।”
জামায়াতের শক্তিশালী তৃণমূল নেটওয়ার্কের কারণে তারা বিএনপির মতো দ্রুত মাঠে সক্রিয়তা দেখিয়েছে বলে স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মন্তব্য করছেন।
ইসলামী আন্দোলনের স্থির অগ্রযাত্রা
বিএনপি ও জামায়াতের পর সবচেয়ে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীকে। দলীয় কর্মীদের নিয়ে নিয়মিত মাঠপর্যায়ে প্রচার চালাচ্ছেন তিনি। ইউনিয়ন–ওয়ার্ড পর্যায়ের ছোট ছোট জনসভা এবং পথসভায় অংশ নিচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
কেন পিছিয়ে অন্য দলগুলো?
মাগুরা–১ আসনে প্রচারে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, এনসিপি বা এবি পার্টির তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয়দের মতে, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অনিশ্চিত প্রার্থী তালিকা, মাঠপর্যায়ে সক্রিয় কর্মী সংকট, সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনাগ্রহ—এসব কারণে বৃহৎ দলগুলো কার্যত মাঠে নেই। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নতুন দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও এ আসনে উল্লেখযোগ্য প্রচার চোখে পড়েনি। একই অবস্থা এবি পার্টি, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলনের বাইরের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও।
ভোটারদের দৃষ্টি কার দিকে?
স্থানীয় ভোটারদের মতে, তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক ভিত্তি সবচেয়ে শক্ত হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতের। দীর্ঘদিন ধরে সাংগঠনিক কাঠামো ধরে রাখায় এই দুই দলই দ্রুত মাঠে সক্রিয় হতে পেরেছে। ভোটারদের পর্যবেক্ষণ: “বিএনপি এবার আগের চেয়ে বেশি সংগঠিত। জামায়াতের তৃণমূলও নীরবে শক্ত। অন্যান্য দলগুলোর প্রচারের কোনো গতি নেই।”
নির্বাচনী মাঠে সক্রিয়তা, প্রচার ও তৃণমূল সংগঠনের ভিত্তিতে ভোটাররা বলছেন, এই আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যেই; ইসলামী আন্দোলনও কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে।
মাঠে সবচেয়ে সক্রিয় — বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন। মাঠে দেখা যায়নি আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, এনসিপি, এবি পার্টি। সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতা চোখে পড়েনি।
বিআলো/ইমরান



