মাদারীপুরে চলছে আড়াইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ি মেলা
মো, হেমায়েত হোসেন খান, মাদারীপুর: মাদারীপুরের কালকিনিতে দীপাবলি ও কালীপূজা উপলক্ষে প্রায় আড়াই শ বছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা শুরু হয়েছে।
মেলা উপলক্ষে পৌরসভার ভুরঘাটা বাসস্ট্যান্ড থেকে কুন্ডুবাড়ি পর্যন্ত ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের দুই পাড়েই প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রায় তিনশত দোকান বসেছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু হওয়া এই মেলা চলবে শনিবার রাত পর্যন্ত। বিভিন্ন দেশীয় পণ্যে সেজেছে মেলার সৌন্দর্য।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি মারামারি, দাঙ্গা, সড়ক দুর্ঘটনাসহ বেশ কিছু অভিযোগ তুলে কয়েকদিন আগে ঐতিহ্যবাহী মেলাটি বন্ধের জন্য প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছিল স্থানীয় আলেম সমাজসহ এলাকার কিছু মানুষ। তবে প্রশাসনের উদ্যোগে সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ বছর তিন দিনের জন্য মেলা অনুষ্ঠিত খাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
গত বৃহস্পতিবার মেলা প্রাঙ্গণে দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা যায়। দোকানিরা পসরা সাজিয়ে বসেছেন। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কাঠের আসবাবপত্রের সমারোহ ঘটেছে মেলায়। ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছেন। সার্বিক নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন।
আয়োজকরা জানান, হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব দীপাবলি ও কালীপূজা। এই পূজার আয়োজন ঘিরে ১৭৮৩ সালে ভুরঘাটা এলাকার দীননাথ কুন্ডু ও মহেশ কুন্তু এই মেলার প্রবর্তন করেন। তাই কুন্ডুদের বংশের নামানুসারে এই মেলার নামকরণ করা হয় কুন্ডুবাড়ির মেলা। সেই সময় দীপাবলির পরের দিন এই অঞ্চলের বিভিন্ন কালী প্রতিমা জড়ো করা হতো। এর মধ্যে যাদের প্রতিমা সেরা হতো, তাদের পুরস্কার দেওয়া হতো। সেই সময় চিত্তবিনোদনের জন্য পুতুলনাচ, কবিগান, জারিগান, পালাগান, নৌকা বাইচের আয়োজন করা হতো। কালের বিবর্তনে পালাগান, জারিগান, নৌকাবাইচ বন্ধ থাকলেও নাগরদোলার আয়োজন এখনও রয়েছে। বংশপরম্পরায় প্রতি বছর এই মেলার আয়োজন করা হয়ে।
বুধবার থেকে মেলা প্রাঙ্গণে গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। এ বছর কালকিনি পৌরসভার সার্বিক তত্ত্বাবধানে মেলা শুরু করা হয়েছে। তিন শতাধিক দোকান বিভিন্ন স্টল করা হয়েছে। কাঠের তৈরি আসবাবপত্র, বেতের তৈরি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, শিশুদের খেলনা, মাটির পণ্য, বিভিন্ন প্রকার খাবার দোকান বসেছে। উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মেলা বসেছে। শুধু কুন্ডুবাড়ি নয়, ঢাকা- বরিশাল মহাসড়কের গোপালপুর থেকে ভুরঘাটা পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে বসেছে শত শত দোকান। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দোকানিরা বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। কাঠের বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্রের জন্য এই মেলা বিখ্যাত। মেলায় মাদারীপুর ছাড়াও ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, মাগুরা, যশোর, নড়াইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা তাদের মাটির, বাঁশের ও কাঠের তৈরি বিভিন্ন মালামাল বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন।
মেলায় ঘুরতে আসা বরিশাল জেলার সাংবাদিক আতাউর রহমান চঞ্চল বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী এই মেলায় প্রতি বছর আসি। তবে আগের তুলনায় এবার লোকজন কিছুটা কম মনে হচ্ছে। হয়তো কাল আসবে। কুণ্ডুবাড়ির কালীমন্দির কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি স্বপন কুন্ডু বলেন, ‘আমার আবেদনের ভিত্তিতে তিন দিনের জন্য মেলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বুধবার মেলা শুরু হলেও আজ থেকে মূল কার্যক্রম চলছে। আমরা চাই সবাই সুন্দরভাবে অনুষ্ঠান উদযাপন করতে। এজন্য সবার সহযোগিতা চাই। মেলায় পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করার জন্য আমি উপজেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই।
এ বিষয়ে স্থানীয় সাংবাদিক বি এম হানিফ বলেন, ‘প্রশাসন মেলার অনুমতি দিয়েছে। যাতে মেলায় কোনও সমস্যা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখবো আমরা। মেলায় দায়িত্ব পালনকালে কালকিনি পৌরসভার উপসহকারী প্রকৌশলী লিটন হোসেন বলেন, ‘মেলায় কোনও ঝামেলা নেই। সুন্দরভাবে চলছে সব কিছু।’ কালকিনি পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উত্তম কুমার দাশ বলেন, ‘পূজা উদযাপন কমিটি, সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে মেলা পরিচালিত হচ্ছে। মেলায় আসা দোকানি, দর্শনার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তায় চার স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন।
বিআলো/তুরাগ