মুসলিম জাগরণের পথিকৃৎ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (র.)
মধ্যযুগে পশ্চিমা দুনিয়া যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন, প্রাচ্য ছিল তখন ইসলামের আলোকপ্রভায় উদ্ভাসিত। বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তির ঘুম থেকে মুসলমানদের যেসকল যুগ-প্রবর্তক; রেনেসাঁর পথে পরিচালিত করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম যুগস্রষ্টা মহাপুরুষ হলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অবিসংবাদিত ঈমাম, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (র.)।
জন্মের পর তার নাম রাখেন ওয়ালিউল্লাহ। দ্বিতীয় নাম রাখেন কুতুবুদ্দীন আহমদ। উপনাম আবু মুহাম্মদ। তিনি শাহ সাহেব নামেও পরিচিত ছিলেন। ৪ শাওয়াল ১১১৪ হিজরী, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে সূর্যোদয়ের সময় আপন নানিবাড়ির ছোট গ্রাম ফুলতে (বর্তমান নাম মুযাফফর নগর) জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা হজরত ইমাম মুসা কাজিম (আ.)’র বংশধর।
পিতার নাম শাহ আবদুর রহীম দেহলভী, মায়ের নাম ফখরুননিসা, পিতামহের নাম শহীদ শাহ ওয়াজিহুদ্দীন, মাতামহের নাম শায়খ মুহাম্মদ ফুলতী। শাহ ওয়ালিউল্লাহর বংশধারা হজরত ফারুকে আজম (রাদ্বি.)’র বংশধারার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তার বংশের প্রথম পুরুষ শায়খ শামসুদ্দিন মুফতি (র.)-সর্বপ্রথম ভারতের রুহিতক নামক স্থানে শুভ আগমন করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহর বর্ণনা থেকে প্রকাশ পায় যে, রুহিতক সে সময়কার নতুন ইসলামী রাজত্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর এবং পশ্চিমা দেশ থেকে দিল্লি আগমনকারী ইসলামী সেনাবাহিনী, মুজাহিদ, দাঈয়ী, মাশায়েখ ও ওলামায়ে কেরামের দিল্লির পথে গুরুত্বপূর্ণ একটি মনযিল ও বিশ্রামস্থল ছিল। শাহ ওয়ালিউল্লাহর পিতা ও পিতামহ ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়কার খ্যাতিমান আলেম। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে প্রণীত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ফতোয়া-ই-আলমগীরি’ সংকলনে অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিলেন, শাহ আবদুর রহিম দেহলভী। দশম হিজরী শতকে এ বংশেরই ভূতপূর্ব ব্যক্তিত্ব আকবরী ফিৎনার মূলোৎপাটন করেন। ভারতবর্ষকে কুফর-শিরক, দ্বীনে ইলাহীর ফিৎনা, নতুন যুগ, নতুন আইন, নতুন সহস্রাব্দ, নতুন নেতৃত্ব ইত্যাদির ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের ছোবল থেকে রক্ষা করেন।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.) সাত বছর বয়স থেকে পিতামাতার সঙ্গে তাহাজ্জুদ নামাযে শরীক হতেন। আর দু’আ করার মুহূর্তে নিজের হাত তাদের দু’জনের হাতে রাখতেন। এভাবে সে স্বপ্ন পূর্ণ হয়, যা তার সম্মানিত পিতা তার জন্মের পূর্বে দেখেছিলেন।
পাঁচ বছর বয়সে তাকে স্থানীয় মক্তবে ভর্তি করা হয়। সাত বছর বয়সে খতনা সম্পন্ন করা হয়। সে বয়স থেকেই তার নামায আদায়ের অভ্যাস গড়ে ওঠে এবং উক্ত বছর শেষে তিনি কুরআনুল কারিমের হিফজ শেষ করেন। এরপর তিনি আরবি ও ফার্সি ভাষার ছোট ছোট কিতাবাদি পড়তে শুরু করেন। সেই সঙ্গে কাফিয়াও সমাপ্ত করেন। দশ বছর বয়সে শরহে জামী পড়া শুরু করেন। তিনি বলেন, আমার মধ্যে সামগ্রিকভাবে মুতালা’আর যোগ্যতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। চৌদ্দ বছর বয়সে পিতার কাছ থেকে বায়যাবী শরীফের একাংশ পড়েন। পনের বছর বয়সে ভারতবর্ষের প্রচলিত শিক্ষা কোর্স সম্পন্ন করলে পিতা এ উপলক্ষে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এবং আড়ম্বরপূর্ণ ভোজের ব্যবস্থা করেন। সেখানে আম-খাছ সকলেই শরীক ছিলেন। পনের বছর বয়সে পিতার কাছে মিশকাত শরীফের সবক নেন। যার মাত্র কিছু অংশ (কিতাবুল বুয়ু থেকে আদাব পর্যন্ত) বাকী ছিল। কিতাবের ইবারত পড়তেন তার অপর এক সাথী। অবশিষ্টাংশেরও অনুমতি পেয়েছিলেন পিতার কাছ থেকে। পিতার কাছেই সহীহ বুখারীর কিতাবুত তাহারাত পর্যন্ত, শামায়েলে তিরমিযী পূর্ণ এবং তাফসীরে মাদারেক পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর বিরাট এক নেয়ামত হলো, আব্বাজানের কুরআনের সবকে কয়েকবার শরীক হয়েছি। যাতে করে কুরআনের মর্মের অপার এক দরজা খুলে গিয়েছে।’
তিনি ‘আল-জযউল লাতীফ’ গ্রন্থে তার পঠিত পাঠ্যসূচির বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। ফিকহ শাস্ত্রে শরহে বেকায়া ও হেদায়া (কিছু অংশ বাদে), উসূলে ফিকহ শাস্ত্রে হুসামী এবং তাওযী ও তালওয়ীহের বিরাট একাংশ, মানতিক শাস্ত্রের ‘শরহে শামসিয়া’ পূর্ণ, ‘শরতে মাতালে’-এর একাংশ, ‘শরহে মাওয়াকিফ’-এর কিছু অংশ পড়েছেন। আত্মশুদ্ধি সম্পর্কে ‘আওয়ারিফ’ ও ‘রসায়েলে নকশেবন্দিয়া’ ইত্যাদির একাংশ, হাকীকত প্রসঙ্গে মাওলানা জামীর ‘শরহে রুবাঈয়্যাত’, ‘লাওয়াইহ’, ‘মুকাদ্দামায়ে শরহে লাম’আত’, ‘মুকাদ্দামায়ে নক্দুল নসূছ, খাওয়াছে আসমা ও আয়াত সম্পর্কে (সে রচনাসমগ্র, যা এ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট) এবং ‘আল-ফাওয়ায়িদুল মিয়াহ’ ইত্যাদি। তার পিতা কয়েকবার এসব খাওয়াছ ও ফাওয়ায়েদের অনুমতি দেন। চিকিৎসা শাস্ত্র ‘মুজিয’, দর্শন শাস্ত্র ‘শরহে হিদায়াতুল হিকমাহ’ প্রভৃতি, মা’আনী শাস্ত্র মুতাওয়ালের সিংহভাগ, মুখতাছারুল মা’আনীর মোল্লা যাদাহ রচিত টীকা সংযুক্ত অংশ। আর গণিত শাস্ত্র কিছু ক্ষুদ্র পুস্তিকা। বর্ণিত পাঠ্যসূচিতে আরবি সাহিত্যের কোনো কিতাব দৃষ্টিগোচর হয় না। অথচ তিনি, আরবি রচনাবলি বিশেষতঃ ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ সাক্ষ্য দেয় যে, তার আরবি ভাষা এবং আরবিতে লিখনী ও রচনায় শুধু প্রতিভা ক্ষমতাই ছিল না বরং আরবি সাহিত্যের মহাপণ্ডিত ও সুলেখক ছিলেন।
‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, তিনি এক্ষেত্রে এমন এক ধারা ও রচনাশৈলীর উদ্ভাবক, যা শিক্ষামূলক প্রতিপাদ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনার জন্য অতীব ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি, যেখানে আল্লামা ইবনে খালদুনের পরে তার সমতুল্য ও সমপর্যায়ের দ্বিতীয় কাউকে দেখা যায় না। এতে বুঝা যায়, তিনি নিজেই আরবি সাহিত্য ও গদ্য-পদ্যের সেসব প্রাচীন উচ্চাঙ্গের কিতাবাদি অধ্যয়ন করেছেন। যা ছিল বাগ্মীতা ও মধুরতার নমুনা, অনারব আরবি শব্দ থেকে অনেকটাই সংরক্ষিত। সৌদি আরবের হেজাজে অবস্থানকালে তিনি বিশেষভাবে আরবিতে এই বিশাল লিখনী কাজের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন, যা আল্লাহর কৌশল-প্রজ্ঞা তার জন্যই নির্ধারিত করে রেখেছিল। তার পিতার ইন্তেকালের পর ১২ বছর পর্যন্ত ধর্মীয় কিতাবাদি এবং যৌক্তিক জ্ঞান-বিদ্যার বই-পুস্তক অধ্যয়নে পাবন্দ ছিলেন। তিনি সৌদি আরব হতে দিল্লিতে ফিরে পিতার স্থাপিত মাদরাসা-ই-রহীমিয়ায় অধ্যাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করে সুদীর্ঘ ১২ বছর শিক্ষকতা করেন এবং নতুন শিক্ষাক্রম চালু করেন, যাতে কুরআন, হাদিস, ফিকাহ, তাসাউফের পাশাপাশি দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেন। মাদরাসাটি ছিল তৎকালীন দিল্লির অন্যতম প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
পিতা তাকে অত্যন্ত স্নেহ ও যত্ন করতেন এবং নিয়মিত তালিম ও তরবিয়ত, ইলম ও কালাম, কর্মকৌশল, মজলিসের শিষ্টাচার, সভ্যতা-ভদ্রতা ও বিচক্ষণতা শিক্ষা দিতেন। তিনি প্রায় তাকে আদেশ করে বলতেন, ‘যারা মর্যাদায় ছোট, তাদের সঙ্গে সর্বদা সালামের ব্যাপারে অগ্রসর থাকবে। তাদের সঙ্গে সবসময় উত্তমভাবে মিলিত হবে। তাদের ভালোমন্দ ও কুশলাদি জিজ্ঞাসা করবে আর তাদেরকে সাধারণ বা তুচ্ছ বিষয় বুঝাবে না। চাল-চলন, উঠাবসায় কোনোভাবেই যেন দুর্বলতা কিংবা আলস্য প্রকাশ না পায়’। শাহ ওয়ালিউল্লাহ পিতার কাছেই চৌদ্দ বছর বয়সে বায়’আত হন এবং তাসাউফ চর্চায় আত্মনিয়োগ করে নক্সবন্দিয়া তরিক্বায় তাওয়াজ্জুহ ও তালকীন হাসিল করেন। পিতাই তাকে আদাবে তরিকতের একাংশ শিক্ষা দেন এবং বুযুর্গির খিরকা (বিশেষ পোশাক) পরিধান করান। তার বয়স যখন সতের বছর, তখন পিতা এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। মৃত্যুশয্যায় পিতা তাকে বায়’আত ও ইরশাদের অনুমতি দেন। বারবার বলেন, ‘তার হাত আমার হাতেরই মতো’।
চৌদ্দ বছর বয়সে পিতার সম্মতি ও অনুমতিক্রমে মামা শায়খ উবাইদুল্লাহ সিদ্দিকী ফুলতীর কন্যার সঙ্গে শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ হন। সে ঘরে জন্মলাভ করেন বড় ছেলে শায়খ মুহাম্মদ; তার জন্য তিনি একটি প্রাথমিক পুস্তিকাও রচনা করেছিলেন। শায়খ মুহাম্মদ ছিলেন ক্বারী এবং শামায়েলে তিরমিযীর সবকে শাহ আবদুল আযীয (র)-এর সহপাঠী। শায়খ মুহাম্মদ পিতার ইন্তেকালের পর বড়হানা গ্রামে চলে যান। দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করে ১২০৮ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তাকে গ্রামের জামে মসজিদের বারান্দায় দাফন করা হয়। শায়খ মুহাম্মদের দুই পুত্রের বর্ণনা মাকালাতে তরীকতের আলোচনায় পাওয়া যায়, যারা তার সঙ্গেই সমাহিত হয়েছেন।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ (র.)-এর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর সাইয়িদ সানাউল্লাহ সোনাপতীর কন্যা বিবি ইরাদতের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ ঘরে খ্যাতিমান চার পুত্র জন্মগ্রহণ করেনÑ ১. হযরত শাহ আবদুল আযীয (র), ২. শাহ রফীউদ্দীন (র), ৩. শাহ আবদুল কাদির (র), ৪. শাহ আবদুল গণী (র)। যারা ছিলেন ভারতবর্ষের দ্বীন-ধর্মের পুনর্জাগরণের চার সদস্য। আমাতুল আযীয নামে এক কন্যাও জন্মগ্রহণ করেন। তার বিয়ে হয় মাওলানা মুহাম্মদ ফাইক ইবনে মাওলানা মুহাম্মদ আশেক ফুলতীর সঙ্গে। তিনি ছিলেন কয়েক সন্তানের জনক। তার থেকে বংশধারা চালু থাকে। শাহ ওয়ালীউল্লাহ (র.)-‘আল-জুযউল লাতীফ’ গ্রন্থে লিখেন, ১১৪৩ হিজরীতে হারামাইন শরীফাইন জিয়ারতের আগ্রহ প্রবল হয়ে যায়। তখন বয়স ৩০ বছর। ১১৪৩ হিজরীর শেষ দিকে (যিলহজ মাসে) হজ পালনের সৌভাগ্য হয়। ১১৪৪ হিজরী পর্যন্ত তিনি বাইতুল্লাহর নৈকট্য লাভ করেন। অনন্তর মদীনা শরীফ জিয়ারতে ধন্য হন। সেখানে তিনি শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে শায়খ আবু তাহের মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম কুরদী মাদানী ও শায়খ সুলায়মান মালিকের কাছে হাদীস বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞান লাভ করেন। শায়খ হাসান উজাইমা, আহমদ নাখলী, শায়খ আবদুল্লাহ বাছারী (শামায়েলে নববী দ. এবং মুসনাদে ইমাম আহমদ), শায়খ আবদুল্লাহ লাহোরী, আবদুল হাকীম শিয়ালকুটী ও শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভীর কিতাবাদি রিওয়ায়াত করার অনুমতি লাভ করেন। শায়খ সাঈদ কোকানীর কাছে কিছু আরবি কিতাব এবং ফাতহুল বারীর একাংশ পড়েন। এছাড়া তিনি শায়খ তাজউদ্দীন হানাফী, মুফতী-ই-মক্কা শায়খ আলাবী প্রমুখ বিশিষ্ট আলেমের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। শায়খ আবু তাহের খিরকা পরিধান করান, যা ছিল প্রায় সুফিগণের সকল খিরকার সমন্বয়। শায়খ আবু তাহের বলতেন, শায়খ ওয়ালীউল্লাহ আমার থেকে শব্দের সনদ গ্রহণ করেন আর আমি তার থেকে হাদীসের মর্মার্থ অনুধাবনে লাভবান হই। এরূপই লিখেছেন তার অনুমতিপত্রেও। শায়খ আবু তাহের বড় মাপের মুহাদ্দিস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুুুফিগণের প্রতি বড় শ্রদ্ধাশীল এবং তাদের সমালোচনা করা থেকে বিরত ছিলেন। উক্ত বছর শেষে ১১৪৪ হিজরীতে পুনরায় তিনি হজ্জব্রত পালন করেন। ১১৪৫ হিজরীর প্রথম দিকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১০ রজব ১১৪৫ হিজরী শুক্রবার দিল্লিতে পৌঁছান। উল্লেখ্য যে, ওলামায়ে কেরাম ও তালেবে ইলমদের আবেদনের পরিপেক্ষিতে তিনি মসজিদে হারামে মুসাল্লায়ে হানফীর পাশে দরস শুরু করেছিলেন। সেখানে লোকের ভীড় জমতো।
হযরত আবদুল আযীয (র)-বলেন, ‘আমি আমার আব্বাজানের মতো প্রখর ধীমান স্মরণশক্তির অধিকারী কাউকে দেখিনি। শোনার কথা তো অস্বীকার করতে পারি না। জ্ঞান-বিদ্যা ও নানামুখী যোগ্যতা ছাড়া সময়ানুবর্তিতায়ও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। ইশরাকের পর যেভাবে বসতেন, দুপুর পর্যন্ত না পা বদলাতেন; না চুলকাতেন আর না থুথু ফেলতেন। প্রত্যেক শাস্ত্রের জন্য একেকজন লোক তৈরি করেছিলেন। তিনি শরিয়ত, তরিক্বত, হাকিকত ও মারিফাতের বর্ণনা, সংকলন ও রচনায় ব্যস্ত থাকতেন। হাদীস মুতালা’আ ও দরস দিতেন। যে বিষয় বিকশিত হয়ে যেত, তা লিখে নিতেন। অসুস্থ হতেন খুব কম। মহান দাদা ও মুহতারাম চাচা (যিনি চিকিৎসক ছিলেন) মানুষের চিকিৎসা করতেন। আব্বাজান এই পেশাকে স্থগিত রাখেন। তবে চিকিৎসা সম্পর্কিত বই-পুস্তক মুতালা’আ করতেন। শৈশব থেকেই মন-মানসে স্বচ্ছতা, পরিচ্ছন্নতা ও নমনীয়তা ছিল। সুুফি ধরনের ছন্দ-কবিতা কম পড়তেন। তবে মাঝে মধ্যে কোনো কোনো কবিতা পড়তেন।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের মৃত্যুর চার বছর আগে এবং ইন্তেকাল করেন দিল্লির অন্ধ সম্রাট শাহ আলমের আমলে। ফলে তিনি দিল্লির দশজন সম্রাটের শাসনকাল প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। তিনি ক্ষয়িষ্ণু মুঘল সাম্রাজ্যের অনেক বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলার দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করেন। বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য তখন কার্যত খণ্ড-বিখণ্ড। কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত ও বিচ্ছিন্ন শাসকগণ ছিলেন আত্মকলহে লিপ্ত। এককথায় সাম্রাজ্যের রাজনীতি এ সময় হয়ে পড়েছিল পুরোপুরি গণবিচ্ছিন্ন এবং নীতিবিবর্জিত। শাসক সমাজ ও আমীর-উমরাহ এবং রাজানুকূল্য লাভকারী মুসলিম ধনিকশ্রেণির মধ্যে চরম বিলাসিতা, নিষ্ক্রিয়তা ও নির্বীর্যতা বাসা বেঁধেছিল। মদ্যপান, সংস্কৃতির নামে বাইজীচর্চাসহ নানা চারিত্রিক স্খলন ও অবক্ষয় সমাজের উচ্চশ্রেণিকে নৈতিকভাবে পঙ্গু করে ফেলেছিল। আঠারো শতকের মুসলিম সমাজে দিল্লি থেকে মুর্শিদাবাদ, ঢাকা, সোনারগাঁও কিংবা চট্টগ্রাম সর্বত্র একই অবস্থা বিরাজ করছিল। সমকালীন সাধারণ মুসলিম সমাজের নৈতিক, তামুদ্দুনিক ও সামাজিক অবক্ষয় চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। আকীদা-বিশ্বাস, আচার-আচরণ, নৈতিক ও বৃত্তি ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সৃষ্টি হয়েছিল সার্বিক বিপর্যয়। আঠারো শতকের মুসলিম সমাজে কুরআন-সুন্নাহর আদর্শের পরিবর্তে শিরক, বিদআত, হিন্দু মিথ প্রভাবিত সুফীতত্ত্ব, দ্বীন ও শরীঅতের পরিপন্থি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান প্রাধান্য লাভ করেছিল। ইসলাম যে পূর্ণাঙ্গ বৈপ্লবিক আদর্শ এবং শান্তি ও স্বাধীনতার রক্ষাকবচ এবং এটিই যে সভ্যতা নির্মাণ ও হিফাযতের মৌল উপাদান, সে ধারণা সমাজ থেকে প্রায় লোপ পেয়েছিল। আলেমগণ কুরআন-হাদীসের চর্চা বাদ দিয়ে ফিকাহের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বিবাদ-বিসম্বাদে লিপ্ত ছিলেন। মুসলমানগণ তাদের জীবন থেকে সংগ্রামকে নির্বাসন দিয়েছিলেন। মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে ইসলামী আদর্শের প্রেরণা লোপ পেয়েছিল। জিহাদের প্রেরণা ভুলে তারা হয়ে পড়েছিল নিছক ভাড়াটিয়া বা চাকুরে। এ পরিস্থিতির মোকাবিলায় মুসলিম জাতির শিক্ষা এবং দ্বীনি ও নৈতিক উন্নয়নের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তা বা ফুরসত কোনোটাই আলমগীরের উত্তরাধিকারী সম্রাট এবং তৎকালীন সুবাহদারদের ছিল না। বংশীয় শাসন ও গদি রক্ষার কাজেই তাদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা নিয়োজিত ছিল। মুসলিম শাসকদের দুর্বলতা ও অসচেতনতার সুযোগে সে সময় বাংলায়; ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারিদের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। তারা এখানে খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রচার শুরু করে। হুগলী, ঢাকা, শ্রীপুর ও পিপলীতে কেন্দ্র স্থাপন করে তারা হাজার হাজার মুসলমান ও হিন্দুকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে। স্থানীয় মুঘল শাসকগণ এতে বাধা দেননি; বরং আলেমদের দুর্বল প্রতিরোধের মোকাবিলায় এই শাসকরা মিশনারিদেরকেই সাহায্য করেছেন। এমনি পরিস্থিতিতে বাংলা ও দক্ষিণ ভারতের উপকূল এলাকায় ইংরেজদের বাণিজ্যিক কুঠিগুলো অস্ত্রাগার ও কেল্লায় পরিণত হচ্ছিল। ইংরেজ ও ফরাসি বণিকদের সঙ্গে পর্তুগিজ ও ওলন্দাজ বণিকদের দীর্ঘদিন ধরে সংঘাত চলে। পর্তুগিজ ও ওলন্দাজ প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে বিতাড়িত করার পর ইংরেজরা এ দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার দিকে নজর ফেরায়। দেশের ভেতরকার অনৈক্যের সুযোগ; তারা পুরোপুরি কাজে লাগায়। হিন্দুস্তানের কোনো প্রদেশে ক্ষমতার দুই দাবিদারের মধ্যে লড়াই বাধলে সাহায্যের জন্য একপক্ষ হাত পাততেন ইংরেজদের কাছে, অপরজন ধরনা দিতেন ফরাসিদের কাছে।
সমকালীন সময়ের নাজুক অবস্থা থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে সঠিক ইসলামে ফেরার জন্য তিনি অভূতপূর্ব গবেষণাধর্মী কাজের আঞ্জাম দিয়েছেন। যথা- ১. আক্বীদা সংশোধন, ২. নতুন করে তাওহিদের দাওয়াত, প্রচারণা এবং প্রয়োজনিয়তা, ৩. কুরআন ভিত্তিক রোগের চিকিৎসা ও অবস্থা সংশোধন, ৪. দরসুল কুরআন (কুরআনুল করিমের ফারসি তরজুমা), ৫. তাওহীদের উপর জ্ঞানগত তত্ত্ব ও গবেষণা, ৬. আকাঈদের তত্ত্বজ্ঞান, ৭. দরসুল হাদীস ও সুন্নাতের প্রচার-প্রসার, ৮. ফিকাহ ও হাদিস শাস্ত্রের মধ্যে সমন্বয় সাধন, ৯. ইজতিহাদ ও তাকলীদের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা।
শাহ ওয়ালিউল্লাহর বড় হাতিয়ার ছিল লেখনী শক্তি। তিনি অসংখ্য গ্রন্থ ও রেছালা রচনা ও সংকলন করেছিলেন। তন্মধ্যে কয়েকটি হলো- ১. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা (ইসলামি আইনশাস্ত্র), ২. ফাতহুর রহমান ফি তরজমাতুল কোরআন (কোরআনের ফার্সি অনুবাদ), ৩. ফতহুল খাবির (কোরআনের ব্যাখ্যা গ্রন্থ), ৪. আল ফাওযুল কাবির ফি উসুলিত তাফসির, ৫. ইযালাতুল খিফা আন খিলাফাতুল খোলাফা, ৬. বুদুরুল বাজিগাহ, ৭. ফুয়ুদুল হারামাইন (মক্কা মদিনার অভিজ্ঞতা), ৮. আল কাওলুল জামিল, ৯. আত তাফহিমাতুল ইলাহিয়্যাহ, ১০. আল আকিদাতুল হাসানাহ, ১১. মুস্তফা (মুয়াত্তা ইমাম মালেকের ফার্সি ব্যাখ্যা গ্রন্থ), ১২. মুসাওয়া (মুয়াত্তার আরবি শরাহ), ১৩. শরহে তারাজিমে আবওয়াব সহীহ বুখারী, ১৪. মজমু’আয়ে রাসয়েলে আরবা’আ, ১৫. মুসালসালাত, ১৬. আল আকিদাতুল হাসানাহ, ১৭. আল-ইনসাফ ফি বায়ানি আসবাবিল ইখতিলাফ, ১৮. সীরাতে রাসূল, ১৯. ফুয়ুযুল হারামাইন, ২০. আল বালাগুল মুবীন, ২১. আল খাইরুল কাসীর শরহে আল ফাউযুল কাবীর, ২২. রাহমাতুল্লাহিল ওয়াসিয়া, ২৩. আল কওলুল জামিল ফি বায়ানি সাওয়ায়িস সাবিল, ২৪. ইযালাতুল খিফা, ২৫ তাফহীমাতে ইলাহিয়া, ২৬. আল মুসাওয়া বাইনাল মুসলিমিন, ২৭. শিফাউল কুলুব, ২৮. আল ইনতিবাহ ফি সালাসিলিল আউলিয়া, ২৯. ফুয়ুজুল হারামাইন, ৩০. আলতাফুল কুদস, ৩১. আল-জযউল লাতীফ, ৩২. মাকালাকে তরীক্বত, ৩৩. তাফহীমাতে এলাহী।
শাহ ওয়ালীউল্লাহর বহুমুখী অবদানের কয়েকটি উল্লেখ করা হলোÑ ১. ইসলামের ইতিহাস ও মুসলমানদের ইতিহাস এক নয়, ২. খিলাফত ও রাজতন্ত্র দুই জিনিস, ৩. জাহিলি বনাম ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণা, ৪. মাজহাব প্রশ্নে অনৈক্য মুসলমানদের দ্বিতীয় প্রধান মৌলিক সমস্যা, ৫. ইজতিহাদ ফরজে কেফায়া (নাকের দড়ি খুলতে হবে), ৬. ইসলামি সমাজদর্শনের ইমারত নির্মাণ, ৭. গণবিপ্লবের কর্মসূচি, ৮. মারাঠা ও শিখ হামলার মুকাবিলা, ৯. মধ্যযুগ শেষ (কলম হবে হাতিয়ার), ১০ বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান, ১১. রাজনৈতি চিন্তা ও পরামর্শ, ১২. তাসাউফচর্চার প্রচার-প্রসার।
ভারতীয় উপমহাদেশে শাহ ওয়ালীউল্লাহর প্রভাব। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলোÑ ১. মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণ, ২. রাজনৈতিক চিন্তার উত্তরাধিকার, ৩. পারিবারিক উত্তরাধিকার, ৪. উনিশ শতকের মুক্তি, ৪. উপমহাদেশীয় মুসলিম গণবাহিনী জিহাদ আন্দোলন, ৫. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ৬. বালাকোট যুদ্ধ, ৭. ফরায়েজী আন্দোলন, ৮. জিহাদ আন্দোলনে বাংলার ভূমিকা, ৯. তিতুমীরের জিহাদ আন্দোলন, ১০. সিপাহী বিপ্লব, ১১. শামলী যুদ্ধ, ১২. ইসলামিক শিক্ষা ও গবেষণায় প্রভাব, ১৩. দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা।
তিনি সমকালীন সময়ের অবস্থা ও পরিস্থিতি পুনঃবিবেচনা, পর্যালোচনা, সমালোচনা ও গবেষণার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনের বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছিলেন। তা হলোÑ ১. ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব, ২. উপমহাদেশে ইসলামি ঐক্যের অভাব, ৩. নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ অসংখ্য ধারায় সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তন্মধ্যে অন্যতম হলো ১. ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, ২. সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার, ৩. ওয়াজ-নসিহত সংস্কার, ৪. বিরাজমান পরিস্থিতির সমালোচনা ও পর্যালোচনা, ৫. মানসিক ও তাত্ত্বিক সংস্কার, ৬. লেখালেখী ও গবেষণা, ৭. শিক্ষানীতি সংস্কার।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ; ইসলামি ভাবধারা ও ইসলামি পুনর্জাগরণ নিশ্চিতকল্পে এবং ভ্রান্ত মতবাদ ও অনৈক্য দূর করার লক্ষ্যে বিশিষ্টজনদের নিকট উদাত্ত আহ্বান ও বাণী পেশ করেছিলেন। তন্মধ্যে অন্যতম হলোÑ ১. বাদশাহ বা শাসক গোষ্ঠীর প্রতি, ২. আমির ও উমরাহদের প্রতি, ৩. সৈনিক বাহিনীর প্রতি, ৪. শিল্পপতি ও ব্যবসায়িকদের প্রতি, ৫. ভ্রান্ত পীরজাদাদের প্রতি, ৬. স্বার্থন্বেষী আলেমদের প্রতি, ৭. ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়িকারীদের প্রতি, ৮. শ্রেণি নির্বিশেষে সকল মুসলমানদের প্রতি।
ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম সিহাহ সিত্তাহ পাঠদানকারী শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, মুসলিম উম্মাহর চেতনার বাতিঘর শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী ঊনষাট বছর ছয় মাস আট দিনের মাথায় ২৯ মুহররম, ১১৭৬ হিজরী, ২০ আগস্ট ১৭৬২-সাময়িক অসুস্থতার পর ইন্তেকাল করেন।
তথ্য সংযুক্তি-
১. বাংলার মুসলিম জাগরণের দুই পথিকৃৎ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও জামাল উদ্দীন আফগানী- মোহাম্মদ আবদুল মান্নান।
২. তাযকেরাতুল আওলিয়া, মাওলানা নুরুর রহমান।
৩. শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী রহ. ও তার সংস্কার কর্মসূচি, মুফতী আলী মুরতাজা সিরাজী।
লেখক: কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী
(কলামিস্ট ও ব্যাংকার)
বিআলো/তুরাগ