মেয়র লিটনের সংস্পর্শে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আউয়াল
নজরুল ইসলাম জুলু: রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ শামসুজ্জামান আউয়াল সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলির সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের সংস্পর্শে শত শত কোটি টাকার মালিক বনেছেন।
আউয়াল অপসারিত মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের এতটাই আস্থাভাজন ছিলেন যে, সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন কাজ থেকে শুরু করে রাজশাহীর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে সবকিছুতে আউয়ালের কথা-ই ছিল শেষ কথা। দৃশ্যমান কোনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও শামসুজ্জামান আউয়াল লিটনের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারনে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের কোটায় এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক হয়েছেন। ৫ই আগষ্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর লিটনের আস্থাভাজন আউয়াল তার নেতা লিটন ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাকর্মীদের পদানুসরণ করে আত্মগোপনে রয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, আউয়ালের আবির্ভাব ঘটে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ঠিকাদারির মাধ্যমে। এরপর রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় উন্নয়ন মূলক কাজ, জমি কেনাবেচা, পুকুর ভরাট করে বিক্রি, ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে সহযোগিতা ইত্যাদি কাজ করে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে আউয়াল এখন হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
২০০৮ সালে খায়রুজ্জামান লিটন রাসিক মেয়র পদে বসার পর থেকেই আউয়ালকে পিছনে ফিরে থাকাতে হয় নি। মেয়র হওয়ার পর থেকেই লিটবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী আউয়ালের উত্থান শুরু হয়। রাজশাহী মহানগরীর ঠিকাদারি কাজের একক নিয়ন্ত্রক ছিলেন আউয়াল। লিটনের সাথে সুসম্পর্কের থাকায় নগর ভবনের পাশের বহুতল ভবন দারুচিনি প্লাজা নির্মাণ ও সোনাদীঘি এলাকায় বৈশাখী মার্কেটের কাজ আউয়াল নিজের নামে নেন। ভবন মির্মাণের জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে রেখেছেন নিজের কাছে। কিন্তু, দুটি মার্কেটের নির্মাণ কাজ ১৫ বছরেও তিনি শেষ করেননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক বিনিয়োগকারী জানান, বৈশাখী মার্কেটে দোকান পেতে আউয়ালকে টাকা দিয়েছেন। এখন দোকান পাচ্ছেন না, টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না।
সূত্র মোতাবেক, ইসলামী ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির মূলহোতা নাবিল গ্রুপের সঙ্গে খায়রুজ্জামান লিটনের পাশাপাশি ঘনিষ্ঠতা আছে তার ব্যবসায়িক অংশীদার ও একান্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক শামসুজ্জামান আউয়ালেরও। গত ৭ই জুলাই ঋণ জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে নাবিল গ্রুপের ১১টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জানা গেছে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং পর্যাপ্ত সম্পত্তি বন্ধক ছাড়াই নাবিল গ্রুপ রাজশাহী অঞ্চলে ইসলামী ব্যাংকের তিনটি শাখা থেকে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, এর নেপথ্যে কলকাঠি নাড়িয়ে সহায়তা করেছেন খায়রুজ্জামান লিটন।
নাবিল গ্রুপের সঙ্গে লিটন-আউয়াল জুটির ব্যবসায়িক সম্পর্ক প্রথম প্রকাশ পায় ২০২১ সালে। ওই বছর রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় অবস্থিত ১২৬ কাঠার পুকুর সিটি করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহার করে ভরাট করা হয়। ২০২২ সালে পুকুরটির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়। সে সময় জানা যায়, লিটন-আউয়াল জুটি এই জমিতে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের জন্য নাবিল গ্রুপের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
জানা যায় যে, রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর ভাটাপাড়ার নুরুল ইসলাম মারা যান ২০২১ সালে। সিটি কর্পোরেশন ও হাসপাতালের মৃত্যু সনদ অনুযায়ী সে তারিখ ২০২১ সালের ১ জুন। তার মৃত্যুর কারণ ব্রেন স্ট্রোক। মৃত্যুর ১৩ দিন আগে তার স্বাক্ষরে আরডিএর কাছে একটি আবেদন জমা পড়ে। তাতে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া একটি পুকুর ভরাট হওয়ায় শ্রেণি পরিবর্তন করে বাড়ি নির্মাণের অনুমতি চাওয়া হয়। তার ছেলে আসাদুজ্জামান অভিযোগ করেন, সে সময় আমার বাবা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী থাকায় এ আবেদন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আবেদনের সে স্বাক্ষরও ভুয়া বলে দাবি তাদের।
এছাড়াও, শামসুজ্জামান আউয়ালের বিরুদ্ধে নগরীর মুশরইল এলাকায় শামসুল আরেফিন নামে অবসরপ্রাপ্ত এক পুলিশ কর্মকর্তার জমি দখল করার অভিযোগ উঠেছিল। এ ঘটনায় আদালতে মামলা করেন ঐ ব্যক্তি। শামসুল আরেফিন জানান, তার জমিটি দখলে নিতে শামসুজ্জামান আউয়াল ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌহিদুল হক সুমনের ক্যাডার বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। তারা তাকে নানাভাবে হুমকিও দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন তিনি। তবে, সে সময় শামসুজ্জামান আউয়াল দাবি করেছিলেন, তিনি জমি দখলের চেষ্টা করেননি। ওই জমিতে সিটি কর্পোরেশন কবরস্থান করবে বলে তিনি শুনেছেন। জমিটি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় আছে।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আরসিসিআই) সাবেক এক পরিচালক বলেন, গত পাঁচ বছর ধরে নাবিল গ্রুপ পেছন থেকে আরসিসিআই নিয়ন্ত্রণ করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই পরিচালক বলেন, ‘খায়রুজ্জামান লিটনের প্রভাবে শামসুজ্জামান আউয়াল স্বপনের স্ত্রী ইসরাত জাহানকেও নাবিল গ্রুপের পরিচালক দেখিয়ে আরসিসিআই পরিচালক করেন। ’রাজশাহী চেম্বারের সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, ‘শামসুজ্জামান আউয়াল ঠিকাদার হিসেবে চেম্বার অব কমার্স থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন। তার আর কোনো ব্যবসা আছে কি না জানা নেই।’
বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, আউয়ালের একাধিক দামি গাড়ি ও বিপুল পরিমাণ অর্থের সম্পত্তি আছে। প্রভাব খাটিয়ে তিনি তার ভাইকে করে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বানিয়ে ছিলেন বলেও অনেকে অভিযোগ করেন।
জানা যায়, কথিত এই নেতার সহচর বা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন টেলিভিশন চ্যানেলের ৪ জন এবং প্রিন্ট মিডিয়ার ২ জন সাংবাদিক। এই সাংবাদিকদের আউয়াল তার ব্যক্তিগত স্বার্থে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতেন। আউয়ালের সান্নিধ্যে এরাও কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। বিগত স্বৈরাচার শাসনামলে এই সাংবাদিকরাই আউওয়ালের বিভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে গেছেন। তবে এখন ৫ই আগষ্টের পর তারা ভেল পালটে বর্তমান সরকারকে খুশি করতে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ করছে বলে জানা যায়।
এই ধরনের তেলবাজ সাংবাদিক ও লিটনের সহযোগিতায় আউয়াল শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে জানা যায়। স্বৈরাচারের পদলেহন করে কোটি টাকার মালিক হওয়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে ফৌজদারি আইনে মামলা করেছে মহানগর বিএনপি’র পক্ষ থেকে। সেইসাথে আউয়াল ও তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত শুরু করেছেন বলে বিশেষ সূত্র জানায়।
এইদিকে, ৫ আগষ্টের পর থেকে শামসুজ্জামান আউয়ালকে বাইরে দেখা যায়নি। তবে বিভিন্ন সূত্রের দাবি নগরীর দরগাপাড়ার বাড়িতে তিনি পরিবারসহ থাকছেন। এইদিকে, আউয়ালের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে জানতে তার মুঠোফোন নম্বরে কল দিলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয় নি।
বিআলো/তুরাগ