যেমন ছিল পূর্ববর্তী নবীদের রোজা পালন
বিআলো ডেস্ক: রমজান মাস হিজরি নবম মাস। এ মাসের মর্যাদা সকল মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ইসলামের অন্যতম বিধান রোজা এ মাসে পালিত হয়। ধনী-গরিব, সাধারণ মুসলিম, সাহাবায়ে কেরাম রা., নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম–সকলের জন্যই এ বিধান। রোজা শুধু নবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতের উপরই ফরজ নয়; বরং এটি সূচনা হয় অনেক পূর্ব থেকেই, পূর্ববর্তী উম্মতের ওপরও ফরজ করা হয়েছিল।
কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনটি তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের ওপর ফরজ করা হয়েছিল।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৩).
কিন্তু তাদের সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল নবীগণের রোজা। তারা আল্লাহ তায়ালার রোজার বিধান যথাযথ-ই পালন করেছেন। এবং খুবই নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন। তাদের জন্য-ই হেদায়াতের বাতিঘর আজ দেদীপ্যমান। তাদের সিয়াম-সাধনা আমাদের আল্লাহ তায়ালার অনুপম বিধান পালনের সঠিক পদ্ধতি শেখায়। পূর্ববর্তী নবীগণ ও তাদের উম্মতের মধ্যে রোজার বিধান থাকলেও রোজার ধরনে ভিন্নতা ছিল।
হযরত আদম আ.-এর রোজা-
আদম আ.এই পৃথিবীতে প্রথম নবী। তিনি-ই প্রথমে রোজা পালন করেন। তার রোজা কেমন ছিল–এ ব্যাপারে কোরআন,হাদিসের আলো,ইতিহাস ও ইতিহাসবিদদের থেকে জানা যায়,আল্লাহ তায়ালা তাকে একটি নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করতে নিষেধ করেন। তিনি এ বিষয়টি ভুলে গিয়ে সেই বৃক্ষ থেকে ফল আহার করেন। পরক্ষণেই আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করেন। এবং তাকে এই পৃথিবীতে নামিয়ে দেন।
এদিকে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল শরীরের রং পাল্টে দেয়; দেহ কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। বিষণ্ন হৃদয় ব্যথিত করে তুলে আদম আ.-কে। আল্লাহ তায়ালা জিবরাইল আ.-কে প্রেরণ করেন। জিবরাইল আ.বললেন,আপনি কি চান,আপনার দেহ শুভ্রতা ফিরে পাক? আদম আ. বললেন, হ্যাঁ। জিবরাইল আ. বললেন,তাহলে প্রতি মাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখে রোজা রাখুন। তিনি রোজা রাখা শুরু করলে প্রথম দিনে শরীরের এক-তৃতীয়াংশ শুভ্র হয়ে যায়, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন একই পরিমাণ শুভ্রতা ফিরে পায়। তখন থেকেই এ রোজা ‘আইয়ামে বিয’ হিসেবে পরিচিত লাভ করে।
‘হাজায়িরুল কুদস’নামক কিতাবে উল্লেখ আছে, আদম আ.-এর এ ঘটনায় কিছু সুফিয়ায়ে কেরাম আদম আ.-এর উপর ৩০ দিন রোজা ফরজ হওয়ার কথা বলেছেন। তবে এ কথাটি প্রমাণিত নয়। (ফতহুল বারি: খণ্ড:৪,পৃষ্ঠা:১২৩)
শরিয়তপ্রাপ্ত প্রথম রসুল নুহ আ.। তিনিও রোজা রেখেছেন। সারে নয়শত বছর ধরে উম্মতকে সঠিক পথের দিকে আহবান করেন। তার নামেই কোরআনে অবতীর্ণ হয়েছে একটি সুরা। তার ব্যাপারে বলা হয় যে, তিনি সারা বছরই রোজা রাখতেন। তবে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ব্যতীত। (ইবনে মাজাহ, হাদিস :১৭১৪) তবে ইতিহাসের অন্যত্র একথাও পওয়া যায়,যখন নুহ আ.বিনাশী পলাবন থেকে মুক্তি পেলেন, তখন শুকরিয়া আদায়ের লক্ষ্যে আদম আ.-এর মতো ‘আইয়ামে বিয’-এর তিনটি রোজা রাখতে শুরু করেন।
ইবরাহিম আ.ও রোজা রেখেছেন। শেষনবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পূর্বপুরুষ হলেন ইবরাহিম আলাইহিস-সালাম। যার বংশ থেকে অসংখ্য নবী-রসুল এসেছেন। কেরআনের অসংখ্য জায়গায় যার কথা উল্লেখ আছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইবরাহিম আ.ও প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখতেন। এ ব্যাপারে তিনি হজরত আদম আ.-কে অনুসরণ করে। তবে কিছু হাদিসে এসেছে, ইবরাহিম আ.পুরো মাসেই রোজা রাখতেন। এক্ষেত্রে মুফাসসিরগণ বলেন, মূলত তিনটি রোজার প্রতিদানের প্রতি লক্ষ্য করে এ কথা বলা হয়েছে। হাদিসে এসেছে, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সাহাবিকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘তুমি প্রতি মাসে তিনটি করে রোজা রাখো, একটি নেক আমলের প্রতিদান-ই দশটি করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি,হাদিস:৩৪১৮; মুসলিম,হাদিস:১১৫৯)
দাউদ আ. রোজা রাখতেন। আল্লাহ তায়ালার নির্বাচিত একজন নবী হলেন দাউদ আলাইহিস-সালাম। তিনি ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক। কোরআনের ভাষ্যে যাকে আল্লাহ তায়ালার প্রতিনিধি বলা হয়েছে। আসমানি কিতাব ‘যাবুর’ যার উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে। তিনি অর্ধমাস রোজা রাখতেন। একটি রোজা রাখতেন আর একটি ভাঙ্গতেন। অন্য সকল নবীগণের মধ্যে তার রোজা ছিল শ্রেষ্ঠ রোজা। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রোজার প্রশংসা করেন এবং সামর্থ্যবান সাহাবিদের এ রোজা রাখতে নির্দেশও দেন।
সুলাইমান আ.-এর রোজা। তিনি আল্লাহর তায়ালার মনোনীত একজন নবী– যিনি প্রাচীনকালে বর্তমানে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন রাজ্যের একজন ধার্মিক এবং আল্লাহ তায়ালার নির্বাচিত রাজা হিসাবে ইসলাম ধর্মে পরিচিত। তিনি প্রতি মাসে নয়টি করে রোজা রাখতেন। মাসের প্রথম দশকে তিনটি মাঝের দশকে তিনটি ও শেষ দশকে তিনটি। (কানযুল ওম্মাল,হাদিস :২৪৬২৪)
ঈসা আ.-এর রোজা রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালার একজন প্রিয় নবী হলেন ঈসা আলাইহিস-সালাম । তিনি ছিলেন ইসায়ি তথা খৃষ্টানদের নবী। পিতা ব্যতীত-ই মারইয়াম আ.-এর গর্ভে অলৌকিকভাবে জন্মগ্রহণ করেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে অনেক মুজেযা প্রদান করেছেন। তিনি পাখি, গোশত ও প্রাণ আছে এমন সব প্রাণী খাওয়া থেকে বিরত থাকতেন। আর এটাই ছিল তার রোজা (তাফসিরে তাবারি:৩,পৃষ্ঠা :৪১১)
মারইয়াম আ.-এর রোজা রাখতেন। তিনি ছিলেন একজন মহীয়সী নারী, যাকে আল্লাহ তায়ালা নবী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। তিনি ছিলেন ইসহাক আ..-এর বংশধর। তবে তিনি ইসা আ.-এর মা হিসেবেই পরিচিত। তিনি রোজা রেখেছেন, নিশ্চুপ থাকার মাধ্যমে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, তুমি খাও, পান করো ও নয়ন জুড়াও। যখন তুমি কোনো মানুষকে দেখতে পাবে তখন বলবে, আমি আল্লাহর নামে রোজার মানত করেছি, আমি কখনো আজ কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলব না। (সুরা: মারইয়াম, আয়াত: ২৬)
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সকলের প্রিয় নবী হচ্ছেন মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। অন্য শরিয়তের নবীদের ধারাবাহিকতায় আমাদের নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওপরও ফরজ করা হয় এ রোজা। কিন্তু রোজার মহত্ত্ব বিগত সকল রোজা থেকে অধিক। এ রোজার বিধি-বিধান অন্য সকল বিধান থেকে জটিল। তবে সকল রোজা-ই আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহনযোগ্য। আল্লাহ তায়ালা এর মাধ্যমে বান্দাকে অশেষ প্রতিদান দেন।
হাদিসে কুদসিতে আছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন, প্রতিটি কাজের কাফফারা রয়েছে, আর রোজা আমার জন্য, আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব। রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তায়ালা-এর কাছে মেশকের চেয়েও অধিক সুগন্ধিত। (বুখারি:৭৫৩৮,মুসলিম :১১৫১)
মহিমান্বিত এ মাসে, আল্লাহর প্রিয় ইবাদত রোজা পালন করবো খুব যত্নসহকারে। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে চেষ্টা করবো গুনাহ মাফের এ মাসে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।
বিআলো/শিলি