‘লেবানন এবং সিরিয়ার সংকট বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা’ শীর্ষক সেমিনার
নিজস্ব প্রতিবেদক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, দর্শন বিভাগ ও ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ‘লেবানন এবং সিরিয়ার সংকট বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সেমিনারে মুখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ফিলিস্তিনের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ, প্রফেসর ড. আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসী আল মাকদিসী। মধ্যপ্রাচ্যে গাজা গণহত্যার ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিষয়ের উপর সম্মানিত আলোচক বিস্তারিত আলোচনা করেন।
তিনি বলেন, বায়তুল মাকদিস ফিলিস্তিনিদের একক কোনো ইস্যু নয়। এটি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর এমনকি সমগ্র মানবতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। গাজায় পরিচালিত তুফান আল-আকসা আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ভূ-রাজনীতির পট পরিবর্তন করে দিয়েছে। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক প্রজেক্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা বাফার স্টেট ইসরায়েল তার শেষ বয়সে এসে উপনীত হয়েছে। ৭ অক্টোবের পর থেকে প্রায় ৬ হাজার ইসরায়েলী সৈন্য নিহত হয়েছে যা গত ১০০ বছরের যেকোনো যুদ্ধে তাদের হারানো সৈন্যের চেয়ে বেশি। এই যুদ্ধের ফলে বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতিরও শিকাদ হয়েছে তারা। এভাবে পতন ঘনিয়ে আসছে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের।
বলা যায় যে, আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরের মাঝেই ইসরায়েল নামে কোনো জায়গার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না পৃথিবীর মানচিত্রে। তবে এর পূর্বে আমাদের প্রয়োজন জ্ঞানতাত্ত্বিক বিপর্যয়, চিন্তাগত উপনিবেশ ও বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব থেকে কাটিয়ে ওঠা। বাংলাদেশের মতো।গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো যদি স্বাধীন হয়, নিজেদের স্বতন্ত্র জ্ঞান ও থিওরিটিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক দাঁড় করাতে পারে এবং সেই আলোকে স্ট্রাটেজিক থিংকিং ও প্ল্যানিং করে তবেই সম্ভব ফিলিস্তিনের মুক্তি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. তাসমিয়া পারসোব। অনুষ্ঠানে দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ ‘ফিলিস্তিনে কারারুদ্ধ রাজনীতি: নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার ইঙ্গিত’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, বর্তমান উদারনৈতিক বিশ্ব ব্যবস্থার যে প্রতিশ্রুতি তা দারুণভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে তার প্রত্যক্ষ নমুনা হচ্ছে জায়নবাদী ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনে নির্বিচার নারী শিশু হত্যা, দখল, উচ্ছেদ, আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার, নিয়ম, চুক্তি লঙ্ঘন। তাদের এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমানুষের প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে সেসব দেশের সরকার বিশ্বব্যাপী এ প্রতিবাদকে বিবেচনায় নিচ্ছে না এর মধ্য দিয়ে রাজনীতি ফিলিস্তিনি ইস্যুতে কারারুদ্ধ হয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি।
একই সাথে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার ভিত্তি ন্যায্যতা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সহিষ্ণুতা উপেক্ষা করার মধ্য দিয়ে এ বিশ্ব ব্যবস্থা তার যৌক্তিকতা হারিয়ে ফেলেছে। এর মধ্য দিয়ে একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার আবির্ভাবের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব রাশেদুল ইসলাম রাসেল ও একই বিভাগের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ ইরফান সাদিক তাদের গবেষণা প্রবন্ধে লেভান্ট (প্যালেস্টাইন, সিরিয়া ও লেবানন) অঞ্চলে ইসরায়েলের আধিপত্যবাদী ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের ওপর আলোকপাত করেন এবং তারা বলেন, লভিয়াথান (স্) ইন প্যালেস্টাইন, সিরিয়া এন্ড লেবানন: বিব্লিকাল ক্যাওস অর হবেসিয়ান অর্ডার’ নামক এই প্রবন্ধে তারা ইসরায়েলকে বাইবেলে বর্ণিত লেভিয়াথান দানব ও দার্শনিক টমাস হব্স-এর সার্বভৌম শক্তির লেভিয়াথানের মধ্যে তুলনামূলক আলোচোনার আলোকে দেখানোর চেষ্টা করেন।
তারা মনে করেন, লেভান্ট অঞ্চলের অরাজকতা এখনই থামছে না। প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারের চক্করে মধ্যপ্রাচ্যের এই অংশটি আরো অনেকদিন অরাজকতা শিকার হতেই থাকবে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম রাব্বানী।
তিনি বলেন, আজকের এই প্রোগ্রামটি খুব সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এর গুরুত্বপূর্ণ দুইটা দিক যার প্রথমটা হলো একজন ব্যাটেলিয়ান রিয়েল প্যালেস্তিনিয়ান এসেছেন যিনি একজন থিওরিস্ট এবং প্যালেস্টিনিয়ারদের জন্য মুক্তির লড়াই করছেন তাকে আমাদের মাঝে পাওয়া এবং তিনি অত্যন্ত ইনসাইডফুল বক্তব্য দিয়েছেন। আরেকটি দিক হলো পুরো প্রোগ্রামটির আয়োজনে শিক্ষার্থীরা যে অংশগ্রহণ এটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পুরো প্রোগ্রামের মূল শক্তিটা ছিল শিক্ষার্থীরা। কারণ তারা এরকম একটা আন্তর্জাতিক মানের স্কলার নিয়ে আসে একটা সেমিনার করেছে। যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন হচ্ছে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ হচ্ছে। কারণ আমাদের মূল কাজ হচ্ছে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করা। যার জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের বুদ্ধি বৃত্তিক কাজের দিকে অংশগ্রহণ করাতে হবে যেখানে প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ নিজেও বুদ্ধিভিত্তিক লড়াইয়ের কথা বলেছেন এবং সেই কাজটি আমরা শুরু করতে চাচ্ছি।
আমি আশা করছি এটা অনেক দূর যাবে এবং এ ধরনের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সত্যিকারের যে চেহারা সেটি প্রকাশিত হবে। গাজাবাসীর প্রতি সম্মান জানিয়ে কবিতা আবৃত্তি করেছেন কবি ইকবাল খোরশেদ, কবি মাহমুদা আক্তার, কবি তালুকদার লাভলী ও অধ্যাপক আহমেদ রেজা। এছাড়া আরোও বক্তব্য রাখেন ইসলামি চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সম্মানিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান আল ফিরদাউস।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক আনজুমান আরা শিল্পী। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে একটি প্রাণবন্ত সেমিনার সফলভাবে সম্পন্ন হয়।