শনিরআখড়ায় দনিয়া কলেজছাত্র মিনহাজকে কুপিয়ে হত্যা, নেপথ্যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা
ইবনে ফরহাদ তুরাগ: সম্প্রতি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শনিরআখড়ায় দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে মিনহাজুল ইসলাম (২৫) নামে এক প্রকৌশলী যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে পাটেরবাগ এলাকায় বসবাসকারী কিং মাহফুজসহ গ্রুপের সদস্যরা।
গত ২৮ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে দনিয়া কলেজের সামনে ঘটনাটি ঘটে। রক্তাক্ত অবস্থায় স্থানীয় এলাকার ছোট ভাই ও বন্ধুরা মিনহাজকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক রাত পৌনে ৮টার দিকে মিনহাজকে মৃত ঘোষণা করেন।
জানা যায়, নিহত মিনহাজ ছিলেন দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি পলিটেকনিক থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করছিলেন। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। মিনহাজের বাবা রফিকুল ইসলাম ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ওলামা দলের সাধারণ সম্পাদক। কদমতলি থানাধীন সাদ্দাম মার্কেট তুষারধারা এলাকায় বসবাস করেন। মিনহাজ এক বছর পূর্বে বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে মাতুয়াইলে বাসা ভাড়া করে থাকতেন।
মিনহাজের মৃত্যুর শেষ সময়ে পাশে ছিলেন তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। ওই সময়ের বর্ণনা দিয়ে তার স্ত্রী মাইজা আহলিন নিজের ফেসবুক ওয়ালে একটি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি লিখেন:
“আমার অনাগত সন্তানকে কেন বাবা ছাড়া করলেন ভাই? কেন করলেন আমাকে বিধবা। কোনো কিছুর বিনিময়ে আর পাবো? এই খুনির বিচার চাই। আপনাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি”। স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে এমন স্ট্যাটাস দেন খুন হওয়া প্রকৌশলী মিনহাজের স্ত্রী মাইজা। ফেসবুক পোস্টে তিনি আরো লিখেন, “শেষ দেখা… কি ছটফটই না করলো আমার মিনহাজে। কমেন্টে তিনি লিখেন, ওরা আমার বাচ্চাটাকে এতিম করে দিলো, সেই সাথে আমাকেও”।
নিহত মিনহাজের বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, নুরপুর এলাকার মাহফুজ, শাওন, সাইফুল, সোহান, সৌরভ নামে কয়েক যুবক মিনহাজের সঙ্গে দনিয়া কলেজে পড়াশোনা করতেন। তাদের মধ্যে সাইফুল ও সোহান ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। মিনহাজ ছাত্রদলের সমর্থক ছিলেন। এ নিয়ে তিনজনের মধ্যে বিবাদ ছিল। ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে মিনহাজ সক্রিয় ছিলেন। তিনি বলেন, ২৬ জানুয়ারি রবিবার তানজিলকে গলায় অস্ত্র ঠেকিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেন মাহফুজসহ কয়েকজন। ২৮ জানুয়ারি মঙ্গলবার দনিয়া কলেজের সামনে মিনহাজকে একা পেয়ে তারাই কুপিয়ে হত্যা করে। মিনহাজ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে জানান তার ভগ্নীপতি খালিদ মাহফুজ। তিনি বলেন, কেন তাকে এভাবে হত্যা করা হলো। আমরা এ ঘটনার ন্যায়বিচার চাই।
মিনহাজ হত্যার ব্যাপারে নিহতের বন্ধু শামীম জানান, মিনহাজ দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। দুইদিন আগে ‘কিং মাহফুজ তানজিল’ নামে একজনকে মারপিট করেছিলেন তিনি। হত্যাকাণ্ডের দিন এ বিষয় নিয়ে সবাই মিলে বসে মীমাংসার কথা ছিল। ওই সময় কিং মাহফুজ, শাহ আলম, শাওন, সাইফুলসহ বেশ কয়েকজন মিনহাজকে কুপিয়ে জখম করে হত্যা করে।
দনিয়া কলেজ ছাত্র মিনহাজকে হত্যার নেপথ্যে কারা?
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে বেশ কিছু রহস্য! এবার মিনহাজের বন্ধুমহল থেকে আরো জানা যায়, কিছুদিন ধরে দনিয়া কলেজের সামনে থেকে চাঁদা আদায় করতে উঠেপড়ে লাগে স্থানীয় বিএনপিপন্থি দুই গ্রুপ। এতে বিএনপি নেতার নির্দেশে এক সময় ছাত্রলীগ ট্যাগধারী, বর্তমান ৬১নং ওয়ার্ড ছাত্রদল পরিচয়দানকারী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যাত্রাবাড়ী থানার এক সমন্বয়কের শেল্টারে ছাত্রদের বিভিন্ন সভা সমাবেশে চলাফেরা করা এই সন্ত্রাসী কিং মাহফুজসহ ওর সকল বন্ধুরা দনিয়া কলেজের সামনে থাকা ফুটকোট থেকে চাঁদাবাজি শুরু করে।
মিনহাজ হত্যার আগে “আমরা কাকে চাঁদা দিবো?” লিখে শনিরআখড়া গ্রুপে পোষ্ট:
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক’এর একটি গ্রুপে লেখা হয় ‘আমরা কাকে চাঁদা দিবো? এ ঘটনায় কিং মাহফুজ গ্রুপদেরকে বড়ভাই হিসেবে একাধিকবার সাবধান করেন দনিয়া কলেজ অনার্স ৪র্থ বর্ষের ছাত্র মিনহাজ। মিনহাজের বন্ধুরা জানায়, দনিয়া কলেজের সামনে মারামারি ও চাঁদাবাজী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে মিনহাজ বাধা দেওয়ায় পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়।
কিং মাহফুজের রাজনৈতিক পরিচয় কোন দলের? আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বৈষম্যবিরোধী? কি ভাবছে জনসাধারণ?
শনিরআখড়ায় বসবাসকারী সুদর্শন নামে একজন কিং মাহফুজের রাজনৈতিক আস্রয় ব্যাখ্যা করে বলেন, যারা ছাত্রলীগ ত্যাগ করে বৈষম্যবিরোধী ব্যনারে চলে গেছে তাদের কি এখনো ছাত্রলীগ নেতা বলা হবে নাকি সমন্বয়ক কিংবা সহ-সমন্বয়ক বলা হয়? গত ২৮ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬ টায় দনিয়া কলেজের সামনে মিনহাজ নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত ব্যক্তি বিএনপি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন ও হত্যাকারী পূর্বে ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। জুলাই আন্দোলন থেকে শুরু করে তিনি কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের সান্নিধ্যে ছিলেন। যার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। হত্যাকারী তো অবশ্যই অপরাধী এটা নিয়ে তর্কের কোনো সুযোগ নেই। ছাত্রলীগের মধ্যে এরকম খুনীরা আশ্রয় নিয়েছিল পরবর্তীতে তারা তাদের পদ বাতিল করে নিজ নিজ সংগঠনে যোগদান করেছেন। তাই খুনির বর্তমান রাজনৈতিক পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রলীগ হতে যদি সমন্বয়ক হতে পারে তাহলে সে হইতে পারে না কেন। ছাত্রলীগ থেকে যদি শিবির হইতে পারে তাহলে সে হইতে পারে না কেন?
এমন বক্তব্যের সুত্র ধরে খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, এ অভিযোগের সত্যতা দাবী করে দনিয়া একে হাই স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী, মিনহাজের বন্ধু আরশাদুল ইসলাম নিবির বলেন, কিং মাহফুজের ব্যাপারে একটি বিষয় হাইলাইট করতে চাই। কিং মাহফুজ ২৮ জানুয়ারি মিনহাজকে হত্যার আগে ১৩ তারিখ সন্ধ্যা ৬টায় তাকে ডিবি পুলিশ যাত্রাবাড়ী থানায় নিয়ে যায়, কারণ তার সঙ্গে কিছু ধারালো অস্ত্র পাওয়া যায় (সুইসগিয়ার)। সেই সময় যাত্রাবাড়ীতে সমন্বয়ক দাবি করা আশিকুজ্জামান হৃদয় যাত্রাবাড়ী থানার তদন্ত ওসি মহসিনের সাহায্যে ডিবি পুলিশের কাছ থেকে কিং মাহফুজকে ছাড়িয়ে আনে।
তিনি বলেন, আন্দোলনের পরে ৫ তারিখ থেকে আশিকুজ্জামান হৃদয় তিনটি থানার আন্ডারে যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ডেমরা এলাকায় ভুয়া সমন্বয়ক দাবি করে নানা ধরনের কুকর্ম করত। আশিকুজ্জামান হৃদয়ের সঙ্গে কিং মাহফুজের একটি ভালো সম্পর্ক ছিল। কিং মাহফুজ আশিকুজ্জামান হৃদয়ের বাসায় যাওয়া আসা করতো এবং দাওয়াত করে খাওয়াতো। কিং মাহফুজ মূলত শনিআখরায় একটি কিশোর গ্যাং-এর লিডার ছিল। যেদিন মিনহাজ হত্যা হয় ঐদিন আমরা মামলা করতে গেলে এই আশিকের রিকোয়েস্টে মামলা নিতে চাচ্ছিল না যাত্রাবাড়ী থানা। পরে আমাদের জোর-জবরদস্তিতে রাত ৩টার পর মামলা নেয় পুলিশ।
দনিয়া একে হাই স্কুলের আরেক সাবেক শিক্ষার্থী জাফিয়ান হৃদয় একই অভিযোগ করে বলেন, মিনহাজ হত্যার আগেও কিং মাহফুজ-আশিকুজ্জামান হৃদয়ের আশ্রয়ে ছিল। হত্যার পরও হৃদয় মামলা না নিতে পুলিশকে প্রভাবিত করে। রাত ৩টার পর সব ছাত্রদের জোড়াজুরিতে মামলা নেওয়া হয়।
যাত্রাবাড়ীর সমন্বয়ক আশিকুজ্জামান হৃদয়ের সাথে নিহত মিনহাজের বাকবিতন্ডা, থামিয়ে দেন সারজিস আলম:
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ১০৫ শেয়ার করা একটি ভিডিওর ক্যাপশনে মিনহাজের বন্ধু আরশাদুল ইসলাম নিবির আরও বলেন, ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে একটি আলোচনা সভায় “নিহত মিনহাজ ও যাত্রাবাড়ির সমন্বয়ক আশিকুজ্জামান হৃদয়ের সাথে কিছু বাকবিতন্ডা হয়। এর কারণ মিনহাজ এর কাছে আশিকুজ্জামানের কিছু অকারেন্স এর প্রমান ছিলো। যা তিনি তখন সারজিস আলমকে উল্লেখ করতে চেয়েছেন”। সেই ভিডিওতে সারজিস আলমকেও কথা বলতে দেখা যায়। সেখানে সমন্বয়ক আশিকের বিরুদ্ধে আনিত একটি অভিযোগ উপস্থাপন করে থেমে যেতে দেখা যায় মিনহাজকে।
আসামিদের ধরতে পুলিশকে ৭২ ঘন্টার আল্টিমেটাম শিক্ষার্থীদের:
মিনহাজ হত্যার পর থেকে ঘটনার সূত্রপাত খুজতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য, ভিডিও ফুটেজ ও খুনিদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা দেখে অস্থিরতা কাজ করে জনমনে। ফুটপাট থেকে চাঁদা আদায়ে বাধা দেওয়ায় সৃষ্ট এই হত্যাকান্ডে উত্তাল হয়ে উঠে যাত্রাবাড়ী, শনিআখড়া সহ পুরো রাজধানী। প্রতিবাদে দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও আশেপাশের স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা নেমে পড়ে রাস্তায়। এতে নড়েচড়ে বসেন ওয়ারী বিভাগের পুলিশ প্রশাসনসহ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এই হত্যাকান্ডে নিহত মিনহাজের বড় ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন বাদী হয়ে ‘কিং মাহফুজ’সহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনকে আসামি করে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকান্ডে জড়িত আসামিদের বিচারের দাবিতে দনিয়া কলেজসহ আশেপাশের সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে মানববন্ধন কর্মসূচি করে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি শান্ত করতে পুলিশ এলে মিনহাজের খুনিদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে প্রশাসনকে ৭২ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা। একইদিনে মিনহাজ হত্যার মূল হোতা কিং মাহফুজ সহ বাকি গ্যাংদের ধরিয়ে দিতে পারলে নগদ ২ লক্ষ টাকার পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা আসে মিনহাজের বন্ধু মহল থেকে।
এদিকে বিভিন্ন সূত্র ধরে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারী বিভাগ হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু করে। অবশেষে ৭২ ঘণ্টার পূর্বেই (৩১ জানুয়ারি) পটুয়াখালী সদর থানা এলাকা থেকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত এজাহারভুক্ত ১ নম্বর আসামি কিং মাহফুজ গ্রুপের প্রধান কিং মাহফুজ, ২ নম্বর আসামি মো. জাহিদুল ইসলাম ভুইয়া শাওনসহ মোট ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি-ওয়ারী বিভাগ। অন্যদিকে এই মামলায় সংশ্লিষ্ট আরো ২ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো: ১। কিং মাহফুজ ওরফে মো. মাহফুজ সরকার (২২), ২। মো. জাহিদুল ভুঁইয়া শাওন (২৭) ৩। মো. সাব্বির সরকার (১৮) ৪। মো. আশিক (২২) ও ৫। মো. সোহান মিয়া (১৯)। এবং যাত্রাবাড়ী থানায় গ্রেপ্তারকৃতরা হলো: ৬। শাহ আলম (২১) ৭। কাউসার মিয়া (২৩)।
আসামিদের গ্রেফতারের পর ডিবি-ওয়ারী বিভাগের প্রেস ব্রিফিং:
৩১ জানুয়ারি আসামিদের গ্রেফতারের পর ১ ফেব্রুয়ারী মিনহাজ হত্যার বিষয়ে প্রেস ব্রিফিং-এ ডিবি পুলিশ জানায়, নিহত মিনহাজুল যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া এলাকায় অবস্থিত দনিয়া কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। গত (২৬ জানুয়ারি) দনিয়া কলেজে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মিনহাজুলের সাথে মাহফুজ ওরফে কিং মাহফুজসহ অন্য আসামিদের তর্কবিতর্ক হয়। পরে (২৮ জানুয়ারি) বিকেলে মিনহাজ ও তার বন্ধু আহাদ দনিয়া কলেজের সামনে গেলে সেখানে কিং মাহফুজসহ অন্য আসামিরা পরিকল্পিতভাবে সুইচ গিয়ার, চাকু, চাপাতি, রামদা সহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মিনহাজুলকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। গুরুতর আহত মিনহাজুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কতর্ব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। এ ঘটনায় নিহত মিনহাজুলের বড় ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন বাদী হয়ে ‘কিং মাহফুজ’সহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনকে আসামি করে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলাটি তদন্তকালে গোয়েন্দা তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনায় জড়িতদের অবস্থান শনাক্ত করা হয়। অতঃপর ৩১ জানুয়ারি পটুয়াখালী সদর থানা এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে পটুয়াখালী জেলা পুলিশের সহযোগিতায় মিনহাজ হত্যা মামলায় জড়িত কিং মাহফুজ গ্রুপের প্রধান এবং এজাহারভুক্ত ১নং আসামি কিং মাহফুজ, ২নং আসামি মোঃ জাহিদুল ভুঁইয়া শাওনসহ মোঃ সাব্বির সরকার, মোঃ আশিক ও সোহান মিয়াকে গ্রেফতার করে ডিবি ওয়ারী জোনাল টিম। ডিএমপির ডিবি-ওয়ারী বিভাগ আরও জানায়, গ্রেফতারকৃরা ভিকটিম মিনহাজকে পূর্ব শক্রতার জের ধরে হত্যা করেছে মর্মে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। গ্রেফতারকৃত আসামীদের কোর্টে প্রেরন করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত পলাতক অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
খুনিদের ফাঁসির দাবিতে চলমান মানববন্ধন কর্মসূচি:
এদিকে মিনহাজ হত্যার ঘটনায় জড়িতদের ফাঁসির দাবিতে চলমান আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী সহ মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনগুলো। বুধবার মিনহাজের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্চারামপুরে “প্রকৌশলী মিনহাজকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করায় খুনিদের গ্রেপ্তার করে ফাঁসি নিশ্চিত করার দাবি”তে মানববন্ধন কর্মসূচি করে শিক্ষার্থীরা।
কোর্ট প্রাঙ্গনে ৭ আসামিকে জুতাপেটা ও ফাঁসির দাবি শিক্ষার্থীদের:
বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারী) বিকেল ৩টার পর মিনহাজ হত্যার আসামিদের কোর্টে উঠানো আগে সিএমএম কোর্টের সামনে জড়ো হতে থাকে মিনহাজের আত্নীয়-স্বজন ও সহপাঠীরা। সকাল হতে হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে স্লোগান ও মানবন্ধন কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। বিকেলে কোর্টে প্রবেশের পথে পুলিশের প্রটোকলের ভেতর ঢুকে আসামি কিং মাহফুজসহ ৭ আসামিকে জুতাপেটা করে, কিল-ঘুষি মারে ও জুতা নিক্ষেপ করে নিহত শিক্ষার্থীর সহপাঠীরা। এ সময় মিনহাজের বাবা, মা, স্ত্রী ও ভাই উপস্থিত ছিলেন। তারা হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবি জানান। এদিন ছিলো সাত আসামির রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য।
ফাঁসি দেয়ার আগ পর্যন্ত এ লড়াই চলছে চলবে: জবাব শিক্ষার্থীদের:
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আদালত সূত্র থেকে জানা যায়, মিনহাজ হত্যা মামলায় ১নং আসামি কিং মাহফুজের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। বাকি সবার ৩দিন এর রিমান্ড মঞ্জুর। এ ছাড়া গ্রেপ্তারকৃত অপর আসামি সোহান মিয়া (১৯) বয়সে শিশু হওয়ায় তাকে শিশু আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। এ শিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের কিছুটা সন্তুষ্টি দেখা মিললেও তারা জানায়, আমাদের সকল ভাইদের উপর আত্মবিশ্বাসটা বেড়ে গেলো। আমরা সবাই একত্রে প্রথম ধাপ সম্পন্ন করলাম। কিন্তু এ লড়াই চলছে, চলবে। ফাঁসি দেয়ার আগ পর্যন্ত এ লড়াই চলছে, চলবে।
যা জানালেন নিহত মিনহাজের স্ত্রী মাইজা আহলিন:
মিনহাজ হত্যাকান্ড নিয়ে দৈনিক বাংলাদেশের আলোর সাথে আলাপকালে, মিনহাজের স্ত্রী মাইজা আহলিন বলেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই এখানে (মিনহাজ হত্যাকান্ডে) অনেক বড় কারও হাত আছে, যাদের হয়তো পথের কাটা ছিলো মিনহাজ। কারন আমরা সবাই জানি, ছোট থেকে বড়- সমাজের প্রভাবশালীরা সবসময়ই সাধারণ মানুষের টাকা আত্নসাৎ করে চলে। মিনহাজ হয়তো প্রতিবাদ জানাইতো, এজন্য বলির স্বীকার হলো।
কিং মাহফুজের পরিচয় ও রাজনৈতিক আস্রয় জানতে চাইলে মাইজা বলেন, “ওর (কিং মাহফুজের) কোনো নির্দিষ্ট কেউ নাই। যখন যার সাথে পারে সুবিধা নিতো”। যাত্রাবাড়ীর সমন্বয়ক আশিকুজ্জামান হৃদয়ের সাথে মিনহাজের পূর্ব শত্রুতা ছিল বলেও জানান তিনি।
মিনহাজের জানাযা নামাজে শতশত মানুষের অংশগ্রহন করা দুটি ছবি পোষ্ট করে মাইজা বলেন, আপনাদের নিয়ে আমার কিছু কথা আছে… এই যে এতশত লোক যারা বা যে মিনহাজকে ভালোবাসেন বা বাসতেন, এত লোকের মাঝে সেদিন যদি ১০ জন এগিয়ে আসতেন তাহলে আজকে আমি স্বামী ছাড়া হতাম না যে আসছে সে বাবা ছাড়া হতো না আর মা (শ্বাশুরী) উনি ও সন্তান ছাড়া হতো না একটা মানুষের জীবন বেঁচে যেতো!
মিনহাজ কি আমাদের জন্য?
মিনহাজের সাথে আমার সব মিলিয়ে গত ৪ বছরের সম্পর্ক ছিল যেটা শুধুমাত্র আমাদের দুজনের জিদের কারণে বিয়ে অবধি পূর্ণতা পায়! আর মিনহাজের পরিবারের সবচেয়ে আদরের সবার চোখের মণি ছিলো যাকে চোখে আরায় সবাই আপনারা এত ভালোবাসেন তাহলে আমাদের ভালোবাসা পরিমাপ করবেন কি দিয়ে!
আর কি করেছে আপনাদের জন্য!?
ভাইরে এমন অনেক সময় আসছে আমাদের ঘুরতে যাওয়ার কথা বের হওয়ার আগ মুহূর্তে ফোন আসছে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আজ পর্যন্ত কেউ কি অভিযোগ করতে পারবেন যে কোনও বিপদে পাশে পান নাই!
আজকেও ব্যাতিক্রম কিছুই হয়নি ছাত্রদের হয়ে তাদের প্রাধান্য দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সমস্যার কথা ভেবে চাঁদাবাজি করাতে বাধা দেওয়াতে তার তাজা প্রাণটা এই নৃশংস ভাবে গেলো মাঝে ভুক্তভোগী আমি আমার পরিবার মিনহাজের পরিবারের সবাই মিনহাজের শেষ অস্তিত্ব সেও এই ক্ষতিপূরণ কিভাবে কাটিয়ে উঠবো! একটা নিষ্পাপ প্রাণ হারাইলো যেটার ভুক্তভোগী আমরা সবাই আর খুনীরা ঘুরে বেড়াবে নাকি!? দু-চার বছর হয়রানি হবে নাকি!? এই হচ্ছে বিচার ব্যবস্থা! এইটাই সংস্কার?
বিআলো/নিউজ