সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে সমৃদ্ধ কেয়ার ইকোনমির কৌশলগত রূপরেখা গড়ে তোলা সম্ভবঃ দীপু মনি
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ আয়াত এডুকেশনের আয়োজনে ১লা এপ্রিল, বিকাল ৩টায় রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে ‘বাংলাদেশে কেয়ার ইকোনমির জন্য একটি কৌশলগত রোডম্যাপ তৈরি’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত সরকারি, বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের প্রতিনিধিবৃন্দ কেয়ার ইকোনমি খাতে নারীদের ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করার কৌশলগুলো এবং সম্ভাব্য উন্নয়নের পথ খুঁজে বের করার উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন।
গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালক ও আয়াত এডুকেশনের সিইও নুসরাত আমান বলেন, ‘কেয়ার ইকোনমি, যা মূলত একজন মানুষের সুস্থ্যতা ও সার্বিক পরিচর্যার জন্য অপর একজন বেতনভূক্ত বা অবৈতনিক মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরাই এ ধরণের পরিচর্যা কাজের বোঝা বেশি বহন করে। আমাদের লক্ষ্য এই গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে এই খাতের বিশাল সম্ভাবনা, বিরাজমান সমস্যা এবং কেয়ার গিভিং পেশায় অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে শুধুমাত্র নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি তুলে ধরা।’
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের জেন্ডার ও সোশ্যাল ইনক্লুশন স্পেশালিষ্ট নাসিবা সেলিম তার প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলেন, ‘আমাদের কে কেয়ার ইকোনমির পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের মানুষের আচরণগত পরিবর্তন, জেন্ডার বৈষম্যের পাশাপাশি নারীর পেশার প্রতি গতানুগতিক ধারণা ও সংখ্যাল্প গোষ্ঠীর মানুষদেরকে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।’
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘এই কাজের সাথে যারা সম্পৃক্ত আছেন, তাদের কাজের অবশ্যই অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কাজকে অর্থনৈতিক মানদন্ডে মূল্যায়ন করা হয় না, যার ফলে এই খাতে আমরা নারীর অবদানকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি না। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একনেকের সভায় এই কাজকে জিডিপিতে অন্তর্ভূক্ত করার কথা বলেছেন।’
একশন এইড এর নির্বাহী পরিচালক ফারাহ্ কবির বলেন, ‘আমরা অনেক ক্ষেত্রে নারীর অবৈতনিক কাজকে স্বীকৃতি জানাই না, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও মর্যাদার কথা ভাবি না। ফলে এটি একদিকে যেমন নারীর জন্য পেশাগত স্বীকৃতিকে বাধাগ্রস্থ করছে, তেমনি এটি জিডিপিতে নারীর অংশগ্রহণকে অবমূল্যায়ন করছে।’
বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি আয়াত এডুকেশনের এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, ‘দিন দিন প্রবীণ ও অসুস্থ্য মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে এই খাতে সরকারি-বেসরকারি টেকসই বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও সহায়ক কৌশলগত পরিকল্পনা এবং পলিসি প্রয়োজন। সেই সাথে কেয়ার গিভারদেরকে মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন ও দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা প্রয়োজন।’
গোল টেবিল বৈঠকে আরও অংশ গ্রহণ করেছেন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাই কমিশন, কেয়ার বাংলাদেশ, এশিয়া ফাউন্ডেশন, পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল, আইএলও, ইউএন উইমেন, ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশন, সুইস কন্টাক্ট, এমপাওয়ার সোশ্যাল, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি, বিএনকেএস, আয়াত এডুকেশন, আয়াত কেয়ারের প্রতিনিধিবৃন্দ। যারা কেয়ার ইকোনমিতে বিনিয়োগ এবং নীতি সংস্কারের জন্য কার্যকর কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছেন।
গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় কেয়ার ইকোনমি নিয়ে দেশের প্রেক্ষাপট হিসেবে বলা হয়েছে যে, ২০২২ সালে জনসংখ্যা ও আবাসন শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে ৬০ বা তদুর্ধ্ব বয়সী মানুষের সংখ্যা ১৫.৩ মিলিয়নের বেশি, যা মোট জনসংখ্যার ৯.২৮ শতাংশ।
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেন, ‘কেয়ার গিভিং পেশাকে আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করার মাধ্যমে সমাজ ও পরিবারের অসুস্থ্য সদস্যদের জন্য বাড়তি কাজের দায়িত্বকে সুষ্ঠুভাবে বন্টন করা সম্ভব। তবে এখনো এই খাতে দীর্ঘদিন ধরেই নারীরাই যুক্ত আছেন। এইক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের সুযোগ রয়েছে। যেটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেটি হচ্ছে এই পেশায় কর্মরত মানুষের মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ ও পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ। কেয়ার গিভিং সেবা বিশ্বের সবজায়গাতেই অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করতে হয়, কিন্তু তবুও এই খাতের বিকাশে সরকারের সমর্থন ও আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। সেই সাথে দেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ নানা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদেরও কিভাবে এই খাতে সম্পৃক্ত করা যায়, সেটির প্রতি বক্তারা গুরুত্বারোপ করেন।
গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথি সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ডা. দীপু মনি, এমপি বলেন, ‘আজকের গোলটেবিল বৈঠকের বিষয়টি আমাদের মন্ত্রণালয়ের কাজের একটি অংশ। সেইসাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কেয়ার সার্ভিস প্রোভাইডারদের নিজেদের জন্য একটি সন্তোষজনক কর্মপরিবেশ তৈরি করা। আমাদের দেশে যে চিত্রটি দেখা যায়, সেটি হলো যেখানে অর্থ প্রাপ্তির সুযোগ আছে সেখানে পুরুষের অংশগ্রহণ, আর যেখানে অর্থ প্রাপ্তির সুযোগ নেই সেখানে নারীরা জড়িত। অতএব, নারীর অগ্রযাত্রাকে গতিশীল রাখতে নারীর কাজকে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা গৃহস্থালি কাজে নারীর শ্রমের অবদানকে স্বীকৃতি দেই না। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনাটা খুব জরুরি। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও কেয়ার গিভার পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। আগামী দিনে এটি একটি কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে তৈরি হবে, তাই এই খাতকে সমৃদ্ধ করার এখনই সঠিক সময়। পাশাপাশি কেয়ার ইকোনমিটাকে আরও এগিয়ে নিতে বেসরকারি পর্যায় থেকেও এগিয়ে আসতে হবে। সবাই মিলে চেষ্টা করলে এই কেয়ার ইকোনমিটাকে আরও সুবিন্যস্তভাবে গড়ে তোলা সম্ভব, পাশাপাশি এই খাতে যারা কর্মরত আছেন, তাদের সার্বিক সুস্থ্যতার জন্যও সবাইকে ভাবতে হবে। এখন আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। এটা আমরা সবাই স্বীকার করি যে, আমাদের একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে আমরা নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। আমি মনে করি এই গোলটেবিল বৈঠক এ বিষয়গুলো আলোচনা করার জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এবং সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ কেয়ার ইকোনমির কৌশলগত রূপরেখা গড়ে তোলা সম্ভব।
গোলটেবিল বেঠকে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। গোলটেবিল বৈঠকে একটি সমৃদ্ধ কেয়ার ইকোনমির জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে বেশ কিছু সুপারিশমালা তুলে ধরা হয়, তন্মধ্যে-পরিচর্যা বিষয়ে অবকাঠামো তৈরি ও প্রয়োজনীয় বিনিযোগ বৃদ্ধি, পরিচর্যার কাজকে উৎসাহিত করার জন্য নীতি সংস্কার, পরিচর্যা কাজে জেন্ডার সমতা আনার লক্ষ্যে সচেতনতামূলক প্রচার ও শিক্ষামূলক উদ্যোগ গ্রহণ, পেশাদারিত্ব বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিকে আরও উন্নত করার বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়।
উল্লেখ্য যে, আয়াত এডুকেশনের সহযোগী সংগঠন আয়াত কেয়ার দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি পর্যায়ে ঢাকাসহ সারাদেশে কেয়ার গিভিং সার্ভিস প্রদান করছে।
বিআলো/তুরাগ