সরকারের কাছে ১১ দফা দাবি জানাল দুর্নীতি বিরোধী জাতীয় সমন্বয় কমিটি
নিজস্ব প্রতিবেদক:অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ১১ দফা দাবি জানিয়েছে দুর্নীতি বিরোধী জাতীয় সমন্বয় কমিটি। আজ রবিবার দুপুর দেড়টায় দুনীর্তি বিরোধী জাতীয় সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে শাহাবাগ মোড় থেকে রাজু ভাস্কর্য পর্যন্ত দুনীর্তি বিরোধী মিছিল শেষে জাতীয় জাদুঘরের সামনে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে এই দাবি জানায় কমিটি।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন দুনীর্তি বিরোধী জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক মজলুম জননেতা সারোয়ার ওয়াদুদ চৌধুরী। বক্তব্য দেন জাতীয় ব্যক্তিত্ব কাইয়ুম রাজা চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, আ.ব. ম. মোস্তাফা আমীন, আবুল কালাম আজাদ ও সেতারা রেজভী লাকীসহ আরও অনেকে।
সমাবেশে সংগঠনের পক্ষে সারোয়ার ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, ‘ গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিত্বকারী সৎ ও দেশপ্রেমিক উপদেষ্টারা দায়িত্ব—ভার গ্রহণ করায় মহান স্বাধীনতার পূর্ণতা পেল। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে ১১ দফা দাবি জানাই।’
সমাবেশে ওঠা ১১ দফাগুলো হলো
১. রাষ্ট্রের সকল সেক্টরে দূনীতিমুক্ত করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বর্তমান অন্তবতীর্কালীন সরকারকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের মাধ্যমে যারা আইন অমান্য করেছে, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। রাজনীতিবীদ, ব্যবসায়ী, প্রশাসনসহ বিভিন্ন পেশা দলদাস সুবিধাভোগী, লুটেরা, পাচারকারী, জাতীয় বেঈমানদের দেশত্যাগ বন্ধ করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুনীর্তি ও পাচার করা টাকা (যে টাকা দিয়ে বাংলাদেশের ৫ বছরের বাজেট করা সম্ভব) উদ্ধার করতে না পারলে স্বাধীনতার সুফল জাতি আর কোনোদিন পাবে না। লুটেরাদের সঙ্গে আপোষ, দেশত্যাগের সুযোগ জাতি কোনোদিন মেনে নিবে না।
২. আইন বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক ও দলীয় শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে উচ্চআদালত ও নিম্ন আদালতে শৃঙ্খলা ফিরে আনতে হবে। সকল আদালতে দলদাস অসৎ ব্যক্তিদের সরিয়ে সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ বিচারক নিয়োগ দিতে হবে।
৩. দেশে ব্যাংকিং খাত ধ্বংসের মুখে পড়ে আছে। একই পরিবার বা একই ব্যক্তির কাছে ব্যাংক কুক্ষিগত হওয়ার সব সুযোগ বন্ধ করতে হবে। এক ব্যক্তি, এক পরিবারকেন্দ্রিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা ও বাংলাদেশের নানা দুনীর্তি, অনিয়ম ও অপেশাদার ব্যক্তিদের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দ্রুত একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করে ব্যাংকিং সেক্টরে সংস্কার করতে হবে। এই কমিশন অবশ্যই দুনীর্তি, অর্থ পাচারসহ সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে একটি শেতপত্র প্রকাশ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। দুনীর্তির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সরিয়ে সৎ, যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে এগিয়ে নিতে হবে। ঘুষ, দুনীর্তি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গিয়েছে। ব্যাংক শূণ্য। পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে হবে। দুনীর্তির মাধ্যমে অর্থ লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। অর্থপাচার বন্ধ করতে পারলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাড়াবে। নিয়ম বহিভূর্তভাবে ঋণ নেওয়া বন্ধ করতে পারলে ব্যাংকি খাতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা পাবে।
৪. দুনীর্তি দমন কমিশনকে নতুন করে সাজাতে হবে। দুনীর্তিবাজ আজ্ঞাবহ অসৎ দলদাস ব্যক্তিদের কমিশন থেকে বের করে দিতে হবে। নতুন, সৎ ও যোগ্য নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের নিয়ে দুনীর্তি দমন কমিশনকে নতুন করে সাজাতে হবে। রাষ্ট্রে দুনীর্তিবাজদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। এই সরকারের প্রধান ও অন্যতম কাজ হচ্ছে স্বাধীনতার পর বিগত সরকারের আমলে গঠিত সকল অনিয়ম ও দুনীর্তির যথাযথভাবে বিচার করা। যাতে দেশ ভবিষ্যতে দুনীর্তিমুক্ত হওয়ার সকল অন্তরায় দূর হয়।
৫. দেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে নিরপেক্ষ, সৎ মানুষের মাধ্যমে না ভারতের আদলে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করা। সরকারি দলের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী করতে হবে। সঠিক ভোটার তালিকা প্রনয়ন প্রধান কাজ। ভুয়া ভোটারদেরকে বাদ দিয়ে সত্যিকার ভোটার তালিকা প্রনয়ন নির্বাচন কমিশনের প্রথম অন্যতম কাজ এবং পরবতীর্ সকল নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও নিয়ম মাফিক করার শক্তি অর্জন করা নির্বাচন কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব।
৬. দেশের শিক্ষাব্যবস্থা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। দলদাস ব্যক্তিদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সকল স্তরে আজ দুনীর্তি ও অনিয়মে ভরপুর। দলদাস ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে সৎ সজ্জন যোগ্য, নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে। দ্রুত কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তথা উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সংস্কার করতে হবে।
৭. দেশের একমাত্র অন্যতম কমিশন হচ্ছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। যোগ্য ও মেধাবীদের পরিবর্তে দলদাস অসৎ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে বিগত সরকারগুলো সকল সেক্টরে ঘুষ ও দূনীতির কারখানা তৈরি করেছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশন নতুন করে পুনর্গঠন করতে হবে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অধীনে পরীক্ষা পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা আনতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়ম চিরতরে দূর করতে হবে।
৮. আমাদের দেশে এখনও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হচ্ছে বস্ত্রখাত তথা তৈরি পোশাকশিল্প। এই খাতে আরও বেশি নীতি সহযোগিতা প্রধান করতে হবে। ভারতের সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। বিশেষ করে স্পিনিং খাত আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অবিলম্বে স্পিনিং খাতকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে। সুতা আমদানির ওপর নীতি ও সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। কোনো আমদানিকারক রপ্তানির জন্য ৪০ শতাংশের অধিক সুতা আমদানি করতে পারবে না এই মর্মে আদেশ প্রদান করলে তৈরি পোশাক শিল্প তথা বস্ত্রখাত রক্ষা পাবে, উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। রপ্তানিও দ্বিগুণ বাড়বে। আমদানি কমে আসবে।
৯. আমাদের সংবিধান ১৯৭২ সালে প্রথম প্রণীত হয়। পরবতীর্তে বহু সংশোধন। বর্তমান সংবিধানে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। ক্ষমতার ভারসাম্যতার অভাব আছে। তাই সংবিধান সংশোধন ও সংস্কার প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই জন্য প্রয়োজন একটি উচ্চ পর্যায়ের শক্তিশালী সংবিধান সংস্কার কমিটি গঠন করা দরকার। উক্ত কমিটির পরামর্শক্রমে সংসদ সংবিধানকে সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন করে উপযুর্ক্ত পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। তাতে দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলসমূহ উন্নতির দিক নির্দেশনা পাবে।
১০. এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অন্তবতীর্কালীন সরকারকে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে উল্লেখিত চ্যালেঞ্জ সমূহ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হবে। একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সকলের গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে সৎ যোগ্য প্রকৃত নিবেদিত দেশপ্রেমিক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
১১. ছাত্র জনতার গণআন্দোলনে হাজারের ওপরে মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছে ১ লাখের কম নয়। উক্ত বিষয়ে জাতিসংঘের অধীন একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে দ্রুত কত নিহত ও আহত হয়েছে তা নির্ধারণ করা। আহতদের সুচিকিৎসা রাষ্ট্রীয়ভাবে করা। নিহতদের পরিবারকে শহীদের ভাতা চালু করা। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সূচনা ও বাস্তবায়ন ও নিষ্ঠুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভূক্ত করতে হবে।