সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসুন একযোগে কাজ করি
সাংবাদিকতার পেশায় কাজ করতে গিয়ে প্রতিদিন অপরাধের অজস্র চিত্র দেখছি। কখনো তা রিপোর্ট আকারে, কখনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়। আজকের বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে—আমরা কি নিরাপদ? চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, প্রতারণা—এই অপরাধগুলো এখন যেন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন খবরের কাগজে কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় উঠে আসে এমন সব খবর, যা একদিকে আতঙ্কিত করে, অন্যদিকে সামাজিক ব্যবস্থার অসহায় চেহারাটা দেখিয়ে দেয়।
খবর পেলাম এক ব্যস্ত সড়কে একজন ব্যবসায়ীকে গুলি করে ৭০ ভরি সোনা ছিনতাই করা হলো। খুলনায় এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তুচ্ছ কারণে খুন হলো। পারিবারিক দ্বন্দ্বে প্রাণ হারালেন এক ব্যক্তি। এসব ঘটনা শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং একটি ধারাবাহিকতার অংশ, যেখানে অপরাধীরা সাহস পায় আইনের শিথিলতার সুযোগে।
কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য নিয়ে কতবার রিপোর্ট করেছি, তার কোনো হিসাব নেই। স্কুলব্যাগের ভেতরে ছুরি, গ্রুপ চ্যাটে সহিংসতার পরিকল্পনা—এসব এখন অনেকের কাছে ‘নতুন স্বাভাবিকতা’। চাঁদাবাজি, দখল, সাইবার ক্রাইম বা মব জাস্টিসের মতো অপরাধ তো এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে সাধারণ মানুষও নিজেদের অরক্ষিত মনে করে।
সাংবাদিক হিসেবে যখন কোনো অপরাধের ঘটনার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করি, তখন একটাই বিষয় সামনে আসে—আইনের শাসনের অভাব। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অপরাধীরা গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেরিয়ে এসে নতুন উদ্যমে অপকর্মে লিপ্ত হয়। তাদের এই পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি পুরো ব্যবস্থাটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আরেকটি ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, সমাজে ক্রমাগত বাড়তে থাকা অসহিষ্ণুতা। সামান্য সন্দেহের বশে একজন মানুষকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। যে সমাজে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়, সে সমাজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর কি শুধুই পুলিশের ব্যর্থতায় সীমাবদ্ধ? নাকি পুরো ব্যবস্থার মধ্যেই কোনো ফাটল লুকিয়ে আছে? সাংবাদিক হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, অপরাধ প্রতিরোধে কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরের ভূমিকা থাকা জরুরি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ও সরঞ্জামে সজ্জিত করা জরুরি। পাশাপাশি, সঠিক প্রশিক্ষণ ও নৈতিক মূল্যবোধ নিশ্চিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন। অন্যদিকে, সমাজের ভেতরে অপরাধপ্রবণতা কমাতে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় নেতৃত্বকে এগিয়ে আসতে হবে।
সাংবাদিকতার দৃষ্টিতে অপরাধ কেবল একটা ঘটনা নয়; এটি পুরো সমাজের চিত্র তুলে ধরে। প্রতিটি রিপোর্টে আমি দেখি ভেঙে পড়া পরিবার, ভীতিকর ভবিষ্যৎ, এবং দায়বদ্ধতার অভাব। এই চিত্র বদলাতে হবে।
আমরা এমন একটি সমাজ চাই, যেখানে একজন মানুষ তার জীবন নিয়ে শঙ্কিত না হয়ে নিশ্চিন্তে পথ চলতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শতভাগ সক্ষমতা অর্জন এবং জনগণের সহযোগিতা ছাড়া এই লক্ষ্য পূরণ সম্ভব নয়। দেশ ও জাতির জন্য আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। আমরা সবাই চাই অপরাধমুক্ত একটি বাংলাদেশ।
রাকিব হোসেন মিলন (লেখক ও সাংবাদিক)
বিআলো/তুরাগ