‘স্যার’বেন, না ধরা খাবেন!
অতি সম্প্রতি অতীব কৌতুক ও কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, উপরঅলাকে ‘স্যার’ বলা না বলা নিয়ে ফেসবুক-মিডিয়ায় তুমুল কড়চা চলমান রয়েছে। ভারতীয় অর্থনীতিবিদ এবং নিউ ইয়র্কের কর্নেল ইউনিভার্সিটির অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপক কৌশিক বসুর একটি লেখার কারণেই মূলত এই রসঘন কড়চার সূত্রপাত হয়। তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ভারতীয় আমলারা প্রতি মিনিটে গড়ে ষোলোবার ‘স্যার’ শব্দটি উচ্চারণ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি আরো একটি সরল অংক কষে দেখিয়েছেন যে, এবংবিধ স্যার সম্বোধনে তাদের মোট কর্মঘণ্টার প্রায় তেরো শতাংশ অপব্যয়িত হয়। আমি কিন্তু মোটেও এর বিপক্ষে নই। কারণ ‘স্যার’ নিছক একটি সম্মানসূচক শব্দ। যিনি বাচাল তিনি বেশিবার এটি ব্যবহার করবেন, আর যিনি চরিত্রগতভাবে মিতভাষী, ইংরেজিতে যাকে বলে রেটিসেন্ট, তিনি সাতিশয় সংযতভাবেই ‘স্যার’ শব্দটির প্রয়োগ করবেন। অর্থাৎ দোষ ‘স্যার’-এ নয়, বরং এর অমিতাচারী, তৈলাভাস ও কূটাভাসযুক্ত অভব্য ব্যবহারে।
একথা বলাই বাহুল্য, স্যার সম্বোধন মূলত একটি ব্রিটিশকেতা, ইংরেজ শাসনামলে এই ‘স্যার সম্বোধন’ আমাদের রক্তে ও মজ্জায় এমনভাবে প্রোথিত হয়েছে যে, এখন আর চাইলেও আমরা তার থেকে বেরোতে পারছি না। আর তার কোনো দরকার আছে বলেও আমি মনে করি না। কেননা, ‘স্যার’ ছেঁটে ফেললেই বরং ব্যাপক ঝামেলা, অনেক কিছুই ঘেঁটে যাবে। একটু উদাহরণ দিই, তাহলেই বিষয়টি বরং সম্যক উপলব্ধি করা সহজ হবে। সিনিয়রকে নাম ধরে ডাকা আমাদের অভ্যাস নয়। তারা অনেকটা ভাসুর শ্রেণির মানুষ। ভাসুরের নাম নেয়া যেমন কাঙ্ক্ষিত নয়, ঠিক তেমনি ঊর্ধ্বতনের নাম সম্বোধনেও কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে স্যার না ডেকে আর কী ডাকতে পারতাম বলুন তো! ভাই, কাকা, জেঠা, নাকি দাদু! সিনিয়রের বয়স যতই হোক, তাকে একবার জেঠা বা দাদু ডেকে দেখুন না, চাকরি থাকে কিনা! আর তিনি যদি হন নারী, তাকে আপনি আপা, আন্টি বা নানি ডাকতে পারতেন। ফল কী হোত, সে আপনি হাতেনাতেই টের পেয়ে যেতেন। দাঁত একটাও মাড়িতে থাকতো বলে মনে হয় না! সপাটে চড় খেয়ে নিমিষে আপনার দাঁতের বংশ সমূলে নির্বংশ হয়ে যেত। তখন আপনার জন্য শুধুই সেরেল্যাক।
‘স্যার’ সম্বোধন যেহেতু ভালো কিছু নয়, তাই অবনমনের কথা এলো। আসলে এটা একরকমের সম্মানসূচক সম্বোধন মাত্র, এরচে বেশি কিছু নয়। আপনি কাউকে কী বলে ডাকবেন সেটা নিতান্তই আপনার ব্যাপার। পূর্বেই বলেছি, আমাদের মহান সংবিধান বা অন্য কোথাও স্যার ডাকার বিষয়ে নির্দিষ্ট করে ‘ফরমালি’ কিছু বলা নেই।
জনাব বসুর মূল লেখাটি আমি পড়েছি। বেশ তথ্যবহুল, রসঘন ও খুবই সুপাঠ্য একটি লেখা, এ বিষয়ে আদৌ কোনো সন্দেহ নেই। লেখাটি তিনি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন, ভারতীয় আমলাদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগও তাঁর হয়েছিল। একসময় তিনি ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর সেই প্রবন্ধে কৌশিক বসুর একটি আক্ষেপও কিন্তু স্ফটিকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়। তাঁর তিনজন সহকর্মী ছিলেন সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা, যারা কিনা আলাদা একটি শৌচাগার ব্যবহার করতেন, সেখানে তাদের জন্য বিশেষ র্যাকে একটি করে তোয়ালেও শোভা পেত। কৌশিকের বয়ানে এটুকু অন্তত বোঝা যায়, সেই বিশেষ শৌচাগারে প্রবেশাধিকার না পেয়ে শুরুর দিকে তিনি বেশ মনোকষ্টেই ছিলেন। এও জানা যায়, সচিবগণের সঙ্গে একই শৌচাগার শেয়ার করতে পারাটা, এবং তাঁর নিজের জন্য একটি আলাদা র্যাক ও তোয়ালে বরাদ্দ থাকাটা রীতিমতো শ্লাঘার ব্যাপার বলেই মানতেন তিনি। লেখায় তিনি নিজেই লিখেছেন, পরবর্তীতে বিশেষ চেষ্টা-তদবিরের মাধ্যমে সচিবগণের শৌচাগারে অবশেষে তিনি প্রবেশাধিকার পান, এবং তাঁর জন্যও আলাদা একটি র্যাক এবং তোয়ালে বরাদ্দ হয়।
যাক, আপাতত কৌশিকের বিষয়ে আর কিছু বলছি না, বোদ্ধা পাঠক যা বোঝার এতক্ষণে নিশ্চয়ই তা বুঝতে পেরেছেন। ‘স্যার’ নিয়ে যথেচ্ছাচার এবং এর ঘোর বিরোধিতার পেছনেও একটি গল্প রয়েছে, এটুকু অন্তত আমরা উপলব্ধি করতে পারি। কারো ব্যক্তিগত মনোবেদনা, আপসোস, জুগুপ্সা বা আর্তের চিৎকারের মতোন ব্যাপার থাকতে পারে, আই’ম নট শুওর অ্যাবাউট ইট। এবার আসুন, স্যার কে বলে, আর কে বলে না! আমার সরকারি চাকরির বয়স নয় নয় করে আঠারো বছর প্রায়। আমাদের বাইবেল অর্থাৎ ‘রুলস অফ বিজনেস’-এ কোথাও স্যার সম্বোধনের বিষয়টি উল্লেখ আছে বলে মনে করতে পারছি না। এটা অনেকটা লোকাচারের মতোন ব্যাপার। উঁহু, ঠিক লোকাচারও নয়, চাকরিরতদের আদবকেতা বলা যায়। তবে তা রাষ্ট্রাচার নয় মোটেও। অর্থাৎ জোর-জবরদস্তি করে কাউকে দিকে ‘স্যার’ ডাকানো যায় না। এটা আমাদের মহান সংবিধানের প্রবিধানও নয়।
তাহলে প্রশ্ন- আমরা কেন ‘স্যার’ বলি! কেন! সম্প্রতি ফেবুতে তুমুল ভাইরাল হওয়া এক নেতার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি- কেন! স্যার না বললে কি চাকরি থাকছে না! ছোট্ট প্রশ্নের সহজ উত্তর- না, থাকছে না। বসকে স্যার না বলে কাকা-জেঠা বা দাদু ডাকলে আপনার চাকরি আসলেই থাকবে না। উল্টো ডিপি মানে ‘ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিংসয়ের’ শিকার হয়ে জলদি মেন্টাল হসপিটালে সিট বুক করতে হবে। এই সহজ ব্যাপারটা যারা বোঝে না, তারাই কেবল আমলাদের স্যার ডাকা নিয়ে মেলা হাউকাউ করে। অহেতুক মাঠ গরমের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়।
এবার প্রশ্ন- স্যার শব্দটি মিনিটে কতবার বলা যাবে। আগেই বলেছি, রুলস অফ বিজনেসে এই বিষয়ে কোনোরকম দিকনির্দেশনা দেয়া হয়নি। তার মানে যার যতবার ইচ্ছে বলবে, সেটা নেহাতই তার নিজস্ব ব্যাপার। আমি তো শুনেছি কোনো কোনো স্বামী বাসায় তার স্ত্রীকেও জানু’র মতো করে স্যার ডাকে, যাতে পরিবারের শান্তি বিনষ্ট না হয়, সার্বিক আয়-উন্নতি অটুট থাকে। তার মানে স্যার ডাকার মেলা ফজিলত আছে। মিনিটে ষোলোবার স্যার ডাকাটা একটু বেশিই মনে হয়, কিন্তু ওই যে বলেছি, যারা বাচাল তারা বেশি বকে। তার মানে এই নয় যে, তারা কাজ কম করে। সব্যসাচী বলে একটা শব্দ আছে জানেন তো! স্যার ডাকতে ডাকতেও কাজ করা যায়, নয় কি! কাজ আপনি হাত দিয়ে করবেন, মুখে নয়।
স্যার সম্বোধনের মাঝে তৈলাভাস লুকিয়ে থাকে, মানছি। তেল খুব দারুণ জিনিস। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এ বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান রেখে গেছেন। তেলে গাড়ি চলে, আলো জ্বলে, পাখা ঘোরে, আবার বস এবং বউয়ের মগজও প্রশান্ত হয়। তাই বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, স্যার সম্বোধন মোটেও গর্হিত কিছু নয়। স্যার-ডাক শুনতে ভালো লাগে। আর যারা ‘স্যার’ শুনতে পান না, তারাই কেবল এর বিরুদ্ধাচরণ করেন, অনর্থক মনোকষ্টে ভুগেন, কী জানি, জনাব বসুর ন্যায় রাষ্ট্রীয় শৌচাগারে আলাদা র্যাক না-পাবার কোনো বঞ্চনা তাদের জীবনেও থেকে থাকবে হয়তো।
আপ্তবাক্য এমন- যস্মিন দেশে যদাচার। যখন যেখানে যেমন, তখন সেখানে তেমন। আপনি উটে চেপে যেমন সাগর পাড়ি দিতে পারেন না, ঠিক তেমনি কর্তাব্যক্তিকে ‘স্যার’ না ডেকে কার্যোদ্ধার করা কঠিন বৈকি। আমি অতি সাধারণ ‘লেখক মানুষ’, আমলাতন্ত্র আমাকে মানায় না, আমি নিজের কার্য হাসিলের জন্য অনেক সময় কেরানিকেও স্যার ডাকি। স্যার ডাকলে যদি কেউ খুশি হয়, খুশিতে বগল বাজায়, আর আমার ন্যায়ানুগ কাজটি চটজলদি করে দেয় তো স্যার ডাকলে ক্ষতি কী! তার মানে এই নয় যে, অযথা তেল ঢেলে আমি অন্যায় সুবিধা নিতে চাইছি। ওই বস্তু আমার ধাতে নেই, আমি তৈল-প্রয়োগে মোটেও পারঙ্গম নই।
একটি মজার কথা বলে নিই, পরে ভুলে যাবো। আমার এক সহকর্মী রয়েছেন, তিনি জোড়ায় জোড়ায় ‘স্যার’ বলেন। কথার আগে-পিছে ও মাঝে মোট তিনজোড়া স্যার ডাকেন। অনেকটা সেই উদারা-মুদারা-তারার মতোন। জি বা হ্যাঁ-কেও তিনি ‘স্যার’ দ্বারা প্রতিস্থাপন করে নিয়েছেন। ‘প্রশ্নবোধক স্যার’ও বলেন তিনি। কখনও কখনও একটু কানে লাগে বটে, তবে তার কর্মোদ্যোগ এতটাই প্রশংসনীয় যে আমি তাকে খারাপ ভাবতে পারি না। তাছাড়া এটা তার বাহুল্যদোষ মাত্র, স্বপ্নদোষ বা এই জাতীয় কিছু নয়। এতে ক্ষতির কিছু নেই।
স্যার কি শুধু আমলারা বলেন, বেসরকারি বা করপোরেটে এই কালচার নেই! হালে দেখছি লেখক কিংবা কবিরাও ‘স্যার’ পদে অবনমিত (!) হয়েছেন। ‘স্যার’ সম্বোধন যেহেতু ভালো কিছু নয়, তাই অবনমনের কথা এলো। আসলে এটা একরকমের সম্মানসূচক সম্বোধন মাত্র, এরচে বেশি কিছু নয়। আপনি কাউকে কী বলে ডাকবেন সেটা নিতান্তই আপনার ব্যাপার। পূর্বেই বলেছি, আমাদের মহান সংবিধান বা অন্য কোথাও স্যার ডাকার বিষয়ে নির্দিষ্ট করে ‘ফরমালি’ কিছু বলা নেই। আমার ছেলেরা একসময় আমাকে ‘তুই’ সম্বোধন করত। আমার খুব একটা খারাপ না লাগলেও সমাজ সেটাকে ভালোভাবে নেয়নি। ওরা বড় হয়ে সেটা বুঝলো এবং তুই থেকে এখন তুমিতে উঠে এসেছে। কি জানি, সমাজ না মানলে তারা হয়তো অচিরেই তুমি থেকে আপনিতে, এবং পরে ভাববাচ্যে উঠে আসবে! তাই এ নিয়ে মিছে তক্কাতক্কির কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।
পাশ্চাত্যে অচেনা কাউকে সচরাচর ‘স্যার’ সম্বোধন করা হয়। তাতে কেরানি অফিসার, বা অফিসার কেরানি পদে ওঠানামা করে না। ‘ব্রো এবং সিস’ বলে নতুন দুটো শব্দ অবশ্য এখন শোনা যায়, বিশেষত তরুণদের মধ্যে। এগুলো জাস্ট ‘সোসাইট্যাল’ সংস্করণ, আপনি-আমি চাইলেও তা রোধ করতে পারবো না। তাই বলি কি, মিছে ‘স্যার সম্বোধন’ নিয়ে ছিঁচকেমি না করি, অন্যকে সম্মান দিলে তাতে নিজের সম্মান কমে না। আমাদের সরকারি চাকরিতেও দেখেছি কিছু অফিসার নিজে ‘স্যার’ শুনতে অভ্যস্ত, অথচ অন্য ক্যাডারের সিনিয়রদের স্যার সম্বোধন করতে বড়ই কৃপণ। এহেন দ্বিধা তাদের পারিবারিক শিক্ষার দৈন্য এবং দম্ভকেই নির্দেশ করে। বস্তুত, এটা ঘোরতর অন্যায়। অন্যকে ছোটো করে নিজে কখনও বড় হওয়া যায় না। কখনোই না।