হজরতুল আল্লামা শাহ্ আবদুল মালেক আল-কুতুবী (র.)’র আধ্যাত্মিক কর্মপদ্ধতি
মুসলিম রেনেসাঁর অন্যতম অগ্রদূত, ওলিয়ে মুকাম্মেল, যুগশ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন, আধ্যাত্ম পরিমণ্ডলের জ্যোতিষ্ক, হজরতুল আল্লামা শাহ্ আব্দুল মালেক আল-কুতুবি (র.) বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য সুফি-সাধক। পর্যটন নগরী কক্সবাজার জেলার দৃষ্টিনন্দন কুতুবদিয়া থানার ধুরুং গ্রামে এ মহান তাপসকুলের শিরোমণি-১৯১১ ইংরেজি, মতান্তরে ৩১ ডিসেম্বর ১৯০৯ সালে ঐতিহ্যবাহী হাফেজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শাহ্ আবদুল মালেক আল-কুতুবী (র.) একাধারে ছিলেন বহু ভাষাবিদ, ধর্মতত্ত্ববিদ, মুফাচ্ছিরে কুরআন, হাফিজুল হাদিস, ফকিহুল মিল্লাত, ইসলামী উত্তরাধিকার আইনবিদ (ফরায়েজ), আধ্যাত্মবিদ, শায়খুল মাশায়েখ এবং মানবতাবাদী আধ্যাত্মিক ধর্মীয় ইমাম। এ মহান বরেণ্য শিক্ষাবিদ দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, অলংকার শাস্ত্র ও দর্শন শাস্ত্রসহ নানাবিধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত পরহেজগার ও দ্বীনদার প্রকৃতির ছিলেন। সাত বছর বয়স থেকে নিয়মিত ফরজ সালাতের পাশাপাশি নফল ইবাদত ও তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন। দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসা (চট্টগ্রাম) থেকে পড়াশুনা শেষ করে দারুল উলুম দেওবন্দ (ভারত) থেকে তফসির, হাদিস এবং ফিকাহ বিভাগ থেকে অধ্যয়ন শেষ করেন। অ্যাকাডেমিক পড়াশুনা শেষ করে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি গ্রাম-গঞ্জে ওয়াজ-নসিহত ও হেদায়াতের বাণী প্রচারে নিজকে নিয়োজিত রাখেন। ছাত্রাবস্থায় সৈয়দ হাফেজ মুনিরুদ্দীন নুরুল্লাহ (র.)’র হাতে বায়’আত গ্রহণ করেন এবং সুদীর্ঘকাল পীরের সান্নিধ্যে ও খেদমতে থেকে জাহেরি ও বাতেনি শিক্ষা নিয়ে তরিক্বতের খেলাফত লাভ করেন। ইলমে বেলায়াতের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছার পর শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে পাহাড়ে-পর্বতে এবং নির্জনে ধ্যান-সাধনায় নিমগ্ন হয়ে পড়েন। তরিক্বতের খেলাফত পাওয়ার পরও তিনি পীর-মুরিদি হতে বিরত থাকেন। আল্লাহর এ মহান অলির অলৌকিক খোদায়ি ক্ষমতা ও রেয়াজতের কর্মপদ্ধতিসমূহ আলোচনা করা হলো। হজরত আল-কুতুবীর-হালত ও জজবা (জজবা অর্থ আল্লাহর প্রতি আকর্ষণ) ছিল ইশকে ইলাহির অলৌকিক ক্রিয়াকলাপে পরিপূর্ণ। দিনে-রাতে আল্লাহও রাসূল (দ.)’র ইবাদতে মশগুল থাকতেন এবং তাশাহুদের অবয়বে দীর্ঘক্ষণ মুরাক্বাবা ও মুশাহেদায় ধ্যান মগ্নাবস্থায় থাকতেন। জবান ও ক্বলব সবসময় আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল (দ.)’র জিকিরে অবিশ্রান্ত ও প্রাণবন্ত থাকত। ভক্ত-আশেকানদের আল্লাহর জিকিরের তা’লিম দিতেন এবং বলতেন, “ডান হাতের তর্জনি, মধ্যমা, অনামিকা ও কনিষ্ঠা আঙ্গুল দিয়ে বাম হাতের তালুর উপর চাপড় মেরে ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ শব্দের সমন্বয়ে একাগ্রতার সঙ্গে জোর গলায় আল্লাহকে ডাকো”। তবে নিজে হাতে চাপড় মেরে জিকির করতেন না। তিনি জবানে ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ দিয়ে জিকির করতেন। হাতে চাপড় দিয়ে জিকির করা সম্পর্কে হজরত আল-কুতুবী (র.) বলতেন, ‘‘একটি কাঠিকে আরেকটি কাঠি দ্বারা আঘাত করে শব্দ সৃষ্টি করা শরিয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েজ। তবে হাতে চাপড় মেরে ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ শব্দের সমন্বয়ে নফসের পরিশুদ্ধতা আনয়নের জন্য লোকদের জিকির করার ব্যাপারে আল্লাহ পাক আমাকে ইলহাম করেছেন”। নুরুল আনওয়ার গ্রন্থের উদ্ধৃতি মতে, “কোনো একটি হুকুম আল্লাহর পক্ষ হতে আসলে হুকুমকৃত কাজটি হুকুমপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য পালন করা ফরজ (অবশ্যকীয়)”। এ জিকিরের ফলে মানুষের মরা ক্বলব দ্রুত জিন্দা হয়ে যেত। জিকিরের আওয়াজে পুরো এলাকা ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হতো! এ চাপড় অনুভূতিহীন মানুষের অন্তরে জাগরণ সৃষ্টি করে। হজরত আল-কুতুবি (র.) আরো বলেছেন, ‘এটি আত্মশুদ্ধির স্বল্প মেয়াদি বিশেষ ব্যবস্থা; সময়ের সাপেক্ষে হাতে চাপড় মেরে জিকির করার পদ্ধতিটি বন্ধ হয়ে যাবে’। হজরত ক্বেবলা (র.)’র দু’হাত ডানে-বামে উঁচু-নিচুতে আন্দোলিত করে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবিব (দ.)’র ইশকে বিভোর হয়ে মাস্তি হালে থাকতেন। জিকিররত অবস্থায় তার দিকে নজর করলে মনে হতো, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ও কষ্টকর কাজটি নিপুণতার সঙ্গে সমাধা করছেন। জিকিরের সময় ভক্তবৃন্দ ইশকে এলাহিতে ফানা হয়ে থাকতেন। জিকিরের প্রভাবে মানুষের ক্বলবে ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ জিকির জারি হয়ে যেত এবং ঈমান শতগুণে বৃদ্ধি পেত! এ যেন ইশকে ইলাহির এক রহস্যময় ক্রিয়াকলাপ! হজরত ক্বেবলার ফয়েজ ও তাওয়াজ্জুহের বরকতে মানুষের অন্তরে হেদায়াতের নূর প্রজ্জলিত হতো। তার রূহানি ফয়েজের প্রভাবে ভক্তবৃন্দ নবি করিম (দ.)’র জিয়ারত লাভ করতেন। একদা বাবাজান কেবলা- হুজুরাতে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ছিলেন। হঠাৎ ‘ইয়া নবি সালাম আলাইকা… বলে দাঁড়িয়ে যান। উপস্থিত সকলেও সমবেত কণ্ঠে নবিজি (দ.) কে সালাতু সালাম পেশ করলেন। কিছুক্ষণ পর বাবাজান কেবলা বললেন, নবি করিম (দ.) এ মজলিশে হাজির হয়েছেন। বাবাজান কেবলা প্রায় সময় বলতেন, ‘কুতুব শরীফ মদীনা শরীফ যায় আর মদীনা শরীফ কুতুব শরীফে আসে’। অর্থাৎ- তিনি মুহূর্তের মধ্যে দয়াল নবীজির জিয়ারত লাভ করতে পারতেন এবং পরম দয়াল নবী (দ.) তাঁর প্রিয় আশেককে দেখার জন্য কুতুবদিয়ায় চলে আসতেন। এ কালামটি প্রমাণ করে তিনি কত বড় মাপের আশেকে রাসূল (দ.) ছিলেন। হজরত আল-কুতুবি প্রায়ই বলতেন-‘আমি জাহিরি এবং বাতেনি ভাবে এমন কিছু বিশেষ কাজ করে যাচ্ছি; যা অবস্থা ও সময় সাপেক্ষে দৃশ্যমান হবে। বার্মার আরাকান থেকে আফগান পর্যন্ত ইসলামের বিজয়ের পতাকা পতপত করে উড়বে। কুতুবদিয়া দ্বীপের চতুর্দিকে বড় বড় (মাদার ভেসেল) জাহাজ নোঙর করবে। কুতুবদিয়া দ্বীপের চারিদিকে লাল-নীল রঙ্গের বাতি জ্বলবে। হেঁটে কুতুবদিয়া চ্যানেল পার হওয়া যাবে। কুতুবদিয়া দ্বীপ গ্যাস, তেল ও স্বর্ণের উপর ভাসছে। সময়মতো তার সন্ধান পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ এশিয়া মহাদেশের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র হবে। এশিয়া মহাদেশের অর্থনীতি বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ করবে। বাংলাদেশে তখনি শান্তি ফিরে আসবে যখন ৩দ্ধ১২=৩৬ জন বিশিষ্ট সর্বদলীয় সরকার গঠন হবে’। হজরত বাবাজান ক্বেবলা (রহ.)-খুবই স্বল্পাহার ও অল্পনিদ্রায় অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি তেমন খাবার গ্রহণ করেতন না, অতি সামান্য পরিমাণ খাবার গ্রহণ করতেন। অনেক সময় দিনের পর দিন মাসের পর মাস না খেয়ে রিয়াজতে মশগুল থাকতেন। গোস্ত, মাছ, সবজি, তরকারি ও দুধসহ জগাখিচুড়ি করে খাবার খেতেন; যাতে জিহ্বা খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতে না পারে। খাবার গ্রহণের আগে ও পরে আল্লাহও তাঁর প্রিয় হাবীব (দ.)’র দরবারে শোকরিয়া আদায় করতেন এবং আল্লাহর পক্ষ হতে যে কোনো নেয়ামত প্রাপ্ত হলেও শোকরগুজারি করতেন। হজরত ক্বেবলা প্রায় সময় লোকজনকে কুরআন ও হাদিসের আলোকে তাৎপর্যপূর্ণ বয়ান ও নসিহত প্রদান করতেন। তার বয়ানের ও রুহানি দৃষ্টির প্রভাবে শতশত মানুষ আল্লাহর ইবাদত ও রাসূল (দ.)’র আনুগত্যে পাবন্দ হতেন। তার সুললিত কণ্ঠ ও হৃদয়গ্রাহী বয়ানের প্রভাবে মানুষের মরা ক্বলবে ইশকে এলাহির জজবা সৃষ্টি হতো। সমকালীন সময়ের আলেমদের মধ্যে তিনি ছিলেন, ফসিহুল লিসান ও বলিগুল বায়ান। যুগের বিজ্ঞ আলেমগণ তাকে ‘বাহরুল উলুম’ ও ‘হাফিজুল হাদিস’ হিসেবে মূল্যায়ন করতেন। মাসআলা-মাসায়েল ও যে কোনো বিষয়ে কুরান-হাদিসের সমাধানের ক্ষেত্রে তিনি কিতাব না দেখে গ্রহণযোগ্য বিভিন্ন কিতাবের পৃষ্ঠাসহ মূল ইবারত থেকে রেফারেন্স দিতেন। হজরত বাবাজান বলতেন, ‘আমি চেষ্টা করলে মুহূর্তের মধ্যে মানুষের অন্তরে কামালিয়াতের ফয়েজ সঞ্চারিত করতে পারি; কিন্তু এ রকম উপযুক্ত লোকের সন্ধান নেই। খুব দুঃখ করে বলতেন- ‘আমার কাছে লোকজন আসে দুনিয়া কামানোর জন্য; মঞ্জিলে মকছুদে পৌঁছার জন্য কেউ আসে না। আমি যে রোগের ডাক্তার সে রোগের রোগী পাইনি’। তিনি- অসহায় ও গরিব মানুষদের সমাদর করতেন, তবে ক্ষমতাধর ও সম্পদশালীদের নয়। প্রকৃত আলেম এবং আহ্লুল্লাহদের ইজ্জত করতেন। মুহাক্কিক আলেমদের ‘ইজ্জতে ওলামা’ বলে সম্বোধন করতেন এবং যাওয়ার বেলায় আলেমদের হাদিয়া দিতেন। লোকদের খাওয়াতে তিনি বেশ পছন্দ করতেন। দরবারে আগত সকল মেহমানদের সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাতে বিনামূল্যে খাবার খাওয়াতেন, সঙ্গে বিভিন্ন পদের নাস্তাও। যুগশ্রেষ্ঠ এ মহান আধ্যাত্মবিদ ছিলেন- সুন্নতে নববী (দ.)’র জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তিনি প্রায় বলতেন-‘আমার প্রকৃত হালত সম্পর্কে তোমরা অবগত নও। আমি মজযূব নই। আমাকে মজযূব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করলে কিয়ামত দিবসে আল্লাহর আদালতে দোষী সাব্যস্ত হতে হবে। আমার হালত দু’টি- (১) হালতে জালালি (২) হালতে জামালি’। তিনি বলতেন- ‘জালালি হালতের সময় আমার কাছে কেউ যেন না আসে। কারণ এ অবস্থায় জালালিয়াতের ফয়েজ জারি হয়; এ ফয়েজ কেউ বরদাস্ত করতে পারবে না’। জালালি হালত বলতে বুঝায়- আল্লাহর গুণবাচক নাম তথা- আল-আ’জীজ, আল-মুহাইমিন, আল-জাব্বার, আল-ক্বহ্হার, আল-মুদ্বি’লু, আল-মুমীত, আল-কুদির ইত্যাদী মহিমান্বিত ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাজে নিয়োজিত থাকা। অধিকাংশ সময় তিনি- হালতে জালালিতে অবস্থান করতেন। এমতাবস্থায় অবস্থায় খাওয়া-দাওয়াসহ দুনিয়াবি সমস্ত কার্যকলাপ হতে বিরত থাকতেন। এ অবস্থায় তার দিকে দৃষ্টিপাত করলে মনে হতো তার শরীর থেকে আলোর বিকিরণ ঘটছে। মিশকাত শরীফে এসেছে, আল্লাহর এমন কিছু বান্দা (আল্লাহর ওলী) আছেন; যারা আল্লাহর সৃষ্টি জাহান পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন। এ হাদিসের আলোকে বলা যায়; তিনিও সে সমস্ত কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। এজন্য প্রায়ই বলতেন- ‘আমি আল্লাহর কাজে ব্যস্ত আছি’। এমতাবস্থায় তার অনুমতি ব্যতিরেকে নিজ সন্তানেরা পর্যন্ত দেখা করার সুযোগ পেতেন না। শৈত্যপ্রবাহের সময় খালিগায়ে খোলা আকাশ এবং উম্মুক্ত স্থানে আল্লাহ ও তার রাসূল (দ.)’র ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। মাঝে মাঝে জামালি হালতে ফিরে আসতেন। হালতে জামালি বলতে বুঝায়- আর রাহমান, আর-রহীম, আল-কুদ্দুস, আস-সালাম, আর-রজ্জাকু ইত্যাদী মনোহর রূপমাধুরী পূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকা; এ হালতকে বলা হয় হালতে জামালি। তার সুরত সর্ম্পকে তিনি নিজেই বলেছেন, আমার সুরত তিনটি- (১) সুরতে বশরি অর্থাৎ যে সুরতে হাজেরানে মজলিসে সামনে আমি উপস্থিত থাকি, (২) সুরতে নূরি অর্থাৎ যে সুরতে আমি আল্লাহ পাকের জাতের সামনা-সামনি হাজির থাকি, (৩) সুরতে মালাকি অর্থাৎ যে সুরতে আমি বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে সফর করে থাকি’। এ সর্ম্পকে বুঝতে হলে এবং জানতে হলে পড়তে হবে- হজরত সোলায়মান (আ.) ও রানি বিলকিসের ঘটনা। যা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা’লা হজরত আল-কুতুবী (র.) কে এত অধিক পরিমাণে ইলমে লাদুন্নি ও ইনকেশাফি (কাশফ, অভিহিত করা, জানিয়ে দেওয়া) ইলম দানে ধন্য করেছেন যা বর্ণনাতীত এবং অকল্পনীয়। রাসূল (দ.) বলেছেন, ‘তোমরা মুমিনের অন্তর্দৃষ্টি সর্ম্পকে সতর্ক থাকো। কেননা সে আল্লাহর নূরের দ্বারা দেখে’। হজরত আল-কুতুবীর মাক্বামে বেলায়াত সম্পর্কে তার পীর ও মুর্শিদ হাফেজ মুনিরুদ্দীন (রহ.) বলেছেন, ‘আমার আবদুল মালেকের বিষয়ে আল্লাহ পাক আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন; সে দায়িত্ব আমার কাছ থেকে আল্লাহ পাক উঠিয়ে নিয়েছেন। আমার আব্দুল মালেককে আমি যে সমস্ত নেয়ামত দান করেছি, সবি উঠিয়ে নিলেও আল্লাহর পক্ষ হতে অজস্র নেয়ামত এসে পুনরায় তার সিনায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তার সুদৃষ্টিতে মানুষ কামালিয়াত অর্জন করবে এবং বদনজরে জ্ঞানশূণ্য হবে। সাবধান! আমার মালেকের সঙ্গে কেউ অশোভন আচরণ করবে না’। দাদাপীর হাফেজ হামেদ হাসান আজমগড়ী (রহ.) বলেছেন, ‘মালেকের বেলায়াতের স্তর এতই সুউচ্চ যে, আমার বেলায়াতের নজরে তার মাক্বামে বেলায়াত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না; তার মাকামে বেলায়াত খুবই ঊর্ধ্বে’। হজরত শাহ্ আবদুল মালেক (র.) বলেছেন, ‘আল্লাহ পাক আমাকে ওলিয়ে রহমতি করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আমার বেলায়াতের নজরে সারা পৃথিবী আমার কাছে অণু ও পরমাণুর মতো। রাসূল (দ.)’র কদম মুবারক আমার মাথার উপর। প্রতিদিন-রাত অসংখ্য জ¦ীন ও মনুষ্যজাতি তার পরশে ভীড় জমাতেন। যা তিনি অপছন্দ করতেন। সকলের হাদিয়া গ্রহণ করতেন না। মাঝেমাঝে টাকা-পয়সা আগুনে পুড়ে ফেলতেন। পোড়ানো টাকার দিকে দৃষ্টিপাত করে বলতেন, ‘এ টাকার দিকে নজর করিও না; এগুলো হারাম টাকা’। হাদিয়ার অধিকাংশ টাকা-পয়সা মানবসেবায় ব্যয় করতেন; অল্প টাকা দিয়ে আগত মেহমানদের মেহমানদারি করতেন এবং সবসময় আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে চলাফেরা করতেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কুতুব শরীফ দরবারের নামে জায়গা-জমি ক্রয় করার আগ্রহ প্রকাশ করলে; তাদের নিরুৎসাহিত করেন। প্রায়ই বলতেন, ‘কুতুব শরীফ দরবার; আল্লাহর দরবার; এ দরবারে যারা উপস্থিত হন; তারা সকলি আল্লাহর মেহমান। তাদের রিযিকের ফয়সালা আল্লাহর তা’আলা করবেন। এ বিষয়ে কারো চিন্তা করার প্রয়োজন নেই’। একদা তার স্নেহধন্য সন্তান চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলীয়া মাদ্রাসার সাবেক শায়খুল হাদিস শাহ্জাদা আলহাজ্ব মুনিরুল মান্নান আল-মাদানীর এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘হে আমার স্নেহধন্য সন্তান! বর্তমান সময়ে কামেল পীর কোথায় পাবে? (১) হালাল রুজি করো (২) জামাত সহকারে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করো (৩) সদাসত্য কথা বলো (৪) কারো উপর জুলুম করো না। আমার দিকে মুতাওয়াজ্জ হয়ে মুরাক্বাবা করলে সিনা-ব-সিনা তাওয়াজ্জুহ ও ফয়েজ লাভ করতে পারবে’। ইন্তেকালের সময় হজরত ক্বেবলা (রহ.)- শাহাদাতের মাক্বাম লাভ করেছিলেন। শাহ্জাদা আলহাজ¦ আতিকুল মিল্লাত আল-কুতুবি হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘১৯ জানুয়ারি ২০০০ ইংরেজি, বুধবার, চট্টগ্রাম-চন্দনাইশ থানার জনৈক এক পাগল কুতুব শরীফ দরবারে আগমন করে। ব্যক্তির গায়ের রং ছিলো কালো, চক্ষু ছিলো রক্তিম, শারিরীক গঠন ছিলো লম্বা ও হৃষ্টপুষ্ট এবং বয়স ছিলো ত্রিশ ঊর্ধ্ব বা অনূর্ধ্ব। পাগলটি ২৩ জানুয়ারি ২০০০ ইংরেজি, রেবিবার, দুপুর বেলা ১১-১২ ঘটিকার সময় শাহ্জাদা আলহাজ¦ শেখ ফরিদ আল-কুতুবির কাছে থেকে খাবার চান, তৎপর শাহ্জাদা শেখ ফরিদ লোকটিকে খাবার দেওয়ার জন্য আবুল কাশেম ফরাজীকে নির্দেশ দেন। পাগলটি খাবার গ্রহণ করে দ্রুতবেগে হজরত ক্বেবলার রুমের দিকে গমন করে এবং হুজরায় দায়িত্বরত প্রহরীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তৎপর উম্মাদ-হুজুরায় প্রবেশ করে হজরতকে আঘাত করে। তৎক্ষণাৎ একটি বিকট আওয়াজ সৃষ্টি হয়। অনন্তর পাগল দ্রুতগতিতে রুম থেকে প্রস্থান করে। হজরতের প্রহরী তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে বলতে লাগলেন, হজরত ক্বেবলাকে হত্যা করা হয়েছে! সকলে হজরত ক্বেবলার হুজরাখানায় ছুটে গিয়ে দেখতে পান; তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় বসে আছেন এবং দু’হাত আন্দোলিত করে আল্লাহর ধ্যানে মশগুল! সকলে দেখতে পেলেন-ডান হাতের কবজি ও কনুইয়ের মাঝখানের হাড় ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়ে যায়! তবে কোনো ধরনের রক্তপাত ঘটেনি! হজরত ক্বেবলাকে চিকিৎসা সেবা দিতে চাইলে তিনি অনাগ্রহ প্রকাশ করে বলেন, ‘সবকিছু আল্লাহ পাক ঠিক করে দিবেন। আমাকে এ স্থান থেকে কোথাও নিয়ে যেও না’। সেদিন আকাশ ছিলো মেঘাচ্ছন্ন, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এবং ঠাণ্ডা বাতাস। জোহরের সময় তাকে কুতুবদিয়ার বরঘোপ ঘাট হয়ে চট্টগ্রাম শহরের পাঁচলাইশ থানাধীন হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় এবং তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হজরত ক্বেবলা! সকলকে উদ্দেশ করে আকুতির সুরে বলেছিলেন, ‘আমাকে দুুনিয়াবি চিকিৎসার মুখাপেক্ষী করিও না’। তারপরও জোরপূর্বক তাকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এ সেবাকে তিনি অপমানজনক ভাবে দেখেছিলেন। প্রায়শ বলতেন, ‘আমাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাও। আমি সুস্থ হয়ে যাব’। বস্তুত আল্লাহর প্রিয় বান্দারা দুনিয়ার কোনো দাওয়াহ গ্রহণ করেন না। তাদের একমাত্র দাওয়াহ হচ্ছে আল্লাহ ও তার রাসূল (দ.)’র স্মরণ। ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্তে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে কিজন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন? মানুষ আমাকে কি হিসেবে গ্রহণ করল? সারা পৃথিবীতে একজন উপযুক্ত মানুষ পেলাম না’! ইন্তেকালের পূর্বে দরবারে অবস্থানকালে একদা মাও. সলিমুদ্দীনের উপস্থিতিতে হজরত ক্বেবলা! বলেছিলেন, ‘আল্লাহ পাক! আমাকে যে দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন; আমি সমস্ত দায়িত্ব সম্পন্ন করেছি; সবাই শোকরানা স্বরূপ দোয়া ও মুনাজাত করুন। হজরত ক্বেলবলাকে হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় ২৩-০১-২০০০ ইংরেজি এবং হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেন ০৩-০২-২০০০ ইংরেজি তারিখ। হাসপাতাল থেকে তাকে সরাসরি মাঝিরঘাটস্থ সেরুমিয়ার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি হাসপাতালে ছিলেন, সর্বমোট ১২ দিন এবং সেরুমিয়ার বাড়িতে ছিলেন ১৬ দিন। সর্বমোট আটাশ দিনের মাথায় ১৯-০২-২০০০ ইংরেজি, শনিবার, সকাল ৯.২০-২৫ মিনিটের সময় ইন্তেকাল করেন। সেদিন মেঘাচ্ছন্ন ও কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে হালকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছিল। ১৯ এবং ২০ তারিখ দুই দিন আকাশে সূর্যের আলো দেখা যায়নি। হাদিসে এসেছে, ‘একজন আলেমের মৃত্যু মানে একটি জাহানের মৃত্যু। শাহ্জাদা আলহাজ আতিকুল মিল্লাতের ভাষ্যমতে, ‘অন্তিম গোসলের সময় ডান হাতের ব্যান্ডেজ খোলা হলে দেখা যায় ডান হাতের ভাঙ্গা হাড়গুলো জোড়া লাগা অবস্থায় রয়েছে! এ দৃশ্য দেখে মরহুম আফজালুর রহমান শওকত, মরহুম একেএম জাফরুল্লাহ, মরহুম ইসমাঈল ও মরহুম মুহাম্মদ হোছেন সওদাগর সকলে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি তুলে চিৎকার শুরু করেছিল। ভক্তবৃন্দ তাদের পরম ও মমতার দরদি পীর হজরতুল আল্লামা শাহ্ আবদুল মালেক আল-কুতুবী (র.)’র কাফনের কাপড় ও কফিনের ব্যবস্থা করে গোসল সমাধা করেন। ইন্তেকালের পরে তার মধুমাখা নূরানী চেহারার শ্রী শতগুণে বৃদ্ধি পেয়ে আলো ছড়াতে থাকে। নামাজে জানাযা প্রথমে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ১৯ ফেব্রুয়ারি বাদে আছর সম্পন্ন হবার কথা থাকলেও অতিরিক্ত মানুষের জামায়েত ও ভীড়ের কারণে দেহ মুবারক জানাযার মাঠে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ দেহ মুবারক বের করতে গিয়ে প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ব্যক্তিবর্গ এবং সাধারণ মানুষ আহত হয়েছিল। দেহ মুবারক মাঝির ঘাট খানকা থেকে বের করা হলেও ৩-৫ মিনিটের মধ্যে প্রশাসনের অনুরোধে দেহ মুবারক ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। বাদে মাগরিব সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী, তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, খাদ্য মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন, চট্টগ্রামের সিটি মেয়র মহিউদ্দীন চোধুরীসহ রাষ্ট্রীয় ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ রাত ১২টা পর্যন্ত মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেন যে, জানাযার সবকিছু রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পন্ন করা হবে এবং ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯.৩০টায় চট্টগ্রাম কলেজের প্যারেড মাঠে প্রথম নামাজে জানাযা সম্পন্ন হবে। চট্টগ্রামের বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা শাহজাহান চৌধুরী সারা রাত হজরত ক্বেবলার দেহ মুবারকের আশপাশে ছিলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭.৩০ মিনিটে দেহ মুবারক বের করা হয় এবং ৯টার দিকে প্যারেড মাঠে পৌঁছায়। গাড়ি থেকে দেহ মুরবারক মাঠে রাখার জন্য নামানো হলে ভক্তবৃন্দ শেষবারের মতো এক পলকে দেখার জন্য এবং খাটিয়া ছুঁয়ার জন্য আত্মাহারা হয়ে পড়েন; একপর্যায়ে দেহ মুবারকের খাটিয়াটি সবার হাতের উপর ভাসমান অবস্থায় মাঠের পূর্বদিক থেকে ঘুরে আবার পশ্চিমে নিয়ে আসা হয়। তৎপর ৯.৩০ মিনিটে প্রথম নামাজে জানাযা সম্পন্ন হয়। জানাযায় এত পরিমাণ লোকের সমাগম হয়েছে যে, জানাযার সময় তার দেহ মুবারকের চতুর্দিকে লোকে লোকারণ্য ছিল। লোক জমায়েতের দিক দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি ছিল অদৃষ্টপূর্ব জানাযা। বিশ্বের বড়বড় স্যাটেলাইট সংবাদ ও টিভি চ্যানেলগুলো এ জানাযাকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জানাযা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। জানাযা শেষে কুতুবদিয়া জন্মভূমির মাটিতে সমাহিত করার জন্য প্যারেড মাঠ থেকে দেহ মুবারক ব্রিজ ঘাটের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়; তৎপর দুপুর ১২টার দিকে দেহ মুবারক ব্রিজঘাটে পৌঁছায় এবং সরকারি জাহাজে করে দেহ মুবারক ৩.৩০ মিনিটের দিকে কুতুবদিয়া দরবার ঘাটে পৌঁছায়। বাদ আছর দ্বিতীয় জানাযা কুতুব শরীফ দরবারের উত্তর পাশের বড় একটি বিলে অনুষ্ঠিত হয়। দেহ মুবারক জমিনে রাখা মাত্রই একটি অলৌকিক ঘটনা দেখা যায় উত্তর আকাশ হতে একটি সাদা মেঘ দক্ষিণ আকাশে এসে বিলীন হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে পুরো বিল লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। দ্বিতীয় জানাযার ইমামতি করেন মাওলানা শাহ্জাদা মুনিরুল মান্নান আল-মাদানী। মাগরিবের নামাজের পর এ মহান দীপ্তমান সূর্য সন্তানকে সমাহিত করা হয়। কবরে রাখার সময় দেহ মুবারক নড়াচড়া করতে দেখা যায় এবং ওফাতের পরও পা নাড়তে দেখা যায়; এমনকি মাঝে মাঝে চোখের পাতা একটুখানি খুলতে আবার বন্ধ করতে দেখা যায়। ইন্তেকালের পর থেকে কপাল বেয়ে বেয়ে প্রচুর ঘাম ঝড়তে দেখা যায়। ওফাতের পরও বিছানা গরম ছিল এবং ছোট্ট শিশুর মতো শরীর ছিল তুলতুলে নরম ও মোলায়েম। হাদিস ও ফেকাহ শাস্ত্রে রভাষ্যমতে, হজরত ক্বেবলা (রহ.) শাহাদাতে হুকমীর মর্যাদা লাভ করেছেন। কারণ আল্লাহর একাত্ববাদ ও নবি করিম (সা.)’র রেছালাতের দাওয়াত ও তালিম প্রদানকালে দুর্বৃত্তের হামলার স্বীকার হন এবং আহত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, আইনজীবী, শিক্ষাজীবী, বুদ্ধিজীবী, লেখকসহ অসংখ্য গুণীজন শোক জ্ঞাপন করেন। তৎকালীন সময়ের ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় তার ইন্তেকাল ও জানাযার নিউজ কভারেজ করেন। জানাযার দিন চট্টগ্রাম শহরের অলিগলিতে লোকে লোকারণ্য হয়ে যাওয়ার ফলে অঘোষিতভাবে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করে তৎকালীন সরকার বাহাদুর। হে আল্লাহ! আপনার এ মহান ওলিয়ে কামেলের মতো আপনার সান্নিধ্য হাসিল করার তৌফিক দান করুন।
মাওলানা কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী
লেখক: কবি ও সাহিত্যিক
বিআলো/তুরাগ