হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের প্রতি মানবিকতা কাম্য
সম্পাদকীয়: সব ধরনের বিচারিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ব্যক্তিকে কনডেম সেল বা নির্জন কারাকক্ষে না রাখার বিষয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। সম্প্রতি বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ পর্যবেক্ষণসহ রায়ে আরও বলেছেন, দণ্ডবিধিতে কনডেম সেলে রাখাই এক ধরনের শাস্তি। কাজেই মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর কনডেম সেলে রাখা হলে তা দুবার সাজার সমতুল্য। তাই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের সঙ্গে অন্য বন্দিদের মতোই আচরণ করা উচিত।
ব্যতিক্রম পরিস্থিতি, যেমন: ছোঁয়াচে রোগ বা সমকামিতা থাকলে বিশেষ বিবেচনায় যে কোনো বন্দিকে বিচ্ছিন্ন কক্ষে রাখা যেতে পারে। এছাড়া মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বন্দিদের অন্য বন্দিদের মতো জামিন আবেদনের অনুমতি দেওয়া উচিত। মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগেই যাদের কনডেম সেল বা কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছে, তাদের দুবছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে সাধারণ সেলে স্থানান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দেশে মূলত বিচারের তিনটি ধাপ রয়েছে। বিচারিক আদালত, উচ্চ আদালত ও সর্বোচ্চ আদালত (আপিল বিভাগ)। বিচারিক আদালত কোনো আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিলে সেটিকে কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে। এটিকেই ডেথ রেফারেন্স বা মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন বলা হয়। হাইকোর্টের রায়ের পর সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করতে পারেন।
ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসাবে পেপারবুক তৈরি করতে হয়, যেখানে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, সাক্ষীদের বক্তব্য, বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলার তথ্যাদি সন্নিবেশিত থাকে। বিচারিক আদালত যেহেতু চূড়ান্ত বিচার নয়, সেহেতু একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত
আসামিকে দীর্ঘদিন কনডেম সেলে রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে আগে থেকেই আইন বিশেষজ্ঞদের মাঝে প্রশ্ন ছিল।
জানা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ডেথ রেফারেন্স মামলার সংখ্যা বাড়ছেই। প্রতিবছর যতসংখ্যক ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে, এর অর্ধেকও নিষ্পত্তি হয় না। ফলে দিনদিন এর সংখ্যা বাড়ছেই। আবার আদালতের বার্ষিক ছুটি এবং বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ ভাঙার কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে ভাটা পড়ে যায়। ফলে একজন ফাঁসির আসামিকে হাইকোর্টে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বছরের পর বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। তাই আইন বিশেষজ্ঞরা বলে আসছিলেন, বেঞ্চ বাড়ানোর পাশাপাশি বিচারক নিয়োগ, ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তিতে কোনো রকম মুলতুবি না দিয়ে শুনানি অব্যাহত রাখতে হবে।
আমরা দেখছি, মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক নিরপরাধ আসামি বছরের পর বছর কারাগারের কনডেম সেলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কারা মহাপরিদর্শকের পক্ষে হাইকোর্টে দাখিল করা এক প্রতিবেদনেও জানা গেছে, দেশের কারাগারগুলোয় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ব্যক্তিদের জন্য থাকা ২ হাজার ৬৫৭টি সেলের মধ্যে বন্দি আছেন ২ হাজার ১৬২ জন।
আমরা মনে করি, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া দণ্ডিতকে কনডেম সেল বা নির্জন কারাকক্ষে রাখার বিষয়ে হাইকোর্টের এ রায় যুগোপযোগী ও যুগান্তকারী। একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির প্রতি মানবিক দিক বিবেচনায় অন্তত আপিল ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়ার পরই এ সেলে রাখা যেতে পারে বলে মনে করি আমরা। এর আগ পর্যন্ত তাদের জন্য কারাগারে বিশেষ ব্যবস্থায় অন্য আসামিদের সঙ্গে রাখা যেতে পারে।
সর্বোপরি কারাগারে আটক প্রত্যেক আসামির প্রতি মানবিকতা প্রদর্শনে কারা কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হবে, এটাই প্রত্যাশা।
বিআলো/শিলি