অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় হচ্ছে বিএনপি
এফ এইচ সবুজ: বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচনের আগে–পরে প্রচার ও অপপ্রচার সবসময়ই একটি বড় কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তারের কারণে অপপ্রচারের মাত্রা বেড়েছে বহুগুণে। বিএনপির নেতাকর্মীরা দাবি করছেন, যেকোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলেই অনলাইনে তাদের জড়িয়ে ভুয়া প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে মিথ্যা ভিডিও বানানো হচ্ছে, যা ভাইরাল হয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
বিএনপির অভিযোগ ও অবস্থান
বিএনপি নেতাদের মতে, হত্যা, হামলা, ধর্ষণ কিংবা চাঁদাবাজির মতো অপরাধ ঘটলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দলের নেতাকর্মীদের নাম ব্যবহার করে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তা কল্পিত বা সাজানো তথ্য–ভিডিও। উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি চট্টগ্রামে ভাইরাল হওয়া এক চিকিৎসকের ভিডিওর কথা উল্লেখ করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তার দাবি, চিকিৎসক নাকে রং লাগিয়ে লাইভে এসে বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছেন।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, অপপ্রচারের পাল্টা অপপ্রচার বিএনপির নীতি নয়। আমরা বিবৃতি, সংবাদ সম্মেলন, অফিসিয়াল পেজের মাধ্যমে জনগণের সামনে সত্য তথ্য তুলে ধরি।
কেন অপপ্রচারের সুযোগ পাচ্ছে প্রতিপক্ষ?
বিএনপির ভেতর থেকেই স্বীকার করা হচ্ছে, দলের কিছু নেতাকর্মীর অনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরো দলের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের সুযোগ তৈরি করছে। গোপালগঞ্জ–১ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ বলেন, গুটিকয়েক লোক চাঁদাবাজি–দখলবাজির সঙ্গে জড়িত। এতে দলের বিরুদ্ধে প্রচারণার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দল যদি আগে থেকে কঠোর অবস্থান নিত, হয়তো সুযোগটা আসত না।
অন্যদিকে সেলিমুজ্জামান সেলিমের মতে, অনেক সময় যাচাই–বাছাই না করেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যা পরে উল্টো দলের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।
বিএনপির কৌশলগত পদক্ষেপ
বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিএনপি সোশ্যাল মিডিয়ায় আরও সক্রিয় হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জন্য মিডিয়া সেল ও গবেষণা কেন্দ্র (BNRC)–এ দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ করা হচ্ছে। জেলা পর্যায়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে নেতাকর্মীরা সক্রিয়ভাবে অপপ্রচারের জবাব দিতে পারেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হালিম বলেন, অসহিষ্ণু রাজনীতির কারণে আমরা অতিমাত্রায় অপপ্রচারের শিকার হচ্ছি। তবে আমরা অপপ্রচারে বিশ্বাসী নই, বাস্তবচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
ভোলা–৪ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন স্বীকার করেন, অতীতে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিএনপির উপস্থিতি দুর্বল ছিল। তবে এখন নেতাকর্মীরা সচেতন হয়ে সঠিক তথ্য তুলে ধরছেন।
বিশ্লেষণ: অপপ্রচারের প্রভাব ও সীমাবদ্ধতা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অপপ্রচার নতুন কিছু নয়। তবে প্রযুক্তির উন্নয়ন, বিশেষ করে ফেসবুক-ইউটিউব-টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মের প্রসারের কারণে এর প্রভাব এখন অনেক বেশি।
প্রথমত, মিথ্যা তথ্য খুব দ্রুত ভাইরাল হয় এবং সাধারণ মানুষ যাচাই না করেই বিশ্বাস করতে শুরু করে।
দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে বিএনপির সংগঠন ও মিডিয়া নেটওয়ার্ক তুলনামূলক দুর্বল, যা প্রতিপক্ষকে সুবিধা দিচ্ছে।
তৃতীয়ত, দলের ভেতরের কিছু নেতাকর্মীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডও বিএনপির বিরুদ্ধে প্রচারণার যুক্তি তৈরি করছে।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, অপপ্রচারের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয় না যদি দল সঠিকভাবে তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরতে পারে। বিএনপির অনেক নেতার ভাষায়, জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আছে, তাই সময়ের সঙ্গে জনগণ সত্য-মিথ্যা আলাদা করতে পারে।
অপপ্রচার রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশ হলেও তা মোকাবিলার জন্য বিএনপি এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে জোর দিচ্ছে। মিডিয়া সেলকে শক্তিশালী করা, প্রযুক্তি সচেতন কর্মী নিয়োগ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় থাকার মাধ্যমে তারা পাল্টা অবস্থান নিতে চাইছে। তবে মূল চ্যালেঞ্জ হলো-মিথ্যাকে প্রতিহত করার পাশাপাশি দলের ভেতরের অনিয়ম-অসঙ্গতিও নিয়ন্ত্রণ করা। কারণ সত্যিই যদি কোনো নেতাকর্মী অপরাধে জড়িত থাকে, সেক্ষেত্রে অপপ্রচার আর বাস্তবতার মধ্যে সীমারেখা মুছে যায়।
অতএব, বিএনপির সামনে দ্বৈত কাজ-একদিকে অপপ্রচারের মোকাবিলা, অন্যদিকে দলের অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযান।
বিআলো/এফএইচএস