অভাবের তাড়নায় সন্তান বিক্রি: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক মায়ের হৃদয়বিদারক গল্প
নিহারেন্দু চক্রবর্তী, (ব্রাহ্মণবাড়িয়া): দারিদ্র্য যখন চরমে পৌঁছে যায়, তখন একজন মায়ের জন্য সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ কী হতে পারে? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে বসবাসকারী মারুফা আক্তার সেই প্রশ্নের এক নির্মম উত্তর হয়ে দাঁড়িয়েছেন—তিনি অভাবের তাড়নায় বিক্রি করেছেন তার দুই সন্তানকে। ৩৫ বছর বয়সী মারুফা একজন ভিক্ষুক। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করাই তার প্রতিদিনের রুটিন। তার স্বামী লালন মিয়া দিনমজুর—যখন যেভাবে কাজ মেলে, সেভাবেই জীবিকা চালাতে হয় তাকে। আট বছরের দাম্পত্য জীবনে এই দম্পতির ঘরে জন্ম হয়েছে সাত সন্তানের। কিন্তু তাদের নেই নিজের কোনো জমি বা ঘর। তাদের মাথার উপর ছায়া বলতে অন্যের বাড়ির আঙিনায় গড়ে তোলা একটি ছোট্ট ঝুপড়ি ঘর।
গত সেপ্টেম্বরে শেষবারের মতো সন্তান জন্ম দেন মারুফা। জন্মের মাত্র ১৫ দিন পর, অসুস্থ মা এবং চিকিৎসাহীন নবজাতকের মুখে খাবার তুলে দিতে না পেরে তারা সিদ্ধান্ত নেন—সন্তানটি বিক্রি করে দেবেন। বিনিময়ে তারা পান ৫০ হাজার টাকা। এর আগেও, আরেকটি সন্তান জন্মের কিছুদিন পর বিক্রি করেছিলেন ৪৫ হাজার টাকায়। সরাসরি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, মারুফা-লালনের পরিবার একেবারেই মানবেতর জীবন যাপন করছে। একটি ছোট ঘরে নেই কোনো আসবাবপত্র, নেই ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও। মাটিতে বসে লাউ সিদ্ধ দিয়ে ভাত খাচ্ছে পাঁচটি ছোট শিশু। দেখে বোঝা যায়, তারা বহুদিন ভালোভাবে খেতে পারেনি।
মারুফা বলেন, “আমাদের কেউ নাই। অভাবে পড়লেই লোকে গালি দেয়, লাথি দেয়। শিশুদের মুখে দুধ জোটে না। বিছানা নাই, মাটিতে ঘুমাই। পেটের ভেতরে আগুন জ্বলে, কিন্তু কিছুই করার নাই। এখন নিজের বাচ্চা বিক্রি করায় মানুষ কথা বলছে। কিন্তু যখন না খেয়ে থাকি, তখন তো কেউ খবর নেয় না।” দম্পতির এক আত্মীয়া, জাহানারা বেগম বলেন, “বিক্রি না করে উপায় ছিল না। ভিক্ষা করে খায়। কেউ খোঁজ নেয় না। ছোট বাচ্চাটা জন্ম থেকেই অসুস্থ ছিল। তার জন্যই বিক্রি করেছে।” লালন মিয়া বলেন,”বাচ্চা আর মায়ের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। না খেয়ে, বিনা চিকিৎসায় পোলাডা মরে যেত। তাই বিক্রি করে দিয়েছি। কাগজপত্র করেই দিয়েছি।
না হলে কেউ নিতে চায় না।” বুড়িশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইকবাল চৌধুরী বলেন,”বিষয়টি জানা ছিল না। তবে খোঁজ নিচ্ছি।” নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাকছুদ আহাম্মদ জানান,”আমি সদ্য এখানে যোগ দিয়েছি। বিষয়টি জানতাম না। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।” উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহীনা নাসরিন বলেন,”এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও এনজিওগুলোর সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ থাকলে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করা যেত। এরপরও, পরিবারটিকে সরকারি সহায়তা ও ঘর দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. হাফিজ উদ্দিন ভূইয়া বলেন,”দারিদ্র্য আগেও ছিল, এখনো আছে। কিন্তু পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক নিরাপত্তা এখন ভেঙে পড়ছে। এ ধরনের ঘটনা এখন ঘন ঘন ঘটছে। রাষ্ট্রের যেসব দপ্তর দায়িত্বে আছে, তারা যদি সঠিকভাবে কাজ করত, তাহলে এসব ঘটনা এড়ানো যেত।”
বিআলো/ইমরান