আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সব দাবি-দাওয়া সচিবালয় কেন্দ্রিক
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র :—নিরাপদ নয় সচিবালয়
✒️ ৯ দফা দাবিতে উত্তপ্ত সচিবালয়
সচিবালয়ের বুকে আন্দোলন ও অস্থিরতা
নিরাপত্তা বেষ্টনী’ ভেদ করে শিক্ষার্থীদের তাণ্ডব
রতন বালো: প্রশাসনের প্রাণ কেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয় নিরাপদ নয়। এই কথাটির অর্থ হলো প্রশাসনের কেন্দ্রস্থল বা গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিরাপদ নয়। এটি সম্ভবত প্রশাসনিক কার্যক্রম, কর্মকর্তা বা কর্মচারী, বা প্রশাসনিক এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগকে নির্দেশ করে। প্রশাসনের প্রাণ কেন্দ্র বলতে সাধারণত সচিবালয়, মন্ত্রণালয় বা প্রশাসনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয়গুলোকে বোঝায়। আর নিরাপদ নয় বলতে এই স্থানগুলোতে নিরাপত্তা বিষয়ক সমস্যা, যেমন-নিরাপত্তা শঙ্কা, বিশৃঙ্খলা বা কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকতে পারে। বর্তমানে সপ্তাহের দুই দিন সোমবার ও বুহস্পতিবার দর্শনার্থী প্রবেশে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা, বন্ধ পাস ইস্যু। কিন্তু এই দুই দিনও অন্যদিনের মতো দর্শনার্থীর কমতি থাকে না। বহিরাগতদের পদচারণায় বলতে গেলে গিজগিজ করে সচিবালয়ের সব স্থান। শুধু তাই নয় সচিবালয়ে ভিতরে গাড়ির জটলায় হেঁটে চলাচল করাও দুরুহ হয়ে পড়ে। অনেকে বলেছেন, এত গাড়ি কিভাবে সচিবালয়ের ভিতরে প্রবেশ করে।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো প্রশাসনিক ভবনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল থাকে বা সেখানে কোনো ধরনের হুমকি থাকে, তাহলে বলা যেতে পারে যে প্রশাসনের প্রাণ কেন্দ্র নিরাপদ নয়। এছাড়াও, যদি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে কাজের পরিবেশ নিয়ে অসন্তোষ থাকে বা তাদের মধ্যে কাজের চাপ বেশি থাকে, তাহলে এটিও “প্রশাসনের প্রাণ কেন্দ্র নিরাপদ নয়” এই ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে।
সচিবালয় নিরাপদ নয় বলেই গতকাল গেট ভেঙে সচিবালয়ে শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করে ভাঙচুর ও পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনা ঘঠেছে। শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষার্থী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গেট ভেঙে ও দেয়াল টপকে সচিবালয়ে প্রবেশ করেছেন। এ সময় পুলিশ ও সেনা সদস্য তাদেরকে ঠেকানোর চেষ্টা করলে সংঘর্ষ বাধে।
সচিবালয়ের ভিতরে প্রবেশ করে শত শত শিক্ষার্থী সামনে পাওয়া গাড়ি ভাঙচুর করেন। এছাড়া এলজিআরডি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনেও ভাঙচুর চালানো হয়। এ সময় সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল ছুড়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেরও চেষ্টা করেন।
এর আগে, দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের সামনে আসেন শিক্ষার্থীরা। সচিবালয়ে প্রবেশের এক নম্বর গেটের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। এতে গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে।
গত ২১ জুলাই দুপুরে মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে বিমানবাহিনীর ফাইটার জেট বিধ্বস্তের ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩১ এ দাঁড়িয়েছে। ওই ঘটনায় আহত হন দেড় শতাধিক। তাদের প্রায় ৭০ জন এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এই অবস্থার মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার চলমান এইচএসসি ও সমমানের কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। সরকারের পক্ষ থেকে রাতে জানানো হয়, মঙ্গলবারের পরীক্ষা স্থগিত।
বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, অনেক সমালোচনার পর পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত আসে গভীর রাতে। এই সিদ্ধান্ত আগে কেন নেয়া হলো না-এমন প্রশ্ন তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তারা। তাদের দাবি, গভীর রাতে এই সিদ্ধান্ত আসায় অনেক শিক্ষার্থী বিভ্রান্ত হয়েছে। তারা এই তথ্য জানতেই পারেনি। ফলে অনেকে আজ পরীক্ষাকেন্দ্রে চলে গেছে!
বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি. আর. আবরারের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে তার পদত্যাগ দাবি করছেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা যে ছয়টি দাবির কথা জানিয়েছেন সেগুলোও তুলে ধরছেন তারা।
এর আগে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে গোলচত্বরে সকাল ১০টা থেকে জমায়েত হন শত শত শিক্ষার্থী। মুহূর্তেই মিছিল আর প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে চারপাশ। একদিন আগে তাদের কলেজ ক্যাম্পসে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণহানি ও আহতের ঘটনায় শোকাহত শিক্ষার্থীরা ৬ দফা দাবি জানান তারা। এর মধ্যে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিদর্শনে যান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার। সেখানে তারা শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন।
“বিচার চাই না, সন্তানের লাশ চাই”, সঠিক লাশের হিসাব চাই এমন ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীরা গোলচত্বরে সড়কের ওপর বসে পড়েন। নিহতদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ, আহতদের নির্ভুল তালিকা, শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা, ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ ছয় দফা দাবি জানান তারা। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই একের পর এক দাবি সামাল দিতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। কোনো না কোনো দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটছে। সরকার পতনের পর ঘনীভূত হয় সচিবালয় কেন্দ্রিক।
সর্বশেষ নয় দফা দাবিতে সচিবালয়ে মহাসমাবেশের ডাক দেয় ‘বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ’। প্রশাসনের প্রাণ কেন্দ্রে এ ধরনের কর্মসূচির ডাক দেওয়ায় এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে সরকারের উচ্চ মহলে। এমনকি এ বিষয়ে বেশির ভাগ কর্মকর্তাই কোনো কথা বলতে চাইছেন না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, সরকার পরিবর্তনের পর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নানা দাবি নিয়ে সরকার চাপের ভেতরে রয়েছে। এর মধ্যে নয় দফা নিয়ে বাড়াবাড়ি হোক, সেটা এ মুহূর্তে কেউই চাচ্ছেন না। এরই মধ্যে বিষয়টি সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ আন্দোলনে নামে গত ১৯ আগস্ট। ওইদিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে নয় দফা দাবি জানায় পরিষদ। তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছেও দাবি তুলে ধরেন। এরপর আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে নয় দফা দাবি পেশ করা হয়। এছাড়া ৩০ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠান তারা।
এরপর দাবি আদায়ে গত ৩১ অক্টোবর সকাল থেকে সচিবালয়ের ভেতরে নয় দফা দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে সংযুক্ত পরিষদ। ওইদিন উপস্থিত একাধিক কর্মচারী জানান, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য চাপ সৃষ্টি করতেই মূলত তারা কর্মসূচি পালন করছেন। সেদিনের কর্মসূচি ঘিরে সচিবালয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। বন্ধ রাখা হয় সচিবালয়ে প্রবেশের সব পথ। কিন্তু পরদিনও একই ধরনের কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি মহাসমাবেশের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ বলেন, বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দেখছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে তারাই বলতে পারবে। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো তিনি কোন সাড়া দেন না।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম সচিব বলেন, গত ৪ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশ ঘিরে সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। এছাড়া দাবি-দাওয়া নিয়ে মন্ত্রণালয় এক ধরনের দ্বিধার মধ্যে রয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব-উল-আলম বলেন, আমি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের দাবিদাওয়া সম্পর্কে অবগত নই। বিস্তারিত জানার পর এ বিষয়ে বলতে পারব।
এরপর জেলা প্রশাসক নিয়োগকে কেন্দ্র করে গত ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা করেন উপসচিব মর্যাদার কর্মকর্তারা। সেদিনের ঘটনায় বিশৃঙ্খলার দায়ে ১৭ জনকে চিহ্নিত করেছে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের নয় দফার মধ্যে রয়েছে সচিবালয়ে কর্মরত নন-ক্যাডার ফিডার পদধারীদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন ক্যাটাগরির পদ সংরক্ষণ, পদের নাম পরিবর্তন, নতুন পে-কমিশন গঠন, ৫০ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতা, ১০০ ভাগ পেনশন ও ৪০০ ভাগ গ্র্যাচুইটি সুবিধা প্রদান, বিদ্যমান ২০টি গ্রেডের পরিবর্তে ১০টি গ্রেড প্রবর্তন, সচিবালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির পদের নাম পরিবর্তন করে যৌক্তিক নাম প্রদান, বিগত সরকারের আমলে চাকরিচ্যুত, সাময়িক বরখাস্ত, বরখাস্ত ও অন্যায়ভাবে বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্তদের মতো পাওনা পরিশোধ।
বিআলো/তুরাগ