আজানের কণ্ঠে আলো, জীবনে অন্ধকার ন্যায্য বেতন থেকে বঞ্চিত লাখো ইমাম–মুয়াজ্জিন
মো.তরিকুল ইসলাম (মোস্তফা),বাউফল (পটুয়াখালী): প্রতিদিন ভোরে আকাশে ভেসে ওঠে পবিত্র আজানের ধ্বনি— “আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম”। এই আহ্বানে জেগে ওঠে মানুষ, শুরু হয় দিনের কর্মব্যস্ততা। অথচ যাঁদের কণ্ঠে আজান উচ্চারিত হয়— সেই ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জীবন জড়িয়ে আছে দারিদ্র্য, অবহেলা ও অনিশ্চয়তায়।
বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মসজিদে দায়িত্ব পালন করেন প্রায় ১৭ লাখ ইমাম ও মুয়াজ্জিন। তাঁদের মাসিক আয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাত্র ৪ থেকে ৮ হাজার টাকা— যা দিয়ে পরিবার চালানোই অসম্ভব। নির্দিষ্ট জাতীয় পে–স্কেল না থাকায় তাঁদের পেশা নির্ভর করে স্থানীয় মসজিদ কমিটির সদিচ্ছার ওপর।
“মানুষকে নামাজ পড়াই— অথচ নিজের সন্তানের ফি দিতেই হিমশিম”
বাউফল পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আল হিকমা জামে মসজিদের খতিব ও বাউফল ইমাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আইউব বিন মুসা বলেন,
“সরকারি বা বেসরকারি কোনো নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো না থাকায় ইমাম–মুয়াজ্জিনদের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আন্দোলন করার সুযোগও নেই। কারণ তারা নামাজ পড়ানো বা আজান বন্ধ করলে সমাজই তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে।”
“এক কথায় চাকরি হারাতে হয়”— ইমাম নজরুল ইসলাম
বাউফল সাব–রেজিস্ট্রি জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা নজরুল ইসলাম জানান, ২৫ বছর ইমামতি করেও বাস্তবতা এখনো ভয়াবহ। গ্রামে অনেক ইমাম–মুয়াজ্জিন মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় কাজ করেন।
তিনি বলেন,
“খুতবায় একটি মন্তব্য পছন্দ না হওয়ায় আমাকে একদিনেই চাকরিচ্যুত করা হয়। কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগও পাইনি।”
বেতন বৈষম্য রাজনৈতিক–সামাজিক ব্যর্থতা
বাউফল উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং স্থানীয় একটি মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্য বলেন,
“উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন মালিও সরকারি গ্রেডভুক্ত বেতন পান। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও ইমাম–মুয়াজ্জিনদের জন্য দেশব্যাপী কোনো বেতন কাঠামো হয়নি— এটি চরম ব্যর্থতা।”
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন,
“মসজিদে টাইলস লাগাতে আমরা আগ্রহী, ঝাড়বাতি–এসি দিতে উদার— কিন্তু ইমাম–মুয়াজ্জিনের বেতনের ক্ষেত্রে নীরব। একটি খেলার দলের অনুদানে যেমন সাড়া দেই, ধর্মীয় নেতৃত্বে তা করি না— যা সমাজের সংকীর্ণ মানসিকতা নির্দেশ করে।”
“চা–পানির খরচের টাকাও বেতন হয় না”— জেলা ইমাম পরিষদ
পটুয়াখালী জেলা ইমাম পরিষদের সভাপতি মাওলানা আবু সাঈদ বলেন,
“অনেক মসজিদের সভাপতির বাসায় মাসে চা–পানির খরচ যেটুকু হয়— ইমাম বা মুয়াজ্জিনের বেতন তারও সমান নয়। এই অবস্থায় দায়িত্বশীলভাবে আমল করা কঠিন।”
তিনি আরও বলেন, ঢাকায় কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব না থাকায় বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, চাকরির স্থায়িত্ব বা কল্যাণনীতি— কোনো দাবিই শক্তভাবে সরকারের কাছে তোলা যায় না।
“২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব— সুবিধা নেই”
বরিশাল মহানগর জাতীয় ইমাম সমিতির সভাপতি মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী বলেন,
“আমরা ২৪ ঘণ্টা মসজিদের দায়িত্ব পালন করি, কিন্তু সুবিধা ও বেতন অপ্রতুল। মসজিদ কমিটি ও মুসল্লিদের মানসিকতারও পরিবর্তন প্রয়োজন। ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন চাইলে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব।”
ঢাকার মসজিদ পরিচালনা কমিটির অবস্থান
ঢাকা উত্তর যাত্রাবাড়ী জামে মসজিদের সভাপতি নূর মোহাম্মদ বলেন,
“আমরা ইমামকে ১২,৫০০ টাকা, মুয়াজ্জিনকে ৯,৫০০ টাকা দিই— যা আসলে খুবই কম। দেশের বিভিন্ন সেক্টরে সরকার সাবসিডি দেয়, তাহলে ধর্মীয় নেতৃত্বে কেন নয়?”
বাস্তব চিত্র
-
দেশে মসজিদ : ৩.৫ লাখ
-
ইমাম–মুয়াজ্জিন : ১৭ লাখ
-
গ্রামে গড় বেতন : ৪–৭ হাজার টাকা
-
শহরে গড় বেতন : ৮–১০ হাজার টাকা
-
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কল্যাণ সহায়তা পান : ১,২০০–১,৫০০ জন
-
জাতীয় পে–স্কেল : এখনো নেই
সমাজের আত্মিক অবক্ষয়
আজানের ধ্বনি মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান জানায়। কিন্তু সেই আহ্বানকারীরা যদি ক্ষুধা–সংকটে অবহেলিত হন, তবে তা শুধু একটি পেশার অবমূল্যায়ন নয়— বরং সমাজের আত্মিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি।
মসজিদের মিনার যেন নীরবে স্মরণ করিয়ে দেয়—
“ইমাম–মুয়াজ্জিনদের মর্যাদা ফিরিয়ে দাও, নইলে সমাজই নীরবে ভেঙে পড়বে।”
- বিআলো/ইমরান



