ইলিশের পথ রুখছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রাস্তায় নামলো নাগরিক সমাজ
কয়লা দূষণ রুখে দাঁড়ালো নাগরিক সমাজ: সুন্দরবন, ইলিশ ও লবণ রক্ষায় ঢাকায় প্রতীকী প্রতিবাদ
নিজস্ব প্রতিবেদক: পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু বিপর্যয়, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সঙ্কটের অন্যতম প্রধান কারণ হলো কয়লার ব্যবহার। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখনো বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চলছে। এ প্রেক্ষাপটে কয়লা থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির রূপরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দাবিতে মঙ্গলবার সকালে ঢাকার শ্যামলী পার্ক মাঠে অনুষ্ঠিত হলো এক প্রতীকী প্রতিবাদ সমাবেশ।
এশিয়া এনার্জি নেটওয়ার্ক এবং এশিয়ান পিপলস মুভমেন্ট অন ডেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের বৈশ্বিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই কর্মসূচি আয়োজন করে দেশের ২০টি সংগঠন। এর মধ্যে ছিল—ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন, ব্রাইটার্স, ক্যাপস, ক্লাইমেট ফ্রন্টিয়ার, সিপিআরডি, ইআরডিএ, ইক্যুইটি বিডি, জিএলটিএস, খাসিয়া স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, মিশন গ্রিন বাংলাদেশ, ওএবি ফাউন্ডেশন, রিভার বাংলা, রিভারাইন পিপল, সচেতন ফাউন্ডেশন, সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন, ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ, ইয়ুথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন, ইয়ং ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক এবং 350.org। একযোগে এশিয়ার ছয়টি দেশের সত্তরটি স্থানে একই দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর সহ আহবায়ক এম এস সিদ্দিকী এবং সঞ্চালনা করেন রিভার বাংলার সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ। প্রধান বক্তা ছিলেন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর সদস্য সচিব শরীফ জামিল। তিনি বলেন, শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নয়, কোনো কারণেই সুন্দরবন, ইলিশ ও লবণের মতো অমূল্য সম্পদ ধ্বংসকে সমর্থন করা যায় না। সুন্দরবন না থাকলে দক্ষিণ বাংলা বিপন্ন হবে, তাই রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করতে হবে।
বক্তারা আরও বলেন, তালতলির বরিশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কলাপাড়ার পটুয়াখালী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ইলিশের চলাচলের পথে বাধা সৃষ্টি করছে, যা জাতীয় সম্পদ ধ্বংসের শামিল। অন্যদিকে বাঁশখালি ও মাতারবাড়ির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং তৎসংলগ্ন শিল্পায়নের কারণে লবণ উৎপাদন চরম সংকটে পড়েছে। অথচ মাছে ভাতে বাঙালির ঘরে লবণ ছাড়া একদিনও চলে না। তাই এসব প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ এখন জরুরি।
কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি এসএম বদরুল আলম বলেন, কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসতে বিশ্বের অনেক দেশ সফল হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো এর ব্যবহার বেড়েই চলছে। তিনি সঠিক পথনকশা প্রণয়নের আহ্বান জানান।
রিভারাইন পিপলের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, যাদের হাতে কয়লা প্রকল্প বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে, তারা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। বরং এখনো নতুন নতুন প্রকল্প অনুমোদন করা হচ্ছে। আমরা চাই, অবিলম্বে কয়লা প্রকল্পগুলো বন্ধ হোক।
ইআরডিএর নির্বাহী পরিচালক মনির হোসেন চৌধুরী বলেন, আমাদেরকে অবশ্যই কয়লা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এতদিন অনেকেই সোচ্চার ছিলেন, কিন্তু এখন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, সুন্দরবন আমাদের উপকূলের রক্ষাকর্তা। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নদী দূষণ করছে, পরিবেশ নষ্ট করছে, ইলিশের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। উপকূলবর্তী সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে দূষণের কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমছে। তিনি সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ আশা করেন।
বক্তারা বলেন, রামপাল, পায়রা ও মাতারবাড়ি—এই তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ হাব ইতোমধ্যেই ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। রামপালের কারণে পশুর নদী ও সুন্দরবন বিপন্ন, পায়রার কারণে ইলিশ ও তরমুজ উৎপাদনে ধ্বস নেমেছে এবং মাতারবাড়ির কারণে লবণ ও পান চাষ মারাত্মক সংকটে পড়েছে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষক-জেলেদের জীবন-জীবিকা এবং জনস্বাস্থ্য বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে।
সমাবেশ থেকে সার্বিক বার্তা ছিল স্পষ্ট—বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রক্ষায় অবিলম্বে কয়লা থেকে সরে গিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে অগ্রসর হতে হবে।
বিআলো/তুরাগ