ঈদের ছুটি শেষ, রুজির টানে কর্মস্থলে ফিরছে মানুষ; গুণতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া
রতন বালো: সরকার থেকে বারবার অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে সতর্কবানী উচ্চারণ করা হলেও তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে সবধরনের পরিবহন-মালিক শ্রমিক জোট। বাস থেকে শুরু করে থ্রিহুইলার রিকসা সর্বত্র এই নৈরাজ্য সমানে চলছে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে সেখানে দুই থেকে তিনগুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। অতিরিক্ত ভাড়ায় চ্যাপ্টা হচ্ছেন সাধারণ যাত্রী। বেশি ভাড়া না দিতে চেয়ে যাত্রী হয়রানির ঘটনাও ঘটছে। তারপরেও ভাড়া নৈরাজ্য থামছে না যেমনটি বলছিলেন গাবতলী থেকে লালবাগের বাসায় ফেরা টুটুল আহমেদ। তিনি আড়াইশো টাকার সিএনজি সাড়ে ৫শ টাকা ভাড়া দিতে বাধ্য হয়েছেন। তারপরেও রুজির নিশ্চয়তায় বাড়তি ভাড়া গুণে কর্মস্থলে ফিরতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
মো. বাদল মিয়া। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার পিপুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় কাঠ ব্যবসায়ী। থাকেন পুরোনো ঢাকার নয়াবাজারে। গত ৬ জুন ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যান। গাবতলী থেকে হরিরামপুরে শুকতারা সার্ভিসে ( গেটলক গাড়ী) যেতে হয়। প্রতিনিয়ত ভাড়া নেয়া হয় ১০০ টাকা। আর ঈদের নামে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েছেন ডাবলেরও অধিক। টিকিটে লেখা ১০০ টাকা । নেয়া হচ্ছে ২০০ টাকা। ঈদের দুই দিন পরে অর্থাৎ গত ৮ জুন অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ঢাকা ফেরত আসতে হয়।
রাজধানীতে ফেরত আসার সময় তার কাছ থেকে (মো. বাদল) ভাড়া নেয় ২২০ টাকা। অর্থাৎ প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে ডাবলেরও অধিক। এ বিষয়ে তিনি বলেন, গাবতলী বাস টার্মিনালে শুকতারা সার্ভিস ছাড়ার স্থানের পূর্ব দিকে সরকার বসিয়েছে পুলিশ কন্টোল অফিস ও সেনাবাহিনী কিছুই করছেন না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ঈদের আগে দফায় দফায় বলেছিলেন এবারে ঈদে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হলে আইনের আওতায় আনা হবে।
কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত কতগুলো পরিবহন মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বা আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এর কোন তথ্য উপাত্ত মেলেনি। ভাড়ার নৈরাজ্য নিয়ে পুলিশকে বললে তারা উল্টো অভিযোগকারীকে দায়ী করেন।
পুলিশ বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে আপনারা যান কেন? পুলিশের কথার উপর গাড়ীর চালক সুপারভাইসারকে বলা হলে তারা (গাড়ীর লোক) বলেন, ২০০ টাকায় গেলে যাবেন, নইলে আমরা যাবনা।
এ ধরনের কথায় কয়েকজন যাত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে গাড়ীর চালক সুপার ভাইজারের সঙ্গে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার ব্যাপারে প্রতিবাদ করেন। এ নিয়ে বাকবিতন্ডা পর্যন্ত হয়। কিন্তু নিরাপদ দুরুত্বে দাঁড়িয়ে পুলিশ কেবলই মজা নেয়। তারা কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নিয়ে নিজেদের ভিতরে খোশগল্প আলাপ চালিয়ে যান।
যাত্রী ডুবল মন্ডল, সুবোধ সরকার, মোশাররফ হোসেন গ্রামের বাড়ী হরিরামপুর উপজেলার সুলতানপুর তারা তাদের তিক্ক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, আইন কেবলই পাতায় লেখা থাকে বাস্তবে তার কোন প্রয়োগ নেই। অতীতেও যেমনটি ছিল বর্তমানেও তেমনটিই আছে। কেবল লোকবল বদলেছে আর বদলেছে পরিচয়। ল্যাঞ্ছিত যাত্রীরা ঈদের ছুটি শেষে গত সোমবার ঢাকায় ফেরার সময় এমন লুটপাটের মুখে পড়েন।
তারা জানান, বালিরটেক কালিগঙ্গা সেতুর পশ্চিম পাশ থেকে ঐ শুকতারা সার্ভিসে উঠেন আর সেখান থেকে ভাড়া ১০০ টাকা। কিন্তু তাদের কাছ থেকে আদায় করা ১৫০ টাকা করে। এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যেয়ে তাদের ল্যাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। এসময় গাড়ির চালক ও সহকারীরা মারমুখো হয়ে ওঠে। তাদের এক কথা এই ভাড়ায় দিতে হবে কোন কম হবে না। অতিরিক্তি ভাড়া নিয়ে গাড়ীর কন্ট্রাকটর ও হেলপারের সঙ্গে প্রথমে কথা কাটাকাটি শেষ পর্যায়ে হাতাহাতি পর্যন্তও হয়। গাবতলী এসে ঐ পুলিশ কন্টোলকে জানানো হয়। কিন্তু পুলিশ কিছুই না করে উল্টো যাত্রীদের বলে আপনারা কেন বেশি ভাড়া দেন? যাত্রী সুরক্ষার বিষয়টি সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে বললেও তাদের কথাযে কতটা গা বাঁচানো তা পুলিশের এই ভুমিকা থেকে স্পষ্ট।
এই নৈরাজ্য কেবল গাবতলী হরিরামপুর বাস সার্ভিস নয়। পুরো আন্ত: জেলা বাস সার্ভিসগুলোতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে ঢাকা-পাটুরিয়া, ঢাকা-গাজীপুর, ঢাকা- টাংগাইল, ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা-নরসিংদিসহ বিভিন্ন আন্ত:জেলাগুলোতে চলাচলরত গণপরিবহনে ঈদে ঘরমুখি হতে এবং ঢাকায় ফেরত আসতে অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হচ্ছে কর্মজীবীদের। কেবল ভাড়া বেশি নয় যানজটে নাকাল হতে হচ্ছে বাড়ি ফেরত মানুষগুলোর। সবমিলে অতিরিক্ত ভাড়াসহ নানা দুর্ভোগ শিকার ভোগ করেই ঈদের ছুটি শেষে রাজধানীতে ফিরছে কর্মজীবী মানুষ।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, ছুটি শেষে আবারও তারা কর্মস্থলে ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছেন। এ কারণে দেশের সড়ক-মহাসড়ক, নৌ-বন্দরসহ অন্যান্য টার্মিনালে রাজধানীমুখী মানুষের চাপ বেড়েছে। ফেরি ঘাটগুলোতেও দেখা গেছে যানবাহনের দীর্ঘ লাইন। সিট বাদে মোড়া দিয়ে গাদাগাদি করে যাত্রী বহন করা হচ্ছে। একবই যাত্রীদের কাছ থেকে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় আশরাফুল নামের কুমিল্লার একযাত্রী বলেন, ঢাকা-কুমিল্লার ভাড়া ছিল ২২০-২৫০ টাকা। সেই ভাড়া এখন ৩০০ থেকে সাড়ে তিনশটাকা।
সিটিং বাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়ার কথা না। তার পরেও অতিরিক্ত যাত্রী দাঁড়িয়ে নেয়া হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে চালক পরিচালকেদের কাছে অপমানিত হতে হচ্ছে। তাদের কথা আপনি একা যাবেন নাকি? এসময় বলা হচ্ছে,আমরা ইচ্ছেমত যাত্রী তুলবো যাত্রী যত উঠবে ততই আমরা তুলবো। এসময় প্রশাসনের কথা বললে বলা হচ্ছে যান প্রশাসনের কাছে যান আমাদের নামে যতখুশি অভিযোগ দেন। আমাদের কিচ্ছুটি করতে পারবেন না।
আবার দুরপাল্লার গাড়ি ছাড়াও রিকশা অটো. সিএনজি ইচ্ছেমত ভাড়া আদায় করছে। এসময় তারা বেশ দাপটের সঙ্গে বলছে, জন্মের পর থেকে কোন দিন সিএনজি মিটারে যায়নি আজ যাবে ভাবলেন কী করে? এমন দাম্ভিকতা দেখিয়ে যাত্রীদের পকেট কাটছে তারা। অনেকেই আবার বাড়তি ভাড়াকে ঈদের বকশিস বলে চালিয়ে দিচ্ছে। প্রতিবাদ করলে বলা হচ্ছে রাস্তায় আমরা নেমেছি তাইতো আপনারা গন্তব্যে যেতে পারছেন এখন আবার বেশি কথা কেন বলছেন? খুলনা থেকে এসেছেন সিদ্দিক নামের এক গার্মেন্টস শ্রমিক। সেই সিদ্দিক তার দুভার্গের বয়ান এভাবেই দিলেন…
আজ মঙ্গলবার থেকে বেসরকারি অফিস খুলেছে। ঈদের পরে তাদের কোন ছুটি নেই নাই। তবে সরকারি ছুটি এখনোও ৪ দিন রয়েছে। অর্থাৎ আগামী ১৫ জুন থেকে সরকারি অফিস শুরু হবে। তাই আজ ঢাকায় আসলাম। পরিবারের অন্যদের বাড়িতে রেখে এসেছি। আরও কয়েকদিন বেড়াবে। এরপর আসবে। কারণ এখন এলে যাত্রীদের যে চাপ তাতে দুর্ভোগের পাশাপাশি করোনা সংক্রমণ ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কাছে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ গণপরিবহন মালিক বলেন, আমরা সব পরিবহন মালিকদের বলে দিয়েছি কোথাও স্বাস্থ্য বিধিলঙ্ঘন করে পরিবহনে অতিরিক্ত যাত্রী ও অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া যাবে না। তারপরও কেউ যদি এই নির্দেশ অমান্য করে তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোন ধরনের পদক্ষেপ নেবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নিশ্চুপ থাকেন। ভাড়া বেশি নেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ তিনি সরাসরি প্রতাখ্যান করেন।
এদিকে যানজট বিষয়ে তিনি বলেন, ঈদে যাত্রীদের চাপ কিছুটা বেড়েছে। ফেরি ঘাটগুলোতে ভিড় থাকার কারণে জট লেগে যাচ্ছে। তবে তিনি বলেন অন্য সময়ের চেয়ে এবার রাস্তায় যানজট বেশ কমই বলতে পারেন।
এদিকে নৌ-পথের যাত্রীদের দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকায় ফেরা অধিকাংশ লঞ্চেই ছিল কর্মজীবী মানুষের ভিড়। লঞ্চের ডেক থেকে শুরু করে কেবিন এমনকি কেবিনের সামনের গলিপথেও মানুষের ভিড় দেখা গেছে। টার্মিনালের প্রতিটি পন্টুনে ছিল যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়।
সানাউল্লাহ নামের বরিশালের এক যাত্রী বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মরার ভয় নেই। আল্লাহ যেদিন মৃত্যু লেখে রেখেছেন সেদিন মারা যাব। গতকাল থেকে বেসরকারি অফিস খুলেছে। একদিন ছুটি বেশি নেই নাই। তাই বাধ্য হয়েই আজ (মঙ্গলবার) ঢাকায় এলাম। লঞ্চ যাত্রীদের চাপ বেশি। লঞ্চে পা রাখার জায়গা নেই। কোনভাবে ডেকের এককোণে একটু বিছানা করে নিয়েছি। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। মানুষের চেঁচামেচি আর প্রচন্ড ভিড় দেখে মনে ভয় পালিয়েছে।
দ্বীপজেলা ভোলা থেকে ঢাকায় আসা আক্তার হোসেন নামের এক যাত্রী বলেন, গত সোমবার সাড়ে ১২টার দিকে লঞ্চ ছাড়ার পর মনপুরা ও ভোলার কয়েকটি ঘাট থেকে যাত্রী নেয়ার পরপরই পুরো লঞ্চ ভর্তি হয়ে যায়। মানুষের ভিড়ে কোথাও কোন জায়গা ফাঁকা ছিল না। অনেক কষ্ট করে ঢাকায় এসেছি।
বিআলো/তুরাগ