কমছে কৃষিজমি: কৃষিজমি রক্ষা করতে নীতি প্রণয়নের কাজ করছে সরকার: কৃষি সচিব
অ্যাসিডের কবলে দেশের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ জমি: প্রস্তাবিত কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের খসড়া প্রস্তুত
অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন, বসতি ও কল-কারখানা: ইটভাটা তৈরি এবং কৃষি জমি আইন না মানা
রতন বালো: গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ফসলি বা প্রকৃত আবাদি জমির পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমছে। এতে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে এভাবে কৃষিজমি কমতে থাকলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। দেশকে আরো আমদানি নির্ভরতার দিকে ঠেলে দিবে। বিশেষজ্ঞরা এখনই এ বিষয়ে সরকারকে প্রয়োজন পদক্ষেপ নেবার পরামর্শ দিয়েছেন।
এদিকে বহুবিধ কারণে দেশের কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। কেবল হ্রাস পাচ্ছেই না উল্টো উৎপাদনেও মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার, সেই সঙ্গে নিরীক্ষা ছাড়াই কীটনাশক ব্যবহার এসবই উৎপাদনের বিপরীতে যাচ্ছে। যদিও অধিক উৎপাদন আর বেশি ফসল ঘরে তোলার লক্ষ্যে এই ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু সেটি হীতে বিপরীত হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসিডের প্রভাব। দেশের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ জমি এখন অ্যাসিডের কবলে ।
এ বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশে আবাদি জমি ১৯.৮৩ লাখ একরে নেমে এসেছে, যা আগে ছিল ২০.৮৩ লাখ একর। অর্থাৎ মাত্র তিন বছরে আবাদি জমি কমেছে ১ শতাংশ, যা গত এক দশকে সর্বোচ্চ হ্রাসের ঘটনা। নতুন আবাসন, রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের কারণে ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে।
বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২৪’ শীর্ষক বিবিএসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে দেশের ২ শতাংশ কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। বিবিএস বলেছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। অকৃষি খাতে জমি চলে যাওয়া বন্ধ করতে না পারলে সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
কথা হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম এ সাত্তার মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি বলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আবাদি জমি কমছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ ও শহুরে বসতি বাড়ছে। এমনকি ফসলি জমির মাঝখানেও বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ মি. মণ্ডল সতর্ক করে বলেন, শিল্পায়নের কারণে কৃষিজমি আরো কমবে। তার মতে, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। তবে আমাদের মতো দেশে বড় জায়গা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মতো বিষয়গুলোকে উৎসাহিত করা উচিত নয়।
তিনি এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ১০০ একর জমি বরাদ্দের উদাহরণ দিয়ে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক কম জায়গায় তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) ‘রাইস ভিশন ফর বাংলাদেশ: ২০৫০ অ্যান্ড বিয়ন্ড’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালে দেশের জনসংখ্যা হবে ২১ কোটি ৫৪ লাখ। তখন প্রতি বছর ৪ কোটি ৪৬ লাখ টন চালের প্রয়োজন হবে।
গবেষণায় বলা হয়, ধান চাষের জমির পরিমাণ না কমলেই কেবল এই চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে প্রায় ৪ কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শাহিদুর রশিদ ভূঁইয়া বলেন, এটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। জনসংখ্যা বাড়ছে, অথচ খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিজমি সংকুচিত হচ্ছে। অথচ আমরা দেখছি ধানের জমি কমে যাচ্ছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, কেন আমরা গ্রামীণ এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করতে পারছি না? উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, বোরো ধানের ফলনের ক্ষেত্রে আমরা ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে আছি। আমাদের প্রয়োজনীয় সব খাদ্য নিজেদের উৎপাদন করা হয়তো সম্ভব হবে না। তাই উচ্চ পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে আমাদের কৃষিব্যবস্থাকে নতুন করে সাজাতে হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষিজমি রক্ষা করতে একটি নীতি প্রণয়নের কাজ করছে। ইতিমধ্যে এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় এই নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটি ফসল জোনিং ম্যাপ (শস্য বিন্যাস মানচিত্র) তৈরি করবে বলেও জানান তিনি। সচিব আরো বলেন, সারা দেশের জন্য একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। অন্যথায় কৃষিজমি রক্ষা করা অসম্ভব হবে। সরকারি প্রকল্পের পাশাপাশি রিসোর্ট এবং আবাসিক কমপ্লেক্সের মতো ব্যক্তিগত উদ্যোগেও কৃষিজমি ব্যবহৃত হচ্ছে, যা বন্ধ করতে হবে।
অপরিকল্পিত শিল্পায়ন : নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় দিন দিন কমতে শুরু করেছে আবাদি জমির পরিমাণ। আবাদি জমির মধ্যে নির্মাণ করা হচ্ছে ইটভাটা, রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি, শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। যার ফলে কৃষি পণ্য উৎপাদনে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ব্যাপক খাদ্য সংকটে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা করছে উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর।
উপজেলা কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য মতে, উপজেলায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছয় হাজার দুইশ ৮৩ হেক্টর। এর মধ্যে এক ফসলি জমির পরিমাণ দুই হাজার দুইশ ১২ হেক্টর, দুই ফসলি জমির পরিমাণ তিন হাজার তিনশ ১৫ হেক্টর ও তিন ফসলি জমির পরিমাণ ৫৭০ হেক্টর। উপজেলায় মোট কৃষি পরিবার রয়েছে ২৩ হাজার দুইশ ৫৯টি। এর মধ্যে ভূমিহীন চার হাজার ৯৪৩টি, প্রান্তিক ১৪ হাজার ৫৪০টি , ক্ষুদ্র দুই হাজার ৩০৯টি, মাঝারি এক হাজার ৩৮৬টি ও বড় ৮১টি কৃষি পরিবার রয়েছে।
উপজেলার জনসংখ্যা মতে মোট খাদ্য শস্যের চাহিদা গড়ে ৩৩ হাজার ৮৩৫ মেট্রিক টন, কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ২৪ হাজার ৮৮২ মেট্রিক টন খাদ্য। যার ফলে প্রতিবছর খাদ্য ঘাটতি দেখা দিচ্ছে আট হাজার ৯৫৩ মেট্রিক টন খাদ্য শস্য।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন, বসতি ও কল-কারখানা, ইটভাটা তৈরি এবং কৃষি জমি আইন না মেনে কৃষি জমি ভরাট হচ্ছে। সে সঙ্গে বাড়ছে ইচ্ছে মত জমির ব্যবহার। ফলে গত ১০ বছরে কৃষি জমির পরিমাণ কমেছে ১০ শতাংশ। এতে করে দিনেদিনে কৃষকরা কৃষিকাজ ছেড়ে বিচ্ছিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। প্রস্তাবিত কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে কৃষি জমিতে আবাসন, শিল্প কারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো রকম অকৃষি স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। জমি যে ধরনেরই হোক না কেনো তা কৃষি জমি হিসেবেই ব্যবহার করতে হবে। অথচ নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে উপজেলার বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও মালিকরা তাদের ব্যবসার সুবিধার জন্য প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠানের সীমানা বাড়ানোসহ কম মূল্যে গ্রামের কৃষি জমিগুলো দখলে নিচ্ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন জমি কমার মূল কারণ। দ্রুত কৃষি জমি রক্ষায় সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ না করলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। উপজেলা কৃষি অফিসার আবু নাদির সিদ্দিকী জানান, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত অপরিকল্পিত ভাবে কৃষি জমিতে বাড়িঘর নির্মাণ হচ্ছে। এছাড়া কৃষি জমি কম মূল্যে পাওয়ায় জমিতে ইটভাটা তৈরিসহ বিভিন্ন অকৃষি স্থাপনার জন্য প্রতিবছর এক হেক্টর করে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে বাড়ি নির্মাণ না করে গ্রামগুলোকে ছোট ছোট শহরে পরিণত করতে হবে। বহুতল ভবনে একাধিক পরিবারের আবাসনের ব্যবস্থা করা জরুরি। এছাড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো কৃষি জমি কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে দেশে চরম খাদ্য সংকট দেখা দিবে। যার ফলে চড়া দামে বাইরের দেশগুলো থেকে খাদ্য আমদানি করতে হবে।তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যে কৃষিজমির পরিমাণ বাড়াতে বসতবাড়ির আঙ্গিনায় সবজির আবাদ করতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বহুতল ভবনের ছাদেও কৃষি আবাদের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বিআলো/এফএইচএস



