গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান তারেক রহমানের
জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ যথেষ্ট শক্তিশালী : মির্জা ফখরুল
দ্রুত নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনুন : আমির খসরু
কূটনৈতিক প্রতিবেদক: দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, যদি ঐক্যবদ্ধ না হই, আগামী দিনে গুপ্ত স্বৈরাচারের আবির্ভাব হতে পারে। আজ শনিবার বিকেলে কুমিল্লা টাউনহল মাঠে জেলা দক্ষিণ বিএনপির সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ভার্চুয়ালি এ কথা বলেন তিনি। ১৬ বছর পর এদিন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
তারেক রহমান বলেন, আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ না হই, আমরা গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ না হই, ২০০৮ সালের তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে, ওয়ান-ইলেভেনের মাধ্যমে যেভাবে স্বৈরাচার জেঁকে বসেছিল, যদি ঐক্যবদ্ধ না হই, আগামী দিনে গুপ্ত স্বৈরাচারের আবির্ভাব হতে পারে। জনগণ যেভাবে চায়, আমাদের সেভাবে চলতে হবে। একটি কথা, সবার আগে বাংলাদেশ। এটিই আমাদের শুরু, এটাই আমাদের শেষ, সবার আগে বাংলাদেশ।
জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ যথেষ্ট শক্তিশালী : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া ভাষণ যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে গত শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যোগদানের পর নিউইয়র্কের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। বিএনপি মহাসচিব বলেন, ভাষণ যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তিনি (অধ্যাপক ইউনূস) এসব বিষয় বারবার উল্লেখ করছেন।এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনও সন্দেহ নেই। আমরা নিশ্চিত যে, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হবে। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ওই ভাষণে সরকারের সংস্কার কর্মসূচি ও জাতীয় ঐক্য উভয়ই প্রতিফলিত হয়েছে।
ফখরুল বলেন, প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে নিঃসন্দেহে সেই উদ্দেশ্যের কথাই বলেছেন, যার ভিত্তিতে তাদের সরকার গঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তারা এমন সময়ে দায়িত্ব নিয়েছিলেন যখন গণ অভ্যুত্থানের পর দেশে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। রাজনৈতিক দল ও শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে তাদের সেই দায়িত্ব দিয়েছিল। তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি যে ভয়াবহ অবস্থায় ছিল এক বছরের মধ্যেই সরকার আপেক্ষিকভাবে ভালো অবস্থায় আনতে চেষ্টা করেছে।
এসব বিষয়ও তার ভাষণে প্রতিফলিত হয়েছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, অধ্যাপক ইউনূস ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে তার সরকার কাজ শুরু করেছে এবং অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিও মোকাবিলা করেছে। তিনি বলেন, আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের প্রস্তাব দিয়ে আসছি। বেগম খালেদা জিয়া প্রথম ২০১৬ সালে ভিশন ২০৩০ উপস্থাপন করেছিলেন, যেখানে কাঠামোগত ও রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল।
এছাড়া তারেক রহমান ২০২২ সালে ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, যেখানে রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ যে পরিস্থিতি তৈরি করেছিল তা মৌলিক পরিবর্তনকে অপরিহার্য করে তুলেছিল। তিনি বলেন, একদিকে রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তন এবং অন্যদিকে অর্থনৈতিক কাঠামো সংস্কার না করলে জাতিকে এগিয়ে নেওয়া কঠিন হতো। এ কাজই তারা শুরু করেছেন। আজ তিনি সেই বিষয়গুলো জাতির সামনে যেমন উপস্থাপন করেছেন, তেমনই জাতিসংঘের বৈশ্বিক ফোরামেও তুলে ধরেছেন।
প্রধান উপদেষ্টার অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা খুব খুশি, ইতিহাসে প্রথমবার তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকারের কাজে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং তাদের জাতিসংঘে সঙ্গে নিয়েছেন। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জাতির ঐক্য প্রদর্শন। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি, এটি এক অনন্য উদ্যোগ এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ জন্য আমরা পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছি এবং আমাদের নেতা তারেক রহমানও এটিকে সমর্থন করেছেন। জামায়াতে ইসলামী অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) ইস্যুতে আন্দোলন চালাচ্ছে-এ প্রসঙ্গে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করে ফখরুল বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছি, বিএনপি নিম্নকক্ষে পিআরের পক্ষে নয়, এমনকি উচ্চকক্ষেও এর পক্ষে আমরা কথা বলিনি। এ ধরনের বিষয়গুলো পরবর্তী সময়ে আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা হবে।
দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আহ্বান : ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে দেশগুলো দ্রুত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যেতে পেরেছে, সেগুলোর অবস্থান ভালো। অন্যদিকে, যারা তর্ক-বিতর্ক ও বিভিন্ন ইস্যু সামনে এনে নির্বাচন বিলম্বিত করেছে, সেসব দেশে গৃহযুদ্ধ, সামাজিক বিভক্তি এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে। এই বিষয়টির ওপর জোর দিয়ে বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আগে নির্বাচন, বিলম্ব করলে সংকট বাড়বে। গত ১৫-১৬ বছর ধরে একটি প্রতিনিধিত্বহীন সরকার দেশ চালিয়েছে, যার কারণেই বাংলাদেশ আজ সংকটের মুখে। শেখ হাসিনার স্বৈরাচার পতনের ১৪ মাস পরেও কেন সংস্কার নিয়ে আলোচনা চলছে।
এর কারণ ১৪ মাস পরেও বাংলাদেশ একটি প্রতিনিধিত্বহীন দেশ হিসেবে পরিচিত। গতকাল শনিবার রমনায় বিআইআইএসএস অডিটোরিয়ামে ডেমোক্রেসি ডায়াস বাংলাদেশ আয়োজিত ‘সংস্কার ও নির্বাচন: প্রেক্ষিত জাতীয় ঐক্য’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। সেমিনারে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন ডেমোক্রেসি ডায়াস বাংলাদেশ চেয়ারম্যান ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন। সেমিনারে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব ড. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম প্রমুখ।
সেমিনারে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী সভাপতি ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বিএনপি মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর (পাভেল), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ শাহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম আলী রেজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, শিক্ষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান, সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মাসুদ কামাল প্রমুখ।
সেমিনারে বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে যে দেশগুলো দ্রুত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যেতে পেরেছে, সে দেশগুলো ভালো আছে এবং ভালো করছে। আর যে দেশগুলো তর্ক-বিতর্ক এবং বিভিন্ন ইস্যু সামনে এনে নির্বাচন বিলম্বিত করেছে, সেসব দেশে গৃহযুদ্ধ, সামাজিক বিভক্তি এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে। এটা গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত। আমীর খসরু বলেন, ১৪ মাস পরেও এখনো তর্ক-বিতর্ক চলছে। অথচ আমাদের পাশেই একটি দেশে বিপ্লব বা অভ্যুত্থান হওয়ার পর, দায়িত্ব নিয়ে প্রথম কাজ হিসেবে তারা একটি নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে।
তিনি আরও বলেন, সহজ পথ হলো, যেটা আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে ৩১ দফা করেছি। আমাদের বিষয়টি আমরা পরিষ্কার করে জনগণের কাছে নিয়ে গেছি এবং ৩১ দফা নিয়ে আমরা জনগণের কাছে আবারো যাব। কিন্তু এর বাইরে গিয়ে যে এক্সারসাইজ চলছে, তার মাধ্যমে লাভের থেকে ক্ষতি বেশি হচ্ছে কিনা, তা আমাদের বিবেচনা করতে হবে। আমরা কি প্রতিনিয়ত জাতিকে বিভ্রান্ত করছি? আমরা কি কোনো কারণ ছাড়াই জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছি?আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, খুবই পরিষ্কার কথা, প্রত্যেকটি দলের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, দর্শন ও ভবিষ্যৎ রূপরেখা থাকবে। আপনি নিয়ে যান আগামী নির্বাচনের জনগণের কাছে।
আপনি ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদে আসুন, পাশ করুন। কিন্তু আপনি ঐকমত্য কমিশনের কথা বলে, এর মধ্যে অনেক এক্সারসাইজ করলেন, এখন আবার ঐকমত্যের বাইরে গিয়ে নতুন নতুন দাবি নিয়ে জাতিকে বিভক্ত করবেন? আমি প্রথমে যেটা বলেছি, যে সমস্ত দেশ অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে এই চক্রের মধ্যে পড়েছে, সেই সমস্ত দেশ আজ অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় আছে। আমরা বাংলাদেশকে সেদিকে নিয়ে যেতে পারব না।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ৫ আগস্টের পর আমরা দুইটি বিষয়ে জোর দিয়েছি। এর একটি হচ্ছে সংস্কারের বিষয়ে ঐক্যমত ও অন্যটি নির্বাচনের বিষয়ে। বর্তমানে অনেক রাজনৈতিক দল আগাম প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মাধ্যমে পলিটিক্যাল মাইলেজ নিতে চাচ্ছে। তবে ক্ষমতায় যাওয়ার পর যদি এসব বাস্তবায়ন না করে তাহলে এটি হবে রাজনৈতিক পরাজয়। তিনি বলেন, নিম্ন কক্ষের পিআরের কোনো বাস্তবতা নেই। তবে উচ্চ কক্ষের পিআর বিষয়ে আমরা অধিক আলোচনা করতে পারি।
বিআলো/ইমরান