চিকিৎসকদের ব্যবসায়ী আচরণ:ওষুধের বাজারে নৈরাজ্য
নিয়ন্ত্রকও মানছে না ওষুধের দাম বাড়ানোর আইন
গেজেট প্রকাশের পর ওষুধের দাম নির্ধারণ করার নিয়ম
আইন অনুযায়ী ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা সরকারের– জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ব্যারিস্টার, সুপ্রিম কোর্ট
আমাদের পক্ষে দাম কমানোর সুযোগ নেই– আসরাফ হোসেন, পরিচালক, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর
রতন বালো: বাংলাদেশের ওষুধের বাজারে নৌরাজ্য সকল সীমা অতিক্রম করেছে। চিকিৎসকদের ব্যবসায়ী আচরণে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন দেশের সাধারণ মানুষ। ডাক্তারদের কাছে গেলে ব্যবস্থাপত্রে নিম্ন মানের ওষুধের পাশাপাশি কাড়ি কাড়ি পরীক্ষা নীরিক্ষার কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হয়। আবার যেসব ওষুধ লিখা হয় তার একটি বড় অংশ অপ্রয়োজনীয় কেবল ডাক্তাদের আর্থিক সুবিধা দিয়ে নিম্নমান কোম্পানিগুলো এসব ওষুধ লিখার পাট্টা দিয়ে থাকে।
এদিকে ফার্মেসিতে গেলে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। বিশেষ করে ব্যবস্থাপত্রে লিখা ওষুধের পরিবর্তন ঘটানো একটি নিত্যনৈমিত্তিক। আবার একই কাজে বা রোগে ব্যবহৃত ওষুধ বিভিন্ন কোম্পানির দামে বিরাট ফারাক রয়েছে। ফলে, ওষুধ কিনতে যেয়ে মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। কম দামি কোম্পানির ওষুধ বেশি দামে ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনের মনিটরিং না থাকায় সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে। যদিও অভিযোগ রয়েছে, ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক তাদের নিয়মিত ট্যুর না দিয়ে সমিতির সঙ্গে অলিখিত চুক্তি করে এই সব মানহীন ওষুধ বিক্রির সনদ দিয়ে থাকেন।
অন্যদিকে ওষুধ প্রশাসনের তুঘলকি তদারকির সুযোগে ফার্মেসি মালিকরা ইচ্ছেমতো ওষুধের দাম, আদায়া করে থাকেন। এ সময় এমন ঘটনাও ঘটে যেমন, এক কোম্পানির ওষুধ বলে আরেক কোম্পানির ওষুধ দেওয়া এমনকি মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধও প্রদান, করার অভিযোগ রয়েছে। আবার ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ‘খেয়াল-খুশি মতো’ দাম বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। গত এক বছরে কোনো কোনো ওষুধের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে বলে জানা যাচ্ছে। যার ভিতরে রয়েছে প্যারাসিটামল সিরাপ। যারা দাম একবছরের ভিতরে দ্বিগুণ হয়েছে। এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ এনজিল্যাক ৫০ সাড়ে সাতটাকা থেকে বেড়ে ১০ টাকা করা হয়েছে। প্রতিটি ট্যাবলেটে বাড়ানো হয়েছে ২.৫০ পয়সা। দেশের স্বনামধন্য ওষুধ কোম্পানি তাদের পণ্যের দাম এভাবে ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে চলেছে। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম নিয়ে এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে।
যদিও বলা হচ্ছে, দেশে জনসংখ্যার তুলনায় ওষুধের দোকান বেশি। তবে ওষুধ সহজপ্রাপ্য করতে সরকার দাম নির্ধারণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক ওষুধের দাম বাড়তে বাড়তে সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে গেছে। তেমনই একটি ওষুধের নাম ‘অ্যানাফ্লেক্স ম্যাক্স-৫০০’। গেঁটে বাতের চিকিৎসায় ব্যবহৃত এই ওষুধটির প্রতিটি ট্যাবলেটের দাম ১০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ২১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর দাঁত ব্যথার ওষুধ মারভ্যান-১০০ মিলিগ্রামের ১০ পাতার একটি বক্স আগে যেখানে চারশ’ টাকায় বিক্রি হতো, এখন সেটির দাম তিনশ’ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাতশ’ টাকায়।
গ্যাস্ট্রিক ও আলসারজনিত রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ফ্যামোট্যাক ২০ মিলি গ্রামের একপাতা ওষুধের দাম ২৫ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা করা হয়েছে। এ দিকে দাম বাড়ার বিষয়ে কোম্পানির ব্যাখ্যা, গত এক বছরে যেসব ওষুধের দাম বেড়েছে, সেগুলোর জন্য ওষুধের কাঁচামাল, উৎপাদন ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়া দায়ী বলে জানিয়েছে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো।
নিয়ন্ত্রকও মানছে না ওষুধের দাম বাড়ানোর আইন :
একসময় দুইশর বেশি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিত সরকার, এখন ঠিক করতে পারে মাত্র ১১৭টির। এ ক্ষেত্রে কিছু আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু তাও মানছে না ওষুধ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
১৯৮২ সালের ঔষধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশের ১১ (১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, ‘সরকার অফিশিয়াল গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ওষুধের দাম নির্ধারণ করতে পারবে।’ আইনের এই ধারা অমান্য করে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওষুধের দাম বাড়িয়ে চলেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ২০২২ সালে এভাবে দুবার ওষুধের দাম বাড়িয়েছে সংস্থাটি ওষুধের দাম বাড়িয়ে প্রথম প্রজ্ঞাপনটি প্রকাশ করা হয় গত বছরের ২০ জুলাই। সেই প্রজ্ঞাপনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার প্যারাসিটামলের দাম বাড়ানো হয় ৫০ থেকে শতভাগ। ৪০ টাকার অ্যামোক্সিসিলিনের দাম বাড়িয়ে করা হয় ৭০ টাকা এবং ২৪ টাকার ইনজেকশন হয়ে যায় ৫৫ টাকা। ওষুধের দাম বাড়াতে দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয় গত বছরের ৪ ডিসেম্বর। সেই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২৪টি ওষুধের দাম বাড়ায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। শুধু তা-ই নয়, প্রজ্ঞাপন ডিসেম্বরে জারি করা হলেও মূল্য কার্যকর হয়েছে এরও আগে, ২০ নভেম্বর থেকে।
যা বলছে ক্যাব:
ভোক্তা গেজেট প্রকাশ না করে এভাবে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে ওষুধের দাম বাড়ানোটা বেআইনি বলে জানিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ক্যাব জানায়, দেশে উৎপাদিত এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত ১১৭টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। আইন অনুসারে প্রতিটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই এই তালিকার ৬০টি ওষুধ উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ উৎপাদনকারীই এর মধ্যে অল্প কয়েকটি ওষুধ উৎপাদন করে। এই ১১৭টির বাইরে অন্য সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো, যা ১৯৮২ সালের ঔষধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশের ১১ (১) ধারার লঙ্ঘন বলে মনে করে ক্যাব।
আইনগত ভিত্তি:
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় আইন লঙ্ঘন হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আইন অনুযায়ী ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা সরকারের। তবে দাম বাড়াতে হলে বাজার যাচাই করতে হবে, বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করতে হবে এবং গণশুনানি করতে হবে। তিনি আরো বলেন, প্রাণরক্ষাকারী অনেক ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ না করে ওষুধ কোম্পানিগুলো নির্ধারণ করছে। কোম্পানিগুলো এ ক্ষেত্রে যদি এক টাকাও দাম বাড়ায়, আর সেটা যদি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর মেনে নেয়, তা হবে বেআইনি।
যা বলছে ঔষুধ প্রশাসন:
এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আসরাফ হোসেন বলেন, আমাদের পক্ষে দাম কমানোর সুযোগ নেই। প্রতিযোগিতা কমিশন থেকে কোনো প্রস্তাবনা এলে সেটা বিবেচনা করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের দাম কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমতো বাড়ালেও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নীরব ভূমিকা পালন করে। সম্প্রতি দেশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বাড়লে কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ধরনের স্যালাইনের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রেও ঔষধ প্রশাসনের ভূমিকা জনগণের বিপক্ষে অবস্থানের শামিল।
উৎপাদককারীদের বক্তব্য:
বাজারে দাম বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, দেশের একমাত্র উৎপাদিত পণ্য ওষুধ, যার দাম নির্ধারণ করে কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসনের সিদ্ধান্তই আমাদের সিদ্ধান্ত।
তবে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মুক্তাদির বলেন, ৮৬ টাকার ডলার এখন ১১৭ টাকা। সে হিসাবে পণ্যের দাম আরো বাড়ার কথা। আমরা এখনো দাম বাড়াইনি, তবে অদূর ভবিষ্যতে বাড়াতে হবে। জাতীয় ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটির সদস্যসচিব আলমগীর কবির বলেন, আমরা নিয়ম অনুযায়ী ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এছাড়া আইনজীবীর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ সংক্রান্ত আইনি নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তারা বিষয়টি সুরাহা না করলে আমরা আদালতের আশ্রয় নেব।
বিআলো/ইমরান