চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু তিন মাসে আক্রান্ত ৫ হাজার ৯৮৮
রতন বালো: চলতি আষাঢ় মাস তাই ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব বাড়বে এমন শঙ্কা স্বাস্থ্য বিভাগের। বিগত বছরের চেয়ে এবছর ডেঙ্গু বেশি করে আতঙ্ক চড়াচ্ছে। চলতি বছরের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে ডেঙ্গু বেড়েছে তার আগের মাসের চেয়ে দ্বিগুণ হারে। চলতি জুন মাসের প্রথম ১৫ দিন যত রোগী মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তা আগের মাসের আক্রান্তের প্রায় সমান। গত তিন মাসে (গত রবিবার পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯৮৮।
এদিকে রোগটি কেবল ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নেই। দেশের প্রত্যন্ত জেলা উপজেলায় রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। টানা ছয় দিন ডেঙ্গুতে ভুগে বরগুনা সদর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন শারমিন (২১)। গত রবিবার তিনি ছাড়া পেয়েছেন। শারমিন জানান, স্যালাইন থেকে শুরু করে ওষুধ যা লেগেছে, তার প্রায় সবই বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। এদিকে বরগুনা সদর হাসপাতালে ৫০টি শয্যা ডেঙ্গুর জন্য বরাদ্দ। সেভ খানে গত রবিবার পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ১৯২ ডেঙ্গু রোগী। চলতি মাসে প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে বাড়ছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ২৪৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। যার ভিতরে একজন মারা গেছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, চলতি বছরের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে ডেঙ্গু বেড়েছে তার আগের মাসের চেয়ে দ্বিগুণ হারে। চলতি জুন মাসের প্রথম ১৫ দিন যত রোগী মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তা আগের মাসের আক্রান্তের প্রায় সমান।
স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেব বলছে, গত কয়েক মাসে রোগির সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। মার্চ মাস থেকে ডেঙ্গু বাড়তে থাকে দেশে। ওই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩৩৬ জন। পরের মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭০১। মে মাসে আক্রান্তের সংখ্যা হয় ১ হাজার ৭৭৩। এ মাসে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বাড়ে সংখ্যা। চলতি জুন মাসে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৬৪৩।এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট হচ্ছে এবারও ডেঙ্গু ব্যাপক হারে বাড়বে?
এদিকে ঘন ঘন বৃষ্টি এবং বাতাসের আর্দ্রতার আধিক্য ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে অনেকটাই নাজুক করে তুলছে। এবার লক্ষণীয় দিকটি হলো, রাজধানীর চেয়ে দেশের অন্যত্র ডেঙ্গু বিস্তারের পরিমাণ অনেক বেশি। রাজধানীতে মশা নিধনে কিছুটা হলেও একটা ব্যবস্থা আছে, কিন্তু ঢাকার বাইরে তা–ও নেই। আবার চিকিৎসা পরিকাঠামো নেই পর্যাপ্ত। আর এসবই এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে শঙ্কাজনক করে তুলেছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে এখনই জোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন।
গত বছর দেশে অন্তত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত এমন দ্বিগুণ সংখ্যায় ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেনি। দেশে এ এযাবৎকালের সর্বোচ্চ সংক্রমণের বছর ২০২৩ সালের মে মাসের চেয়ে জুনে এক লাফে পাঁচ গুণ ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। গত বছর ডেঙ্গু বেশি বাড়তে থাকে আগস্ট মাস থেকে। এখন চলতি বছরের জুন মাসে আবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।গত কয়েক মাসের দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি ইঙ্গিত দিচ্ছে এবারও ডেঙ্গু ব্যাপক হারে বাড়বে? যদিও সংখ্যা বা প্রবণতা দেখে বলার উপায় নেই যে ডেঙ্গু বাড়বে। তবে এটা ঠিক যে ইতিমধ্যে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু রোধে মোক্ষম কাজটি হয়নি। তাই এবার যে বাড়বে না, তাও বলা যায় না।
যুক্তরাজ্যের কেইল ইউনিভার্সিটির মশাবাহিত রোগের গবেষক ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানী নাজমুল হায়দার এ প্রসঙ্গে বলেন, সংখ্যা বা প্রবণতা দেখে বলার উপায় নেই যে ডেঙ্গু বাড়বে। তবে এটা ঠিক যে ইতিমধ্যে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু রোধে আমরা আসলে কিছুই করিনি। তাই এবার যে বাড়বে না, তাও বলা যায় না।
এদিকে এইভাবে রোগি বাড়তে থাকায় শঙ্কিত সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে তাদের করণীয় অনেকটাই কম বলে দাবি করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক হালিমুর রশীদ। তিনি বলেন, আমরা রোগনিয়ন্ত্রণে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু মশার উৎস বন্ধ না হলে রোগী বন্ধ হবে না। প্রজননক্ষেত্র বেড়ে যাবে। মশার প্রজননক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ তো আমাদের হাতে নেই। এটা সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর কাজ। আর সেখানেই বড় দুর্বলতা রয়ে গেছে।
কি করছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো:
দেশে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তের ২৩ শতাংশ ঢাকার দুই সিটিতে। বাকি আক্রান্তরা ঢাকার বাইরের। দেশের মোট আক্রান্তের ৪৫ শতাংশই বরিশাল বিভাগের। এ বিভাগের বরগুনায় দেশের মোট আক্রান্তের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। বরগুনা শহরে দিনরাত সমানভাবে শহরের সর্বত্র বাড়িঘরে মশার উপদ্রব থাকে। মশার কয়েল, ধূপ জ্বালিয়ে ধোঁয়া দেওয়ার পরও মশার উপদ্রব কমে না। মশার উপদ্রব কমাতে পৌরসভার পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
কথা হয় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেনের সঙ্গে। তিনি যেমনটি বলছিলেন। মশা নিয়ন্ত্রণে জোরদার কোনো পদক্ষেপ নেই। সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারে কোনো জনপ্রতিনিধিরা নেই। আগে যখন ছিলেন, তখন যে খুব ভালো অবস্থা ছিল, তা বলা যাবে না। কিন্তু একটা ন্যূনতম জবাবদিহি ছিল। এখন যাঁরা আছেন, তাঁরা রুটিন কাজ করেন।
বরগুনার স্থানীয় স্বাস্থ্য দপ্তর নিজেদের সীমিত সেবার বিষয়টি এড়িয়ে যেয়ে সব দোষ সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্বাস্থ্য কর্মী জানালেন, শহরে দিনরাত সমানভাবে শহরের সর্বত্র বাড়িঘরে মশার উপদ্রব নিজেদের একক উদ্যোগে প্রশমন করা সম্ভব নয়। এবিষয়ে নাগরিক সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। আপনার আঙিনা যদি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন না রাখেন তাহলে মশার উপদ্রব বাড়বে। যদিও এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে বসবাস করে কিন্তু আপনাকে নিয়মিত পানি শোধনের দায়িত্ব নিতে হবে। কোন পরিস্কার পানি যেন তিনদিনের বেশি না থাকে। স্বচ্ছ বৃষ্টির পানিতে এডিস মশার প্রজন্ন বাড়ে। তাই সুস্বাস্থ্যের জন্য আপনাকে এগিয়ে আসতে হবে।
স্থানীয় বাসিন্দা আওয়াল বলেন, মশার কয়েল, ধূপ জ্বালিয়ে ধোঁয়া দেওয়ার পরও মশার উপদ্রব কমছে না। মশার উপদ্রব কমাতে পৌরসভার পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও তারা অনেকটাই উদাসীন বলেও তার অভিযোগ।
বৈরী আবহাওয়া বিপদ:
চলতি বছরের আবহাওয়া পরিস্থিতি ডেঙ্গুর অনেকটাই অনুকূলে বলে মনে করছেন কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা। বছরের সবচেয়ে উষ্ণ মাস এপ্রিল। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিলে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, মে মাসে বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৩ শতাংশ বেশি। জুন মাসে তাপপ্রবাহ থাকলেও অনেক স্থানেই বৃষ্টি হচ্ছে। এ মাসে আবার একটি নিম্নচাপের পূর্বাভাস রয়েছে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম বলছিলেন, এই যে ঘন ঘন বৃষ্টি, আবার গরম পড়ছে, এতে এডিস মশা বিস্তারের বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হচ্ছে, এই মশা নির্মূলে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। সব মিলিয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবার বেশ জটিল হয়ে উঠতে পারে।
বিআলো/তুরাগ